শাহরিয়ার মাসুম
হেমন্তের সোনালি ডানায় ভর করে হিমের কাঁথা গায়ে নামে শীত। শীতের আগমনে জড়সড় হয়ে যায় পৃথিবী। প্রকৃতি টেনে দেয় কুয়াশার চাদর। সবুজ দুর্বা ঘাস শিশিরের অলঙ্কারে সেজেগুজে স্বাগত জানায় হিমেল ভোরকে। চাদর পরা প্রকৃতির রূপ দেখে লাজুক বনে যায় ডানপিটে রোদ। দূর থেকে উঁকি-ঝুঁকি মারে। একটা সময় পর রোদের বখাটেপনায় চাদর সরিয়ে মুখ বের করে মুচকি হাসে প্রকৃতি। ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার নিজ কাজে।
অন্যরা তখন কী করে? আড়মোড়া দিয়ে ঘরের দাওয়ায় বসে দ’ায়ে ধার দিতে থাকেন গাছি বা শিউলিরা। মরসুম তাদের এসে গেছে। খেজুর গাছ কেটে মাটির হাড়িতে নামাবেন শীতল রস। সেই রসে গিন্নীরা তৈরি করবেন নানা রকম পিঠা পায়েস। খেজুর গুড়ের মিষ্টি ঘ্রাণে জেগে উঠবে গ্রাম। ডানপিটের দল বাঁশের খিলানের সামনে মুখ পেতে রস খাওয়ার প্রহর গুণতে শুরু করে। যদিও এখন দেশের জনপদে গাছিদের সংখ্যা কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। কমে গেছে খেজুর গাছেরও সংখ্যা। শীতেরও তীব্রতা কমেছে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায়। হাড়কাঁপানো শীতের দেখা খুব কমই পাওয়া যায়। গ্রামীণ সড়ক উন্নয়নে এবং ইটের ভাটায় অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিতে দিতে খেুজর গাছ এখন বিপন্নপ্রায়।
পিঁপড়াদের তল্লাটে শীতের আগমনে বাড়ে কাজের তৎপরতা। সঞ্চিত খাবার নিয়ে আত্মগোপনে চলে যায়। রাজ্যের অলসতা ভর করে ব্যাঙদের উপর। পুরোটা শীতকাল ঘুমিয়ে কাটায়। ইংরেজিতে যাকে বলে হাইবারনেশন। প্রকৃতির কুয়াশার চাদরে আবৃত হওয়াকে সহজভাবে নিতে পারে না সবুজ পাতারা। অভিমানে লালচে বর্ণ ধারণ করে। অভিমান গাঢ়ো হতে হতে একদিন তারা বিদায় জানিয়ে বসে বৃক্ষকে। ঝরে পরে নীরবে মাটিতে। শীত আনে পাতা ঝরার দিন। শীতের রাজত্ব বাংলাদেশে চলে পৌষ ও মাঘ মাস ধরে।
ঢেউ খেলে যায় হলদে সাগরে
রাস্তার দুধারের বিস্তীর্ণ মাঠ ছেয়ে যায় হলদে সাগরে। যতদুর চোখ যায় শুধুই হলুদ রঙা ফুল। পাতা ঝরা আর্তনাদের মধ্যেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে সাগর তৈরি করে সরিষা ফুল। হলদে ফুলের প্রেমে পড়ে দলে দলে ছুটে আসে মৌমাছিরা। ফুল থেকে মধু নেয় শুড় দিয়ে টেনে। বিনিময়ে এক ফুল থেকে অন্য ফুলে পৌঁছে দেয় রেণুর চিঠি। পরাগায়ণ প্রেমের উষ্ণতায় মেতে ওঠে সরিষা ক্ষেত। সকালে শিশিরের মুক্তো দানায় সেজে বসে থাকে হলদে ফুল। ঝলমলে রোদ এসে শিশিরের নাকফুলে দ্যূতি ছড়ায়। সৌন্দর্যপ্রেমীরা এসে দাঁড়ান ক্ষেতের পাশে। বুক ভরে নিশ্বাস নেন। অবারিত হলুদের মাঝে সীমিত চাহিদার অর্থনীতি খুঁজে পান শস্যের শিল্পীরা। হলদে ফুলের পরাগায়ণে প্রসব হবে তার কিছু স্বপ্ন। ছোট ছোট চাহিদা মেটানোর সুখ।
ফুলে ফলে ঢলে ঢলে
হলুদ গাঁদার ফুল রাঙা পলাশ ফুল
এনে দে এনে দে নইলে বাঁধব না বাঁধব না চুল
