এম. অলিউল্যাহ হাসনাইন
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে অনেক বেকার জনগোষ্ঠী রয়েছে । আর এই বিশাল জনশক্তিকে জনসম্পদে রুপান্তর করাই একজন সফল উদ্যোক্তার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত । জনশক্তিকে জনসম্পদে রুপান্তরের মধ্য দিয়েই একজন উদ্যোক্তা সফলতায় এগিয়ে যেতে সক্ষম হয় এবং একটি সমৃদ্ধশীল সমাজ নির্মিত হয় । আমরা অনেকেই ভাবি যে, একজন সফল উদ্যোক্তা হতে হলে হয়তোবা প্রচন্ড রকমের সৃজনশীল হতে হবে কিংবা যুগান্তকারী একটি আইডিয়া থাকতে হবে, অনেক পুঁজি থাকতে হবে । কিন্তু ব্যাপারটি আসলে সম্পূর্ণরূপে আলাদা । সফল উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি বিষয় কাজ করে । তার মধ্যে একটি হলো কর্মপরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন ।
একজন সফল উদ্যোগতার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে–
লক্ষ্য বাস্তবায়নে আগ্রহী হওয়া
উদ্যোক্তাকে প্রথমেই সফলতা অর্জনের উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকতে হবে । উদ্যোক্তার উৎসাহ উদ্দীপনা দেখেই টিমের সদস্যরা অধিক কাজ করতে উৎসাহি হবে । উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে যখন আপনি এবং আপনার টিম কাঙ্খিত সেবা প্রদানে সক্ষম হবেন তখন সেবা গ্রহণকারীর আপনার প্রতিষ্ঠানের প্রতি আগ্রহ বাড়বে । প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য হতে হবে গ্রাহককে সেবা প্রদান । সেবা প্রদানের মাধ্যমে কাস্টমার যখন আপনার প্রতিষ্ঠানের প্রতি খুশি হবে, তখন আপনি বুঝতে পারবেন যে আপনি উদ্যোক্তা হিসেবে সফলতার দিকে আরও একধাপ এগিয়ে গেলেন ।
সুযোগ হাতছাড়া না করা
নিজের এবং প্রতিষ্ঠান এর সুযোগ সুবিধার দিকে নজর দিলে পরিশ্রম অনেক কমে যাবে এবং দ্রুত সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানো সম্ভব । সুনির্দিষ্ট সেবা নিয়ে কাজ করা শ্রেয় । এতে করে প্রতিষ্ঠানের মান অক্ষুন্ন থাকে এবং প্রতিষ্ঠানের দুর্নাম হয় না ।
তাই অনেকগুলো কাজ একসাথে হাতে নিয়ে গোলমাল পাকিয়ে ফেলার চেয়ে যতটুকু কাজ ঠিকভাবে করার সুযোগ রয়েছে ঠিক ততটুকু কাজই হাতে নিতে হবে । এতে করে কর্মচারীদের উপর যেমন চাপ কমবে তেমনি সঠিক এবং সুন্দর কাজের জন্য বাড়বে গ্রাহক সন্তুষ্টি ।
কঠোর পরিশ্রমী হওয়া
সফলতা কোন সময়ই রাতারাতি অর্জিত হয় না । অনেক ত্যাগ তিতিজ্ঞা এবং পরিশ্রমের উপর ভিত্তি করেই সফলতা প্রতিষ্ঠিত । ভাগ্যের উপর নির্ভর করে বসে থাকলে সাফল্যের ছোঁয়া পাওয়া কখনই সম্ভব না ।
কঠোর পরিশ্রম দ্বারা ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারলেই হাতে ধরা দেবে সাফল্য । একজন সফল উদ্যোক্তা সকল কাজে নিজের সর্বোচ্চটুকু উজার করে দেয় । আপনি যদি লক্ষ্য অর্জনের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যান তবে আপনার হতাশ হওয়ার কোন কারণই নেই । সাফল্য কোন না কোন সময় আপনার কাছে ধরা দেবেই । সফলতার উচ্চ শেখরে পৌঁছাতে হলে আপনাকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে ।
বাস্তবতাকে উপভোগ করা
