আল হাফিজ ।।
১৯৭১ সালে একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘটলেও এর গোড়াপত্তন হয়েছিল অনেক আগেই। বৃটিশ ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তান সৃষ্টি হলে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর যে অবিচার শুরু হয়- বাঙালি জাতি তা মেনে নিতে পারেনি। ভাষার ওপর যখন আঘাত আসে তখন রুখে দাঁড়ায় বাঙালি জাতি। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যে বীজ রোপিত হয় তারই ধারাবাহিকতায় শুরু হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধে এদেশের মানুষের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ বিশ্ব ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
বাংলাদেশের গণমানুষের সমর্থন ও সক্রিয় অংশগ্রহণে অর্জিত মুক্তিযুদ্ধ এক মহিমান্বিত ও গৌরবময় সোনালি অধ্যায়। বাঙালি জাতির শৌর্য-বীর্য, লড়াই-সংগ্রাম ও আত্মপরিচয় তুলে ধরার পরিচায়ক এই মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাসের ঘটনাবলি ও লাল-সবুজ পতাকার এ বিজয় ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে আমাদের জাতীয় জীবনে। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে এসেও দেখতে হয়- সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায় বিচার ও মতপ্রকাশের মুক্তচেতনা আজ ভূলুন্ঠিত।
মুক্তিযোদ্ধাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বলা হলেও তাঁরা প্রাপ্য মর্যাদা আজও পাননি। বরং এক শ্রেণির সুবিধাভোগী মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটছে। বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছিল গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে- স্বাধীনতার পর সেই গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করার সুযোগ থকলো না সাধারণ মানুষের। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ক্ষমতার লিপ্সা বাংলাদেশের রাজনীতিকে এমন ভাবে কলুষিত করেছে যে, সাধারণ মানুষ রাজনীতির সাইড লাইনে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোনো প্রতিচ্ছবি দেখা যায় না- নাগরিক অধিকার রক্ষায়, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চায় কিংবা শাসনব্যবস্থার নিয়মতান্ত্রিক পালাবদলের মধ্যে।
এসব নানাবিধ কারণেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাভ করতে ব্যর্থ হচ্ছে বারবার। ফলে অশান্তি, অকল্যাণ আর দ্বন্দ্ব-সংঘাত সীমা অতিক্রম করে চলছে ক্রমাগত। উন্নতির পথে অগ্রসর হতে পারছে না দেশ ও জাতি। দিশেহারা হয়ে পড়ছে মানবসমাজ। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের এই পরিস্থিতিতে মুখ বুজে চুপচাপ বসে থাকতে পারেননি একেএম শামসুদ্দিন। তিনি সরব হয়েছেন চিন্তা-গবেষণায় এবং লিখেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধ: ব্যক্তিস্বার্থের হাতিয়ার ছিল না’ শীর্ষকগ্রন্থটি। বইটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক হলেও একটু ভিন্ন ঘরানার ভিন্ন স্বাদের। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৩-এ সৃজন কর্তৃক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে। এ গ্রন্থের সুন্দর ও মার্জিত প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী দেওয়ান আতিকুর রহমান। ১৬০ পৃষ্ঠার অফসেট কাগজে ছাপা গ্রন্থটির মূল্য মাত্র ৪০০ টাকা।