যদি না ফোটে গাঁদা ফুল বাঁধা হবে না মাথার চুল। পল্লীবধূর এই অভিমান ভোলাতেই শীতের বুড়ি নিয়ে আসে হলুদ গাঁদার ফুল। গাঁদা ফুলের ফুটন্ত সৌন্দর্যে হিংসায় জ্বলে যায় ডালিয়া। পাল্লা দিয়ে নানান রঙে পাপড়ি মেলে ধরে। লাল, সাদা, হলুদ, গোলাপি ও বেগুণী রঙে মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেয় চারদিকে। চন্দ্রমল্লিকাও ফোটে নিজস্ব রূপে। কৃষ্ণকলিও পাপড়ি দোলায় আপন ঢঙে। গ্যাজানিয়া, অ্যাস্টার, সিলিভিয়া ও কসমসসহ বেশ কিছু বিদেশি ফুলেরও আবির্ভাব ঘটে শীত ঋতুতে। শীতের দাপটে কাবু হয়ে সূর্যের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে রোদ পোহায় সূর্যমুখি ফুল।ফুলকাননে রূপের এমন ছটায় ফলরা কি আর বসে থাকতে পারে? রসালো ঠোঁট নিয়ে শীতের ফলের রাজত্ব দখল করে নেয় কমলা। উত্তরের হিমালয়ের বরফ শীতল নিঃশ্বাসের ছোঁয়ায় ক¤পমান শরীরে উষ্ণতা ছড়াতে কমলার জুড়ি নেই। পাহাড়ের অর্থনীতি দারুণভাবে চাঙা হয় কমলার ঠোঁটের উষ্ণ চুম্বনে। আমলকি, তেঁতুল, জলপাই ও টক-মিষ্টি বরই বাড়ায় মুখের রুচি।
পাখিরা হয় দেশান্তরি
অবারিত সবুজের এই দেশে শীত নিয়ে আসে পাতা ঝরার দিন। হিমালয়, সাইবেরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া ও ফিনল্যান্ডের মতো শীতপ্রধান দেশে আসে পালক ঝরার দিন। পাখির গায়ের পালক ঝরে ঝরে পড়ে শীতের প্রকোপে। ঝরা পালকের দিকে তাকিয়ে বরফের নিঃশ্বাস ছাড়ে পাখিদের দল। খাদ্য ও আশ্রয় সঙ্কটে পড়ে হতাশার দিন গোনে এসব অঞ্চলের পাখিরা। দলবেধে সিদ্ধান্ত নেয় দেশান্তরি হওয়ার। এরপর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়াল দেয় আকাশে। পালকবিহীন ডানা মেলে। নাতিশীতোষ্ণ দেশ হিসেবে প্রথম পছন্দ বাংলাদেশ। হিমালয়ের ওপাশ থেকেই বেশিরভাগ পাখির আগমন ঘটে। হিমালয় ঘেষা তিব্বতের লাদাখ থেকে সেন্ট্রাল এশিয়ান ইন্ডিয়ান ফ্লাইওয়ে দিয়ে প্রবেশ করে।
শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে আমাদের দেশে অতিথি হয়ে আসে যেসব পাখিÑডেলা ঘেনজি, সোনাজঙ্গ, খুরুলে, বনহুর, মানিকজোড়, চিনাহাঁস, পিয়াংচিনা, রাজহাঁস, বালিহাঁস, প্রোভায়, নাইরাল ল্যাঙ্গি, গ্রাসওয়ার, নাইবাল, হারিয়াল, ভোলাপাখি, চখাচখি, বুরলিহাস, বারহেড, নারুদ্দি, সিরিয়া পাতিরা, কবালি, যেনজি, গেন্ডাভার ও গাংকবুতর তাদের মধ্যে অন্যতম। এসবের অনেক পাখি বাংলাদেশে পুরো শীতকাল কাটিয়ে দেয়। উষ্ণতা পেয়ে ধীরে ধীরে পালক গজাতে শুরু করে। বাংলাদেশের শীতের অতিথি পাখি দেখা যায় এমন একটি উল্লেখযোগ্য স্থানের নাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১৭টি লেকের মধ্যে ২০-২৫ প্রজাতির অতিথি পাখি আসে। দুই ধরনের পাখি এখানে দেখা যায়। এক ধরনের পাখি ডাঙ্গায় ও আরেক ধরনের পাখি বিশ্রাম নেয় পানিতে। এদের বেশির ভাগই হাঁস জাতীয় পাখি।
