আযাদ আলাউদ্দীন
বর্তমান সময়ে সারাদেশে মিডিয়ার যেন জয়জয়কার। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে বেড়েছে মিডিয়া কর্মীর সংখ্যাও। রীতিমত এটি এখন ক্রেজি ও প্রতিযোগিতার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব মিডিয়ার সংবাদকর্মীরা দাবি করেন- তারা দেশ ও সমাজের উন্নয়নের জন্য কাজ করেন। তবে প্রত্যেক সংবাদকর্মী কি তা যথার্থভাবে করতে পারছেন ? সংবাদকর্মীরা তাদের গণমাধ্যমে সমাজের নানা সমস্যা, অসঙ্গতি, অন্যায়- দুর্নীতি আর অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে এগুলো প্রতিকারের জন্য ভূমিকা রাখছেন। কিন্তু তাদের নিজেদের ভেতরকার নানা অসঙ্গতি তুলে ধরবেন কে ? একবার আমার এক বন্ধু বললেন, ‘তোমরা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের ভালো-মন্দ সব খবর সমাজের সামনে তুলে ধরছ, কিন্তু তোমাদের ভেতরকার খবর তুলে ধরার তো কেউ নেই, যার কারণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তোমরা স্বেচ্ছাচারী হয়ে যাচ্ছ’। তীর্যক এই মন্তব্যটি নিয়ে ভাবতে পারেন মিডিয়া কর্মীরা। ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার বাজারে ‘সংবাদ’ নামক পণ্যটি নিয়ে এখন রীতিমত প্রতিযোগিতা চলছে। কার আগে কে সংবাদ সরবরাহ করবেন এ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটান সবাই। একটি টেলিভিশন চ্যানেলের । অভ্যন্তরীণ শ্লোগান- ‘সবার আগে সব খবর’। কিন্তু আমি যে চ্যানেলটিতে কাজ করেছি সেটির ট্রেনিংয়ে আমাদের শেখানো হয়েছে ‘সবার আগে সঠিক খবর’। এই যে খবরটি প্রচারের আগে ‘সঠিক’ বিষয়টি যাচাই করে নেয়া, কিংবা সাংবাদিকতার পরিভাষার ‘ক্রস চেক’ করে নেয়ার বিষয়টি আমরা প্রত্যেক সাংবাদিক যথার্থভাবে করছি কি ?
কয়েক বছর আগে বরিশাল অঞ্চলে দুটি খবরের উদাহরণ উপস্থাপন করছি। ২০০৯ সালের গত ২৪ মার্চ ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার রামকেশব গ্রামে ‘গ্রিণ ক্রিসেন্ট’ নামের একটি এনজিওর কমপ্লেক্সে থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে র্যাব। মিডিয়ার কল্যাণে এ খবরটি সবার জানা। আমি ওই সংবাদটি কভার করার জন্য আমার তৎকালীন ক্যামেরাম্যান জসিম উদ্দিন সহ ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। সেখানে থেকে আমার টেলিভিশনে ফোনো লাইভ নিউজ এবং প্যাকেজ নিউজ করেছিলাম কয়েকবার। কিন্তু সেখানে আমি কোনো ধরনের মাদ্রাসাই দেখলাম না। অথচ প্রায় সবগুলো প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় সেদিন গ্রিন ক্রিসেন্ট এনজিওটিকে মাদ্রাসা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কেউ কেউ তাদের লিড নিউজে লিখেছেন – ‘ভোলার মাদ্রাসায় জঙ্গি ঘাঁটি’। এসব অসত্য শিরোনামের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ ও আলেম সমাজের ভাবমর্যাদা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় ? আমরা একবারও কি এ কথা ভেবেছি?