একেএম শামসুদ্দিন রচিত ‘মুক্তিযুদ্ধ: ব্যক্তিস্বার্থের হাতিয়ার ছিল না’ গ্রন্থে সূচিবদ্ধ হয়েছে ২৪টি নিবন্ধ। এ নিবন্ধগুলোর শিরোনামও পাঠকদের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম, যেমন- ‘শত ষড়যন্ত্রও ঠেকাতে পারেনি স্বাধীনতা’, ‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়ার প্রহসনমূলক বৈঠক’, ‘শহিদ শংকু সমজদার জাতির এক শ্রেষ্ঠ সন্তান’, ‘মুক্তিযুদ্ধের এক বিস্মৃত বীর শাহেদ আলী কসাই’, ‘বাঙালি ইপিআর সদস্যদের কুঠিবাড়ি বিদ্রোহ’, ‘রংপুর সেনানিবাস ঘেরাও ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা’, ‘ওরা কেউ ফিরে আসেনি’, ‘ভয়াল ১৩ জুনের গোলাহাট গণহত্যা’, ‘জগতজ্যোতি ইতিহাসের বিস্মৃত এক মুক্তিযোদ্ধা’, ‘মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় জর্জৃ বাহিনী’, ‘যে বীরের মৃত্যু নেই’, ‘যুদ্ধের চুড়ান্ত পর্বে মুক্তিযোদ্ধাদের অবিস্মরণীয় ভ‚মিকা’, ‘অপারেশন কিলো ফ্লাইট সামরিক ইতিহাসের বিরল ঘটনা’, ‘আমার দেখা ডিসেম্বর ১৯৭১’, ‘মুক্তিযুদ্ধে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির অবদান কে মনে রাখে’, ‘একজন মুশতারী শফী’, ‘বড় অভিমান নিয়ে চলে গেলেন তারামন বিবি’, ‘অনেকেই জানে না যে ইতিহাস’, ‘মুক্তিযুদ্ধ কোনো ব্যক্তিস্বার্থের হাতিয়ার ছিল না’, ‘ভুলের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে’, ‘প্রজন্মের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের সত্য ও সুন্দর’, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এমন মন্তব্য অনভিপ্রেত’, ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয় নিয়ে পাকিস্তানী সামরিক কর্মকর্তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়নি’ এবং ‘এত রক্ত কেন? মুক্তিযুদ্ধের একটি প্রামাণ্য দলিল’।
বিশিষ্ট গবেষক একেএম শামসুদ্দিন মনে করেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠির মধ্য থেকে মুক্তিযুদ্ধে যে বিশেষ অবদান রাখা হয়েছে তা যথাযথ ভাবে আলোচনায় উঠে আসেনি। সে রকম অনেক ঘটনা তিনি এ গ্রন্থে আলোচনা করেছেন একনিষ্ঠ ভাবে। যা এ গ্রন্থটিকে আলাদা বৈশিষ্ট্যে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে বলে মনে হয়। তাছাড়া রাজনৈতিক ফায়দা হাছিলের জন্য এই জনযুদ্ধকে একটি মহল সংকীর্ণ করে তুলেছে। যার কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্ম হয়নি এমন লোককেও মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট পেতে দেখা যায়। আবার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেও অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার গালি শুনতে হয়।
লেখক একেএম শামসুদ্দিন ‘মুক্তিযুদ্ধ: ব্যক্তিস্বার্থের হাতিয়ার ছিল না’ গ্রন্থে এ সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেই সঙ্গে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা সত্য ঘটনা। গবেষক গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে এসব অনিয়মের কারণে জাতি কী ধরণের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কীভাবে গ্রহণ করবে সে বিষয়গুলোও বিশ্লেষণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অনেক লেখা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এ গ্রন্থে আলোচিত বিষয়গুলো ইতোপূর্বে খুব একটা আলোচিত হয়েছে বলে মনে হয় না। আমরা মনে করি, এ বিষয়গুলো নিয়ে বেশি বেশি লেখালেখি হওয়া উচিৎ।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দুঃসাহসিক ঘটনাগুলো নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা হওয়া দরকার। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গর্বিত হতে পারবে এবং তারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশমাতৃকার কাজে আত্মনিয়োগ করতে গর্ববোধ করবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। ‘মুক্তিযুদ্ধ: ব্যক্তিস্বার্থের হাতিয়ার ছিল না’ শীর্ষক গ্রন্থের জন্য বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক একেএম শামসুদ্দিনকে আন্তরিক ধন্যবাদ। আশা করি এ গ্রন্থটি বোদ্ধা পাঠক, সমালোচক ও গবেষক মহলে সমাদৃত হবে। আমরা গ্রন্থটির বহুল প্রচার ও প্রসার কামনা করি।
আল হাফিজ, নির্বাহী সম্পাদক, মুক্তবুলি। সাতরং সিস্টেমস, উত্তর আলেকান্দা, বরিশাল। মোবাইল : ০১৯৩৭৬৭৪২৭১