নীতিহীন নরগোষ্ঠীর নৈরাজ্যে নীড়হার নিরীহ নওজোয়ানরা। দীনের নবীন সওদাগরদের অগ্রযাত্রা রুখতে প্রতীচ্য দাঁড় করিয়েছে ‘জঙ্গিবাদ’ নামক কাল্পনিক থিম। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য। প্রযুক্তিও তাদের একচেটিয়া দখলে। একই সাথে ক্ষমতার চেয়ারের নিরঙ্কুশ অধিকার। এসব সুযোগের ‘সদ্ব্যবহার’ করে তারা মধ্যপ্রাচ্যকে রণক্ষেত্র বানায়। উইলিয়াম হান্টিংটনের সভ্যতার সংঘাত তত্ত্ব রসদ জোগায় বুশ-ব্লেয়ারদের। ট্রাম্প, নেতানিয়াহু, মোদি, শি জিনপিং, অংসান সূচিরা হান্টিংটনের ফরমুলায় বৃত্তবন্দী।
মঙ্গল শাসক হালাকু খানের উগ্রবাদ :
মানব সভ্যতার ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ দুর্ঘটনার জন্ম দেয় মঙ্গল রাজনীতিবিদ হালাকু খান। কারণ হালাকু খানের বর্বরতায় ধ্বংস হয় অষ্টম-ত্রয়োদশ শতাব্দির শ্রেষ্ঠ জ্ঞান প্রদীপ বাগদাদ নগর। ১২৫৮ সালে হালাকু খান কর্তৃক বাগদাদ আক্রমণ ও ধ্বংস না হলে আজও সমগ্র দুনিয়া মুসলিমদের দ্বারা শাসিত হত। ওই যুগে সারা বিশ্বের জ্ঞান বিজ্ঞানের রাজধানী ও কেন্দ্রভূমি ছিলো বাগদাদ। সেই পুস্তকরাজি ধ্বংস এবং শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, জ্ঞানী গুনী, বিজ্ঞানীদের প্রাণ হরণ করায় মুসলিমরা এর হৃদ গৌরব পুনরুদ্ধার করতে পারেনি।
সমাজবিজ্ঞানের জনক ইবনে খালদুনের তথ্যমতে, এ সময় বাগদাদে ২০ লাখ মানুষের বসবাস ছিলো। এরমধ্যে ১৬ লাখ হত্যা করে হালাকু খাঁ। (ড. মুহাম্মাদ সিদ্দিক: ক্রুসেডের গণহত্যা অতীত বর্তমান, পৃ ১৭০) আলেপ্পো শহরে ৫০ হাজার মানুষকে হত্যা করে মঙ্গলরা এবং সেখানকার ১০ হাজার নারী ও শিশুকে দাস হিসেবে বিক্রি করে মঙ্গলরা। হারান শহরের নাগরিকরা আত্মসমর্পণ করে এই শর্তে যে, তাদের শহর ছেড়ে দেয়া হবে। বর্বররা তবুও শহর ছেড়ে ধ্বংস করে ফেলল। এমনকি শিশুদের মায়ের বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে হত্যা করল। (ড. মুহাম্মাদ সিদ্দিক: ক্রুসেডের গণহত্যা অতীত বর্তমান, পৃ ১৬৩)
বাগদাদ ধ্বংসের নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে ব্রাউন বলেন, ‘সম্ভবত কখনোই এত বড় ও সমৃদ্ধশালী একটি সভ্যতা এত দ্রুত অগ্নিশিখায় বিধ্বস্ত ও রক্তধারায় নিশ্চিহ্ন হয়নি।’ মোঙ্গলদের নিষ্ঠুর আক্রমণে অসংখ্য মসজিদ, প্রাসাদ, অট্টালিকা প্রভৃতি নিশ্চিহ্ন হলো। ইসলামের ইতিহাসে বাগদাদ ধ্বংসের ফলাফল সুদূরপ্রসারী। এ সম্বন্ধে পি, সাইকস বলেন, ‘যে ভয়ংকর ধ্বংসলীলা মুসলিম রাজ্যসমূহের এবং পরোক্ষভাবে সমগ্র দুনিয়ার অগ্রগতিকে রুদ্ধ করে দিয়েছিল, তার প্রকৃতি অনুধাবন করা কষ্টকর এবং অতিরঞ্জিত করা অসম্ভব।’ সৈয়দ আমীর আলীর মতে, ‘বাগদাদ আক্রমণে যে ধ্বংসলীলা অনুষ্ঠিত হয় তা থেকে অন্যান্য শহরে কী ঘটেছিল তার আভাস পাওয়া যায়। তিনদিন ধরে শহরের পথে রক্তের স্রোত প্রবাহিত হয়েছিল এবং তাইগ্রিস নদীর পানি মাইলের পর মাইল রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল। (উদ্ধৃতি: দৈনিক সংগ্রাম, ৩১ ডিসেম্বর ২০১১)
বাংলাদেশে পর্তুগিজ ও মগদের প্রলয়কাণ্ড :
দেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক পাঠ্যপুস্তকে পর্তুগিজ বণিক ভাস্কো দা গামাকে ‘নায়ক’ হিসেবে উপস্থাপন করছে। অথচ সে ছিলো একজন ডাকাত, খুনি, খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক ও জলদস্যু। ভারতীয় ঐতিহাসিক সুরজিৎ দাশগুপ্ত বলেন, ‘ভাস্কো দা গামার নেতৃত্বে পর্তুগিজ বাহিনী ভারতবর্ষে অশান্তির হাওয়া বয়ে আনে। পর্তুগিজরা ক্যাথলিক খ্রিস্টান।… কালিকটে পৌঁছে গামা রাজ্যের সমস্ত মুসলিমের বহিষ্কার দাবি করেন। স্বভাবতই এ রকম অদ্ভুত দাবির কাছে জামেরিন (কালিকটের রাজা) নতি স্বীকার করেননি। ফলে গামার হিংস্র আক্রোশ এসে পড়ল কালিকটের ওপর, জাহাজ থেকে তিনি সারাদিন গোলাবর্ষণ করে শহরের যতখানি ক্ষতি করা সম্ভব করে চলে গেলেন। যাওয়ার পথে তিনি দেখলেন আরব সওদাগরদের দু’টি বাণিজ্য জাহাজ।
ছবি: জলদস্যু, নরপিশাচ, খুনি, সাম্প্রদায়িক ভাস্কো দা গামা
প্রথমে গামা জাহাজ দু’টি লুট করলেন, তারপর তার সৈন্যদের জাহাজের সকল নাবিকদের হাত, কান ও নাক কেটে ফেলার নির্দেশ প্রদান করলেন। তাদের সংখ্যা ছিলো প্রায় ৮০০। অতপর তাদেরকে শক্ত রশি দিয়ে বেঁধে মাড়ি থেকে দাঁত তুলে ফেলা হলো। শেষে তাদেরকে জাহাজসহ পুড়িয়ে দেয়া হলো।’ (সুরজিৎ দাশগুপ্ত: ভারতবর্ষ ও ইসলাম, পৃ ১৩৩-১৩৫) কালিকটের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও পরবর্তীতে পর্তুগিজরা দস্যুবৃত্তি করে। তাদের সাথে যোগ দেয় আরাকানি বৌদ্ধ মগরা। তাদের নৃশংস অবিচার প্রসঙ্গে শামসুদ্দিন তালিশ লিখেছেন, ‘আকবরের সময় থেকে শায়েস্তা খানের চট্টগ্রাম বিজয়কাল পর্যন্ত আরাকানের মগরা ও পর্তুগিজ জলদস্যুরা (পূর্ব) বাংলা লুণ্ঠন করত। তারা হিন্দু-মুসলিম স্ত্রী-পুরুষ ছোটো বড় সকলকেই বন্দি করে তাদের হাতের পাতা ছিদ্র করে তন্মধ্যে সরু বেত প্রবেশ করিয়ে বাঁধত এবং একজনের উপর আর একজনকে চাপিয়ে জাহাজের পাটাতনের নিম্নে ফেলে রাখত। লোকে যেমন পাখীকে আহার দেয়, সেরূপ তারা প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় উপর হতে বন্দিদের আহারের নিমিত্ত চাউল ছড়িয়ে দিত। মগেরা বহুকাল ধরে দস্যুতা করার ফলে তাদের দেশ শ্রীসম্পন্ন হয়েছে ও তারা সংখ্যায় বেড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রমেই জনশূণ্য হয়েছে এবং দস্যুদিগকে বাধা দিবার শক্তিও কমে আসতেছে।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে এই দুস্যদের যাতায়াতের পথে বাকলা অঞ্চল এবং বাঙালার অন্যান্য অংশ পূর্বে শস্যশালী এবং গৃহস্থের পল্লী দ্বারা পরিপূর্ণ ছিলো। প্রতিবর্ষে এই প্রদেশ হতে বহু পরিমাণ সুপারির কর আদায় হয়ে রাজকোষ পূর্ণ করত। কিন্তু এই দুস্যদল লুণ্ঠন ও নরনারী হরণ করে এই প্রদেশে অবস্থা এমন করে ফেলেছে যে, তথাও একখানিও বসতবাটি নাই অথবা একটি প্রদীপ জ¦ালাবার লোকও নাই।’ (জে এন সরকার: স্টাডিজ ইন মুঘল ইন্ডিয়া ও মধ্যযুগের বাঙলা; উদ্বৃতি: আবদুল মওদুদ: মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর, পৃ ৩১)
চলবে …