লক্ষ্যের পেছনে ছুটে যেতে আপনাকে সবাই বলবে, কিন্তু সফল মানুষ আপনার সেই ছুটে যাওয়ার পথকে উপভোগ করতে শেখাবে । তারা আপনাকে শেখাবে চূড়ান্ত সাফল্যের পথে প্রতিটি অর্জনকে উদযাপন করতে । জীবনের অধিকাংশ মূল্যবান সময় লক্ষ্যের পেছনে ছুটতে গিয়ে সেই সময়টা যদি উপভোগই করতে না পারেন তবে কী লাভ সেই লক্ষ্য অর্জন করে? লক্ষ্য অর্জনের পথটা যদি উপভোগ্য হয় তাহলে আপনি এবং আপনার টিম কাজ সম্পন্ন করতে পারবেন প্রচণ্ড উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে । এর ফলে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেন কিংবা না পারেন, কোন কাজ করা নিয়ে আপনার কিংবা আপনার টিমের মাঝে কোন ধরনের হতাশা কাজ করবে না ।
নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখা
অন্যের পরিকল্পনাকে বাস্তবে রুপ দেয়া দুর্বিষহ ব্যাপার । বাস্তব জীবনের অনেক কিছুই হিসাবের খাতায় যোগফল শূন্য । কোনো পান্ডুলিপি বা নির্দেশনা অনেক সময় ভুল পথ দেখায় । সাফল্যের পথ খুঁজে নিতে হয় নিজের বিচার-বিবেচনা দ্বারা । তাই কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে নিজের বিবেককে প্রশ্ন করুন । যদি আপনি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করেন তাহলে আপনার বিবেক আপনাকে ভুল নির্দেশনা দিবে না ।
নিজে কাজ করার চেয়ে অন্যকে দিয়ে কাজ করানোর অভ্যাস করা
একজন মানুষ এর পক্ষে সকল বিষয়ে পারদর্শী হওয়া সম্ভব নয় । সে যেই কাজটি পারে না তার সে কাজটি করে দেয়ার জন্য সেই বিষয়ে দক্ষ অন্য একজন মানুষের সাহায্য প্রয়োজন হয় । উদ্যোক্তারা সাধারণত এতটাই আত্মবিশ্বাসী হয় যে, তারা বিশ্বাসই করতে চায় না যে, কোন কাজ তাদের দ্বারা সম্ভব না । এই ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে অনেক সময় লাগে । তবে উদ্যোক্তা হিসেবে সফল হতে হলে যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে আসতে হবে এই ভুল ধারণা থেকে ।
প্রথমে যেটি করতে হবে তা হচ্ছে নিজের দক্ষতা এবং সামর্থ্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা অর্জন করতে হবে । তারপর যেসব বিষয় আপনার অন্যান্য দক্ষ মানুষের সাহায্য লাগবে সেই বিষয়গুলো খুঁজে বের করতে হবে । তারপর খুঁজে বের করতে হবে সেই বিষয়ের উপর দক্ষ কিছু মানুষ । নিজের মত মানুষ খুঁজে পাওয়া সহজ, কিন্তু নিজের চেয়ে ব্যতিক্রম মানুষ যারা ভিন্ন বিষয়ে দক্ষ, তাদের খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন একটি কাজ । এই কঠিন কাজটি যদি আপনি সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারেন তবে আপনি আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবেন একজন সফল উদ্যোক্তা হিসাবে ।
পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা
প্রথমে আপনাকে একটি বাস্তব পরিকল্পনা করতে হবে । এবার পরিকল্পনা অনুযায়ী আপনাকে মাঠে নেমে বাস্তব পর্যায়ে কাজ করতে হবে । আপনার সাধারণ একটি পরিকল্পনা বা আইডিয়া সঠিকভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে অসাধারণ সাফল্য বয়ে আনতে পারে ।
আপনি যদি পরিকল্পনা করতে গিয়ে অনেক বেশি সময় ব্যয় করে ফেলেন এবং বাস্তবায়নের জন্য সময় পেলেন খুবই কম, তাহলে আপনি সফলতায় পৌঁছাতে অনেক গুণ সময় বেশী অতিবাহিত করতে হবে । পূনরায় পরিবর্তন আনতে হবে কর্মপরিকল্পনায় । কিন্তু আপনি প্রথম পরিকল্পনাতেই এত সময় ব্যয় করে ফেললেন যে, নতুন পরিকল্পনা করার জন্য আপনার হাতে যথেষ্ট সময় নেই । এতে করে আপনার পুরো ব্যবসাটি বিশাল ক্ষতির সম্মুখিন হবে ।