আমাদের কিছু কিছু সংবাদকর্মীর ধর্মবিরোধী মানসিকতা দেখে আমি হতাশ হই। মুসলিম পরিবারের সন্তান হয়েও তারা কেন যেন ইসলাম, মুসলমান, আলেম-ওলামা ও হুজুরদের বিরুদ্ধে সংবাদ লিখে ভিন্নরকম তৃপ্তি পান, নিজেকে উদারপন্থী ও তথাকথিত প্রগতিশীল ভাবেন। কোনো কলেজ ছাত্র কর্র্তৃক ধর্ষনের ঘটনা ঘটলে সেই খবরটি ছাপা হয় এক কলামে পত্রিকার কোনো এক কর্নারে। আর একই ঘটনা কোনো মাদ্রাসা ছাত্র ঘটালে সেটি ন্যূনতম ডাবল কলাম, কালো কালিতে রির্ভাস ব্লক, আর প্রথম পাতায়—।
মজার আর একটি বিষয় হচ্ছে- আলেম ওলামা কিংবা হুজুরদের বিরুদ্ধে যারা এরুপ অহর্নিষ বিষোদগার করেন, তাদেরই কোনো পারিবারিক কিংবা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হুজুরদের ডাকা হয় খুব সম্মানের সাথে। তাদের কোনো স্বজন মারা গেলে বলা হয়- হুজুর জানাজা পড়ান। আবার ওই সাংবাদিক মারা গেলে তার জানাজাও পড়াবেন কোনো না কোনো মাদ্রাসা পড়ুয়া হুজুর। অতএব মাদরাসা পড়ুয়াদের প্রতি আমাদের এই অহেতুক বিদ্বেষ কেন?
আমি বলতে চাইছিনা যে, হুজুররা অন্যায় করলে নিউজ হবে না, নিউজ অবশ্যই হবে। তবে তা যেন আমাদের মনের বিদ্বেষপ্রসূত না হয়। কারন তারাতো আমাদের দেশেরই নাগরিক। কয়েক বছর আগে বরিশাল নগরীতে কয়েকটি বিদেশি সংস্থায় চিঠি পাঠিয়ে হুমকি দিয়েছে একটি উগ্রবাদী সংগঠন। ইংরেজিতে লেখা ওই উড়ো চিঠির কোনো কপি সাংবাদিকদের হাতে না পৌঁছলেও প্রশাসনের বরাত দিয়ে সংবাদটি কয়েকটি মিডিয়ায় পরিবেশন করা হয়েছে।। আমার মনে হয় এরুপ স্পর্শকাতর সংবাদগুলো পরিবেশনের ক্ষেত্রে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংবাদকর্মীদের আরো দায়িত্বশীল ও যত্নশীল হওয়া উচিত। কারণ এসব সংবাদের সাথে বহি:র্বিশ্বে দেশ ও জাতির ভাব মর্যাদা জড়িত। সেটি আদৌ উগ্রবাদীদের চিঠি ছিলো কিনা সে বিষয়ে পুলিশ প্রশাসন যেখানে সন্দিহান এবং তদন্তাধীন। সেখানে এরুপ খবর ফলাও করে প্রচারের বিষয়টি কতটা যুক্তিযুক্ত। এক্ষেত্রে শুধু সাংবাদিকদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, সংশ্লিষ্ট দপ্তর, প্রশাসন ও আইন শৃংখলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের প্রেস ব্রিফিং কিংবা সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার ক্ষেত্রে আরো সংবেদনশীল এবং কৌশলী হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
আমার বিশ্বাস দেশের প্রত্যেক মিডিয়া ও মিডিয়া কর্মীর দেশপ্রেমে কোন ঘাটতি নেই। তবে তাড়াহুড়া কিংবা অসর্তকতার কারণে প্রায়ই কিছু কিছু সংবাদ আমাদের দেশপ্রেমকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এক্ষেত্রে ‘জাতির জাগ্রত বিবেক’র যে বিশেষণ সাংবাদিকদের জন্য প্রয়োগ করা হচ্ছে তা যেন সত্যে পরিণত হয়, এ প্রত্যাশাই করছি অবিরাম। ##