মুক্তবুলি ডেস্ক
আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইব্ন বতুতা (আরবি: أبو عبد الله محمد بن عبد الله اللواتي الطنجي بن بطوطة, ʾAbū ʿAbd al-Lāh Muḥammad ibn ʿAbd al-Lāh l-Lawātī ṭ-Ṭanǧī ibn Baṭūṭah) সুন্নি মুসলিম পর্যটক, চিন্তাবিদ, বিচারক এবং সুন্নি ইসলামের মালিকি মাযহাবে বিশ্বাসী একজন ধর্মতাত্ত্বিক। তিনি ১৩০৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মরোক্কোর তাঞ্জিয়ারে জন্মগ্রহণ করেন। চীন সহ পৃথিবীর অনেক জায়গায় তিনি “শামস-উদ-দীন” নামেও পরিচিত।
ইবন বতুতা সারা জীবন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। পৃথিবী ভ্রমণের জন্যই তিনি মূলত বিখ্যাত হয়ে আছেন। একুশ বছর বয়স থেকে শুরু করে জীবনের পরবর্তী ৩০ বছরে তিনি প্রায় ৭৫,০০০ মাইল(১,২০,০০০কিমি) পথ পরিভ্রমণ করেছেন। তিনিই একমাত্র পরিব্রাজক যিনি তাঁর সময়কার সমগ্র মুসলিম বিশ্ব ভ্রমণ করেছেন এবং এর সুলতানদের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। অর্থাৎ বর্তমান পশ্চিম আফ্রিকা থেকে শুরু করে মিশর, সৌদি আরব, সিরিয়া, ইরান, ইরাক, কাজাকিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং চীন ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। তার কিছুকাল পূর্বে এমন দীর্ঘ ভ্রমণ করে বিখ্যাত হয়েছিলেন ভেনিসের ব্যবসায়ী এবং পরিব্রাজক মার্কো পোলো। কিন্তু ইবন বতুতা মার্কো পোলোর তিনগুণ বেশি পথ সফর করেছিলেন।
ভ্রমণকালে তিনি এই উপমহাদেশের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, সুফি, সুলতান, কাজি এবং আলেমদের সাক্ষাৎ লাভ করেন। ৩০ বছরে প্রায় ৪০ টি দেশ ভ্রমণ করে নিজ দেশ মরোক্কোতে ফেরার পর মরোক্কোর সুলতান আবু ইনান ফারিস তাঁর ভ্রমণকাহিনীর বর্ণনা লিপিবদ্ধ করার জন্য একজন সচিব নিয়োগ করেন। এই ভ্রমণকাহিনীর নাম “রিহলা”। এটিকে ১৪শ শতকের পূর্ব, মধ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সাম্রাজ্যের ইতিহাসের অন্যতম দলিল হিসেবে বিবেচনা কর হয়।
বাংলাদেশ: টানা তেতাল্লিশ রাত সাগরে কাটিয়ে অবশেষে আমরা বাংলাদেশ পৌছালাম। সবুজে ঘেরা বিশাল এক দেশ, প্রচুর চাল পাওয়া যায়। অন্য সব জিনিষও এত সস্তায় পাওয়া যায় সে দেশে যে এরকম আর কোথাও দেখি নি। তবে দেশটির আর সবকিছু হতাশাব্যাঞ্জক। খুরাশানের (বর্তমান আফগানিস্তান) লোকেরা দেশটিকে বলে “প্রানপ্রাচুর্যে ভরা জাহান্নাম”।
ইবন বতুতার বর্ননায় পাওয়া যায় মাত্র এক দিরহাম দিয়ে তখন বাংলাদেশ আটটি স্বাস্থবান মুরগী পাওয়া যেত, এছাড়াও এক দিরহামে পনেরোটা কবুতর, দুই দিরহামে একটি ভেড়া এবং এক স্বর্নমূদ্রারও কম মূল্যে দাসদাসী কিনতে পাওয়া যেত। যখন ইবন বতুতা বর্তমান বাংলাদেশে এসে পৌছান তখন এখানকার সুলতান ছিলেন ফখর-উদ-দিন। ইবন বতুতার বাংলাদেশে আসার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল মহান দরবেশ (হযরত শাহ জালাল রঃ) সাথে সাক্ষাৎ করা।
সিলেটের পর্বতশ্রেণির মধ্যে যেখানে হযরত শাহ জালাল রঃথাকতেন সেখান থেকে প্রায় দুই দিনের দূরত্বেই তার দুজন শিষ্যের সাথে দেখা হয় ইবন বতুতার। তাদের কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন যে শেখ জালাল-উদ-দিন আদেশ দিয়েছেন, পশ্চিম থেকে যে পর্যটক তার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসছেন তাকে যেন স্বাগত জানিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। অথচ ইবন বতুতার সাথে হযরত শাহ জালাল রঃ এর আগে থেকে কোন পরিচয় ছিল না কিংবা ইবন বতুতা তার আগমনের কোন খবরওহযরত শাহ জালাল রঃ দেন নি। এখান থেকেই ইবন বতুতা হযরত শাহ জালাল রঃ এর আধ্যাত্বিক ক্ষমতার ব্যাপারে ইঙ্গিত পান।
হযরত শাহজালালের (রঃ) সাথে সাক্ষাৎ করে ফেরার পথে ইবন বতুতা একটি ছাগলের পশমের কোট উপহার পান। ইবন বতুতার বর্ননা মতেহযরত শাহ জালাল রঃ একটি পাহাড়ের গুহায় বসবাস করতেন যেখানে তারা ছাগল পূষতেন দুধ এবং মাখনের জন্য। তার সহযোগীরা প্রত্যেকেই সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেন এবং কেউই এদেশীয় ছিলেন না। অবশেষে হযরত শাহ জালাল রঃ কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দীপের উদ্দেশ্যে রওনা হন।
এরপর তিনি জাহাজ যোগে সোয়াহিলি উপকূল এবং মম্বাসা দ্বিপ ভ্রমণ করেন। ১৩৪৫ শেষের এর দিকে তিনি চিনের কুওানঝু প্রদেশে পৌঁছান। সেখানে স্থানীয় মুসলমানরা তাকে সাদর সম্ভাষণ জানান। ১৩৪৬ সালে তিনি পুনরায় মক্কার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন।
অবশেষে ১৩৫৪ সালে জন্মভুমি মরক্কতে ফেরেন। দেশে ফেরার পর তিনি তার ভ্রমণ কাহিনি লেখা শুরু করেন। ‘A Gift to Those Who Contemplate the Wonders of Cities and the Marvels of Travelling’ শিরোনামে এই লেখাটি তার ভ্রমণের একমাত্র নির্ভরযোগ্য দলিল।