তাই পরিকল্পনার পেছনে খুব বেশি সময় অপচয় না করে বাস্তবায়নে নেমে পরুন । কারণ ব্যবসা করতে মাঠে নামলে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বুঝতে পারা যায় এবং সেই অনুযায়ী তাৎক্ষণিক পরিবর্তন আনা যায় । আর বাস্তবায়ন করতে গেলে অনেক নতুন জিনিস শিখতে পারা যায়, যা পরবর্তীতে ব্যবসায়িক কাজে সহায়তা করবে । খেয়াল রাখবেন পারিপার্শ্বিক পরিবেশের পরিবর্তনের সাথে সাথে আপনার প্রতিষ্ঠান কর্মকাণ্ডের পরিবর্তন আনতে হবে । এতে বাড়বে আপনার সফল হওয়ার সম্ভাবনা ।
সততা এবং ন্যয়পরায়ণ হওয়া
প্রতারণা ও ভন্ডামি করে সাময়িক সাফল্য অর্জন করা যায়, কিন্তু এই সাফল্য বেশিদিন স্থায়ী হয় না । আপনি দেখবেন যেসব প্রতিষ্ঠান তার গ্রাহকদের সাথে প্রতারণা করেছে সে সব প্রতিষ্ঠান সাময়িক ভাবে বেশ লাভবান হলেও তাদের পতনও খুব দ্রুত ঘটেছে । দীর্ঘস্থায়ী সাফল্যের জন্য যে দুটি গুণ প্রয়োজন তা হচ্ছে সততা এবং ন্যায়পরায়ণতা ।
আপনার কর্মকাণ্ডে এই দু’টি গুণ প্রকাশ পাচ্ছে কিনা তা যাচাই করুন, আপনার বিবেককে প্রশ্ন করার মাধ্যমে । এ দুটি গুণ যদি আপনার মধ্যে থাকে এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক কর্মকাণ্ড গুলো যদি আপনি সঠিকভাবে সম্পাদন করতে পারেন তবে সফলতা আপনার জীবনে আসবেই ।
অন্যের কাজকে মূল্যায়ন করা
এই অংশটি ভুলে গেলে চলবে না । যখন আপনার কর্মকাণ্ডে অন্যের কাজকে মূল্যায়নের চিত্র ফুটে উঠবে, তখনই কেবল মাত্র আপনি নিজেকে সফল হিসেবে বিবেচনা করতে পারবেন । আপনি যখন সফলতার দ্বারপ্রান্তে থাকবেন, তখন খেয়াল করে দেখবেন অনেক মানুষ আপনার এই সফলতার পিছনে অবদান রেখেছে । আমরা অনেক সময়ই আমাদের সফলতার পিছনে যাদের অবদান রয়েছে তাদের সবাইকে এর প্রতিদান দিতে পারিনা । কারণ অধিকাংশ সময় তাদের সবাইকে আমরা চিনতেই পারিনা ।
তাদের অনেকেই নীরবে আমাদের সাহায্য করে গিয়েছেন । যখন আপনি সফল হবেন তখন সমাজের প্রতি আপনার একটি দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হবে । এই দায়বদ্ধতা থেকে আপনি আপনার সাধ্যের মধ্যে মানুষকে যতোটুকু সাহায্য করতে পারবেন তার মাধ্যমেই আপনার প্রকৃত সফলতা ফুটে উঠবে ।
সফলতা আসলে কি? এর উত্তর একেক জনের কাছে একেক রকম । এর কোন সার্বজনীন পরিমাপ নেই । বিল গেটস যেমন তার চোখে সফল, তেমনি মাদার তেরেসাও নিজের চোখে সফল । তাই আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনার কাছে সফলতা মানে কি?
আমার মতে, সফলতার মাপকাঠি কখনোই আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হওয়া উচিত নয় । এই মাপকাঠি হওয়া উচিত কতগুলো মানুষের জীবনে আপনি পরিবর্তন আনতে পেরেছেন তার সংখ্যা । আমাদের সফলতার অভিযানে এই মাপকাঠি প্রয়োগ করলে যেমন আমরা প্রকৃত সাফল্য অর্জন করতে পারবো, তেমনি আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশটাকে করতে পারবো আরও সুন্দর সমৃদ্ধ ।
এম. অলিউল্যাহ হাসনাইন লেখক ও শিক্ষক, ভোলা সদর, ভোলা।
খুব ভালো লাগলো।