সোহেল রানা
এক সময় দেশে যৌতুক প্রথা, এসিড নিক্ষেপ, ইভটিজিং ব্যপক আকার ধারন করেছিল। সময়ের আবর্তনে এইসব অপরাধ অনেকটাই কমে এসেছে। কিন্তু সেই অপরাধের জায়গাগুলো এখন দখল করেছে ‘ধর্ষণ’ নামক এক ঘৃন্য প্রথা। সকালে ঘুম থেকে উঠে হাতে পেপার নিলেই আতঁকে উঠতে হয়। শিশু থেকে শুরু করে ৪০ বছরের চার সন্তানের জননীও ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, এমন কি ছেলে মেয়েদের সব থেকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল বাবা দ্বারাও ধর্ষণের বা বলৎকারের ঘটনাও আমরা গনমাধ্যমে দেখতে পাই।
কোথাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তুলি, কখনো বা ব্যানার হাতে রাস্তায় মানববন্ধন করি। ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি চাই, প্রকাশ্য ক্রসফায়ারের মাধ্যমে হত্যা করার কথাও জাতীয় সংসদে প্রস্তাব করা হয়েছে। কখনো আবার ধর্ষকের কারণ খুঁজতে গিয়ে তুমুল বিতর্কে জড়িয়ে পড়ি আমরা। একপক্ষ নারীর পোশাককে দায়ী করলে অন্যপক্ষ পুরুষের মানসিকতাকে দায়ী করেন। আসলে এভাবে বিতর্কে জড়িয়ে ধর্ষণ নামক সামাজিক ব্যাধিকে সমাজ থেকে দূর করা সম্ভব কিনা সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষে। যৌতুক প্রথা, এসিড নিক্ষেপ, ইভটিজিংয়ের মতো সামাজিক ব্যাধি থেকে আমরা যেভাবে বেড়িয়ে আসতে পেরেছি ধর্ষণ থেকে সমাজকে রক্ষা করতে আমরা একই নিয়ম অনুসরণ করতে পারি। আইনের শাসন, সচেতনতা এবং ছেলে মেয়ে উভয়কে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে ধর্ষণ নামক ঘৃণ্য এই অপরাধ থেকে আমরা সমাজকে রক্ষা করতে পারি। বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৩৭৫ নং ধারা অনুসারে কোন পুরুষ ধর্ষণ করেছে বলা হবে যদি সে কোন নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে, তার সম্মতিছাড়া, মৃত্যুভয় বা আহত করে জোরপূর্বক অথবা সম্মতি আছে কিন্তু মহিলা বৈধ স্বামী মনে করে ভুলে সম্মতি দিয়েছে, ১৪ বছরের নিচে কোন নারীকে (সম্মতি থাকুক আর না-ই থাকুক) যৌন সঙ্গম করে তবে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে। বাংলাদেশ ভারত, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুরসহ বহুদেশে যারা ব্রিটিশ প্রণিত এই দণ্ডবিধি -১৮৬০ আত্তিকরণ করেছে, সেসব দেশে ধর্ষণের সংজ্ঞা এটাই।
প্রতিটি ধর্ষণের পর দেশের জনগণ ভাগ হয়ে যায়। একপক্ষ পুরো দায় ভিকটিম নারীর পোশাকআশাক, চলাফেরার ওপর দায় চাপিয়ে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তোলে। অন্যপক্ষ পুরো দায়টা ধর্ষকের মানসিক বিকৃতির ওপর চাপিয়ে দেয়। প্রকৃতপক্ষে ধর্ষণের করণ শুধু পোশাক বা মানসিক বিকৃতিই নয়, মাল্টিফেক্টর। মেন্টাল সেট-আপ, নির্জন পরিবেশ, উদ্দীপনা এই তিনটি ফ্যাক্টর মিলেই যে কোন ধর্ষণের ঘটনা সংগঠিত হয়ে থাকে।