শীতের এই মেহমানদের আগমন ঘটে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে। তবে নভেম্বর-ডিসেম্বরে সবচেয়ে বেশি পাখি আসে। মার্চ-এপ্রিলে যখন শীতপ্রধান দেশের বরফ গলতে শুরু করে, কিছু কিছু গাছপালা জন্মায়, তখন পরিযায়ী পাখিদের ফেরার সময় হয়। কিন্তু সব পাখি কি ফিরতে পারে তার নীড়ে? কিছু পাখি শিকার হয় লোভের। হৃদয়হীন পাখি শিকারিদের হাতে পড়ে আড়ালে আবডালে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে যায়।
পাহাড় ডাকে আয় সাগর ডাকে আয়
শীতের জড়সড় পৃথিবীতে পাহাড় যেন চঞ্চল হয়ে ওঠে। মৃদু হাসির রেখা তার সবুজ ঠোঁটে। অনবরত ডেকে যায় এই তো সময় শ্রেষ্ঠ।আয় ছুটে আয় আমার বুকে, তন্বী নদীর বহতা সুখে। ডাকে আরো সমুদ্রের নীল জলরাশি। নির্জীব গর্জনে যেন বলেÑকোলাহল ছেড়ে কিছুটা নির্জনতা পেতে চলে এসো সমুদ্র স্নানে। শীত এলেই মানুষের ভ্রমণ পিপাসা বেড়ে যায় বহুগুণে। চমৎকার আবহাওয়া, কর্মক্ষেত্রে অবকাশ সুযোগ সব মিলিয়ে শীতই ভ্রমণের জন্য উপযোগী ঋতু। শীতকে কেন্দ্র করে প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরে পায় পর্যটনকেন্দ্রগুলো। জেগে ওঠে ইকোট্যুরিজম। দলে দলে মানুষ ছুটে যায় পাহাড়ে, সাগরে ও অরণ্যে। সামর্থ্যবানরা অতিক্রম করেন দেশের সীমানা। দেশের ভেতরে ভ্রমণের জন্য প্রথম পছন্দ থাকে খাগড়াছড়ির সাজেক, আলুটিলা সুড়ঙ্গ, রাঙামাটির কাপ্তাই লেক, সুভলং ঝর্ণা, বান্দরবানের নীলাচল, চিম্বুক, দেবতার খুম, নাফাখুম, সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার ও কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। পাশাপাশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে নিঝুম দ্বীপ, চর কুকুরিমুকরির মতো সংরক্ষিত বনাঞ্চল।
পিঠা খেতে বসি খুশিতে বিষম খেয়ে
পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসি খুশিতে বিষম খেয়ে
আরো উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে।
পল্লী মায়ের কোল কবিতায় কবি সুফিয়া কামাল এভাবে ছবি এঁকেছেন শীতের। শব্দের তুলিতে। শীতের সকালে চুলার চারপাশে মাকে ঘিরে বসে নতুন চালের পিঠা খেতে গেয়ে বিষম খাওয়া খুব মামুলি বিষয়। অতঃপর মায়ের বকুনি খাওয়া যেন আরো মামুলি চিত্র। শীতের প্রধান উপকরণই যেন পিঠা। কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ধোঁয়া ওঠা ভাপা পিঠা শীতকে করে তোলে উপভোগ্য। খেুজুর রসে তৈরি হয় নানান রকম পৌষালি পঠা। অঞ্চলভেদে পিঠার ধরণ বিভিন্নরকম হয়ে থাকে। বরিশালে খেজুর রসে ভিজানো চিতই পিঠার কদর সবচেয়ে বেশি। রস দিয়ে তৈরি আরেকটি মজার পিঠা হলো হাত সেমাই পিঠা। আঞ্চলিক ভাষায় যাকে বলে চিতই পিঠা। পাশাপাশি বানানো হয় পাটিসাপটা, ধুপি পিঠা, পুলি ও ছিটা পিঠা ইত্যাদি।
কাব্যকথায় গল্পগাঁথায় হিমের কাঁথা
