রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ

মো. জিল্লুর রহমান ।।
‘বনলতা সেন’ কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম কবিতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। কবিতাটির রচয়িতা বিংশ শতাব্দীর আধুনিক বাঙালি কবি জীবনানন্দ দাশ। বনলতা সেন প্রধানত রোমান্টিক গীতি কবিতা এবং কবি জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসেবে সমাদৃত। রূপসী বাংলার সেই বিখ্যাত কবি জীবনানন্দ দাশের (পুরো নাম শ্রী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত) জন্ম ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯। তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক৷ তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম৷ জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী। মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং ১৯৯৯ সালে যখন তাঁর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল, ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কবিতে পরিণত হয়েছেন৷ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ১৮৯৯ কাজী নজরুল ইসলামের জন্মের কারণেও স্মরণযোগ্য। জীবনানন্দ দাশ পেয়েছিলেন ‘নির্জনতম কবি’, ‘শুদ্ধতম কবি’ খেতাব, নজরুল বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী কবি’ রূপে।
 
কবি জীবনানন্দ দাশ ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমানে বাংলাদেশ) অন্তর্গত বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন৷ তার পূর্বপুরুষগণ বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বিক্রমপুর (বর্তমান মুন্সীগঞ্জ) পরগণার কুমারভোগ নামক স্থানে ‘গাওপাড়া’ গ্রামের নিবাসী ছিলেন যা পদ্মায় বর্তমানে বিলীন হয়ে গেছে ৷ স্থানটি বর্তমানে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় অবস্থিত ৷ তার পিতামহ সর্বানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৩৮-৮৫) চাকরির সুবাদে বিক্রমপুর থেকে বরিশালে স্থানান্তরিত হন৷ সর্বানন্দ দাশগুপ্ত জন্মসূত্রে হিন্দু ছিলেন, তবে পরে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন ৷ তিনি বরিশালে ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেন এবং তার মানবহিতৈষী কাজের জন্যে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হন ৷ জীবনানন্দের পিতা সত্যানন্দ দাশগুপ্ত সর্বানন্দের দ্বিতীয় পুত্র৷ সত্যানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৬৩-১৯৪২) ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক এবং ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক৷
 
কবির আদি পিতৃপুরুষের নাম বলরাম দাশগুপ্ত । পিতামহ সর্বানন্দ দাশগুপ্ত বরিশালে কলেক্টরি দপ্তরে চাকরির সুবাদে সেখানেই স্থায়ী হন। পরিবারে তিনিই প্রথম সস্ত্রীক ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। সর্বানন্দ’র পুত্ররা প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯০৭ সালে বরিশালের বগুড়া রোডে প্রায় ছয় বিঘা জমির উপর নিজেদের বসত গড়ে তোলেন এবং পিতার নামানুসারে এর নাম দেন ‘সর্বানন্দভবন।’ জীবনানন্দের জন্মসাল ১৮৯৯, নিজের আটবছর বয়স থেকে এই বাড়িতেই বসবাস করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। অবশ্য ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের সময় পরিবারটি কলকাতায় চলে যায়। ১৯৬০ সালে জীবনানন্দ দাশের পিতামহের নামাঙ্কিত পারিবারিক বাড়িটি বিক্রি হয়ে যায়, জনৈক আবদুর রাজ্জাক এটি কিনে নেন; পরে কবির সম্মানে এর নামকরণ করা হয় ‘ধানসিড়ি’। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার আবদুর রাজ্জাকের পরিবারের কাছ থেকে কিছু জমি অধিগ্রহণ করে সেখানে ‘জীবনানন্দ স্মৃতি পাঠাগার’ স্থাপন করে।
 
কবির পিতা কম বয়সে স্কুলে ভর্তি হওয়ার বিরোধী ছিলেন, এজন্য বাড়িতে মায়ের কাছেই জীবনানন্দের বাল্যশিক্ষার সূত্রপাত৷ কবিকে ১৯০৮ সালের জানুয়ারিতে আট বছর বয়সে ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়৷ বিদ্যালয়ে থাকাকালীন তার বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচনার সূচনা হয়৷ এছাড়া সে সময়ে তার ছবি আঁকার দিকেও প্রবল ঝোঁক ছিল৷ ১৯১৫ সালে ব্রজমোহন বিদ্যালয় (বি. এম. স্কুল নামে সমধিক পরিচিত) থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং এর ঠিক দু‘বছর পর ব্রজমোহন কলেজ (বি. এম. কলেজ) থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় পূর্বের ফলাফলের পুনরাবৃত্তি ঘটান। অতঃপর ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন তখনকার কলকাতার নামকরা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স সহ বিএ ডিগ্রি লাভ করেন৷ ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এম. এ. ডিগ্রি লাভ করেন৷ ১৯২২ সালে কবি কলকাতার সিটি কলেজে টিউটর হিসেবে অধ্যাপনা শুরু করেন৷
 