যৌনতা মানুষের একটি সহজাত (প্রাকৃতিক) চাহিদা হলেও এটা সবথেকে কৌতুহল ও রহস্যের আধার । জলবায়ুগত কারণে আমাদের দেশের ছেলে মেয়েরা অপ্রাপ্ত বয়সেই যৌন পরিপক্বতা লাভ করে। যৌন বিষয়ে অধিক জল্পনা-কল্পনা তাদের পর্ণগ্রাফির দিকে ধাবিত করছে। ফোবস ম্যগাজিন তাদের একটি আর্টিকেলে বলেছে, জনপ্রিয় পাঁচটি পর্নোসাইটে প্রতিদিন ২০ কোটি ভিউ হয় এবং ১৩-২৪ বছর বয়সী ৬৪% তরুণ-তরুণী সপ্তাহে ১ বার হলেও পর্নসাইট খোঁজে। ২০০৯ সালে দেশের একটি জনপ্রিয় ইংরেজি দৈনিক তাদের এক জরিপে জানিয়েছিল- রাজধানি ঢাকার ৭৭% স্কুলগামী শিশু পর্ন দেখে বা ইতিমধ্যে দেখেছে। এছাড়াও রয়েছে ঢালিউড, বলিউড, হলিউডে যৌন সুরসুরিমূলক সিনেমা, শর্ট ফ্লিম, আইটেম সং। পত্র পত্রিকায় ধর্ষণের স্থানের দিকে লক্ষ্য রাখলে দেখতে পাই অধিকাংশ ধর্ষণই সংগঠিত হচ্ছে রাস্তার পাশে নির্জন অথবা জনশূন্য কোন স্থানে।
ধর্ষক প্রকৃতি:
বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. রবার্ট পেন্টিক প্রায় ৩০০ সাজাপ্রাপ্ত ধর্ষকের প্রকৃতি নির্ধারণ করেন। তাঁর মতে ২৩% সুযোগ সন্ধানী, এরা অপরিকল্পিত, আকস্মিক ধর্ষণ করে থাকে। রুচিগত কোন সমস্যা নয় বরং গভীর রাত, একলা মেয়ে আশেপাশে কেউ নেই। অধিকাংশ তরুণি ডেটিংয়ে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়।
৩২% ভিনডিকটিভ (প্রতিহিংসাপরায়ণ) ধরনের। এরা মেয়েদের প্রতি কোন কারণে রাগের বশবর্তী হয়ে ধর্ষণ করে থাকে। প্রায় ধর্ষকেরাই বলে, আমি ধর্ষণ করতে চাইনি, মেযেটি আমাকে রাগিয়েছে, অপমান করেছে। নারীর এ ধরনের অপমান পুরুষ তার পুরুষত্বের অপমান ধরে ধর্ষণ করেছে।
২৫ শতাংশ ধর্ষক ধর্ষণ মিথে বিশ্বাস করে। এরা মনে করে পোশাক বা ভাব ভঙ্গির মাধ্যমেই মেয়েটি সেক্স চায়, মেয়েরা ধর্ষণে মজা পায়, রেপ বলে কিছু নেই, মেয়েরা শুধুমাত্র শোধ নিতে ধর্ষণের দাবী তোলে, একবার সেক্স করতে পারলে মেয়েটা তাকে ছেড়ে আর যাবে না, মেয়েটা তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়বে, মেয়েদের না আসলে না নয়, মনে সায় ঠিক থাকে- ইত্যাদি ভ্রান্ত ধারনায় তারা বিশ্বাসী ১১% ধর্ষক স্বভাবগতভাবে রাগী বা অপরাধী। সুবিধাবঞ্চিত জীবনযাপন, ছোট বেলা থেকে নিগ্রহ, মাদকাসক্তি, ব্রকেন ফ্যামিলি ও শিক্ষার অভাবের কারণে তারা এমনি করে থাকে। ৮% একদম বিকৃতি মনা, স্যাডিস্ট। এদের কাছে ভিকটিমের ভয় পাওয়াটাই বেশি উত্তেজনাকর। অর্থাৎ ৯২% ধর্ষকই স্বাভাবিক মনোবৃত্তি, শুধু মাত্র ৮% বিকৃতি মনা। সামাজিক অবক্ষয়ের চরম মাত্রা হলো ধর্ষণ যা এখন সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। তাই এর উত্তরণেও প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। প্রকৃত ধর্মপালনকারী (সে যে ধর্মের হোক না কেন) এবং নৈতিকতার গুন নিয়ে বেড়ে ওঠা মানুষরা কখনো ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ করতে পারে না। এক্ষেত্রে সবার আগে যুবক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। দেশে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যেকটি ধর্ষণ মামলার দ্রুত বিচার কার্য সম্পন্ন করে অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ধর্ষণ আইন পরিবর্তন করে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করতে হবে।
সোহেল রানা
শিক্ষার্থী, গনযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্র: মুক্তবুলি ম্যাগাজিন, ১৩তম সংখ্যা।