হিমালয় কন্যার বরফের নিঃশ্বাস যখন ভারী হয়ে ওঠে তখন প্রাণ হয় থরথর ক¤পমান। উষ্ণতার খোঁজে শরীর তখন গরম কম্বলে কুণ্ডলী পাকায়। আশ্রয় খোঁজে কুয়াশাঢাকা ভোরে ধূমায়িত চায়ের কাপে। কিন্তু যার নেই আশ্রয়, কুণ্ডলী পাকানো উষ্ণতা, তার জন্য কি শীত আনন্দ নিয়ে আসে? রাস্তারধারের উলঙ্গ ছেলেটাকে নিয়ে তখন ভাবতে বসেন শ্রেণি সংগ্রামের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। বস্ত্রহীন ছেলেটার উষ্ণতার একমাত্র মাধ্যম হলো সূর্য। তাই তো কবি সূর্যের প্রতি প্রার্থী কবিতায় লিখেছেন
হে সূর্য-
তুমি আমাদের স্যাঁতসেঁতে ভিজে ঘরে
উত্তাপ আর আলো দিও
আর উত্তাপ দিও
রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে।
পল্লীকবি জসিম উদ্দিন শীতের নিসর্গ এঁকেছেন তার রাখাল ছেলে কবিতায়। ভোরের মিঠেল হাওয়া, শিশির ঝরা ঘাসের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন শব্দের কোমল তুলিতে। কবি লিখেছেন-
ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির-ঝরা ঘাসে
সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে।
আমার সাথে করত খেলা প্রভাত হাওয়া, ভাই,
সরষে ফুলের পাঁপড়ি নাড়ি ডাকছে মোরে তাই।
চলতে পথে মটরশুঁটি জড়িয়ে দুখান পা,
বলছে ডেকে গায়ের রাখাল একটু খেলে যা।
কবি জীবনানন্দ দাসের মতো বোধকরি শীতকে কেউ এতটা ঘনিষ্ঠভাবে অনুভব করেননি। রুপসী বাংলার কবি তার শীতরাত কবিতায় লিখেছেন এইসব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;/ বাইরে হয়ত শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা।
শীতরাতের হিম-প্রখরতা যেন তার ভাবনায় একাকার হয়ে আছে। তিনি লিখেছেন, এসব কবিতা আমি যখন লিখেছি বসে নিজ মনে একা;/ চালতার পাতা থেকে টুপ টুপ জ্যোৎস্নায় ঝরেছে শিশির;/ কুয়াশায় স্থির হয়ে ছিল ধানসিঁড়ি নদীটির তীর;
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, শীতের হাওয়া হঠাৎ ছুটে এলো/ গানের হাওয়া শেষ না হতে/ মনের কথা ছড়িয়ে এলোমেলো / ভাসিয়ে দিল শুকনো পাতার স্রোতে।
আল মাহমুদ লিখেছেন: ‘কখনো ভোরের রোদে শিশিরের রেণু মেখে পায়/ সে পুরুষ হেঁটে যায় কুয়াশায় দেহ যায় ঢেকে’। আবদুল মান্নান সৈয়দ লিখেছেন: ‘শীতের ঢেউ নামি আসবে ফের/ আমার বুড়ো হাড়ে ঝনাৎকার’। মহাদেব সাহা বলেছেন: ‘শীতের সেবায় তবে সেরে উঠি’। কবি আবিদ আজাদ বলেছেন: ‘সব মরবে এবার শীতে/ কেবল আমার ফুসফুসের পাতাঝরার শব্দ ছাড়া’। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ লিখেছেন: ‘আমিও সারারাত মৃত মানুষের শীদে শীতার্দ্র হয়েছিলাম।’
কবি নজরুলের শীত-বন্দনায়। শীতের সিন্ধু কবিতায় লিখেছেন তিনি:
‘ওগো মোর লীলা সাথী অতীত বরষার। / আজিকে শীতের রাতে নব অভিসার।
শীতের সকালে হিম হিম ভাব কাটাতে চা’য়ের বিকল্প নেই। চা পান করতে করতে উষ্ণতার স্বাদ নিয়ে আমরা কী কী করতে পারি তার একটি ফিরিস্তি দিয়েছেন বরিশালের কবি নয়ন আহমেদ। তিনি লিখেছেন,
হ্যাঁ, চা পান করতে করতে
আমরা এককাপ অপত্যস্নেহের ভেতর ডুবতে পারি।
হ্যাঁ, চা পান করতে করতে
আমরা এককাপ রৌদ্রের কথা ভাবতে পারি।