বরিশালের বগুড়া রোডের পৈতৃক বাড়ি ধানসিঁড়িতে যে একান্নবর্তী পরিবারটিতে তার জন্ম-বেড়ে ওঠা, সেখানে শিল্পের জল-হাওয়া আসা-যাওয়া করার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। মা ছিলেন কবি, মাতামহও তাই। কবির মাতা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন গৃহিণী, কিন্তু তিনি কবিতা লিখতেন৷ তার সুপরিচিত কবিতা “আদর্শ ছেলে” (আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে) আজও শিশুশ্রেণির পাঠ্য৷ কবি তার মা কুসুমকুমারী দাশের প্রভাবেই ছেলেবেলায় পদ্য লিখতে শুরু করেন। কবি ছিলেন পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান; তার ডাকনাম ছিল মিলু৷ তার ভাই অশোকানন্দ দাশ ১৯০৮ সালে এবং বোন সুচরিতা দাশ ১৯১৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন৷ ১৯১৯ সালে কবির লেখা একটি কবিতা প্রকাশিত হয় এবং এটিই তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা। কবিতাটির নাম বর্ষা আবাহন। এটি ব্রহ্মবাদী পত্রিকার ১৩২৬ সনের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। তখন তিনি শ্রী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত নামে লিখতেন। ১৯২৭ সাল থেকে তিনি জীবনানন্দ দাশ নামে লিখতে শুরু করেন। ১৬ জুন ১৯২৫ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এর লোকান্তর হলে তিনি ‘দেশবন্ধুর প্রয়াণে’ শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলেন যা বংগবাণী পত্রিকার ১৩৩২ সনের শ্রাবণ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
১৯৩০ সালের ৯ মে কবি লাবণ্য দেবীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন৷ ঢাকা শহরে পুরান ঢাকায় সদরঘাটের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ব্রাহ্ম সমাজের রামমোহন লাইব্রেরিতে কবির বিয়ে হয়েছিলো। লাবণ্য গুপ্ত সে সময় ঢাকার ইডেন কলেজে লেখা-পড়া করছিলেন। জীবনানন্দ দাশের বিয়েতে কবি বুদ্ধদেব বসু, অজিতকুমার দত্ত প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। কবির দুই সন্তান -কন্যা মঞ্জুশ্রী দাশ এবং পুত্র সমরানন্দ দাশ। ১৯৩১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কবির প্রথম সন্তান মঞ্জুশ্রী এবং ১৯৩৬ সালের নভেম্বরে তার পুত্র সমরানন্দের জন্ম হয়। কন্যা মঞ্জুশ্রী দাশের জন্মের সময়েই ক্যাম্পে কবিতাটি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত পরিচয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং সাথে সাথে তা কলকাতার সাহিত্য সমাজে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হয়। যদিও কবিতাটির আপাত বিষয়বস্তু ছিল জোছনা রাতে হরিণ শিকার কিন্তু অনেকেই এই কবিতাটি পাঠ করে তা অশ্লীল হিসেবে চিহ্নিত করেন। প্রখ্যাত অভিনয় শিল্পী অপর্ণা সেন সম্পর্কে তার ভাগ্নি হন। অপর্ণা সেনের বাবা চলচ্চিত্র সমালোচক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা চিদানন্দ দাশগুপ্ত। তার মা সুপ্রিয়া দাশগুপ্ত সম্পর্কে খ্যাতনামা বাংলা কবি জীবনানন্দ দাশের ভাইয়ের মেয়ে। অপর্ণা সেনরা কবিকে ‘বিলু মামা’ বলে ডাকতেন। অপর্ণার বাবা-মা তাকে বংশের বড় বলে ‘বড় দা’ বলে ডাকতেন।
 
কবি অধিকাংশ সময় বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেছেন, যার মধ্যে আছে সিটি কলেজ, কলকাতা (১৯২২-১৯২৮), বাগেরহাট কলেজ, খুলনা (১৯২৯); রামযশ কলেজ, দিল্লী (১৯৩০-১৯৩১), ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল (১৯৩৫-১৯৪৮), খড়গপুর কলেজ (১৯৫১-১৯৫২), বড়িশা কলেজ (অধুনা ‘বিবেকানন্দ কলেজ’, কলকাতা) (১৯৫৩) এবং হাওড়া গার্লস কলেজ, কলকাতা (১৯৫৩-১৯৫৪)। তার কর্মজীবন আদৌ মসৃণ ছিল না এবং চাকরি তথা সুস্থির জীবিকার অভাব তাকে আমৃত্যু কষ্ট দিয়েছে। এজন্য তাদের দাম্পত্য জীবনও খুব সুখের ছিল না।
 
১৯৩৫ সালে কবি জীবন জীবিকার তাগিদে তার পুরনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্রজমোহন কলেজে ফিরে আসেন এবং ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন, যা তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল। তিনি সে সময় ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। সে সময়ে কলকাতায় বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং সমর সেন একটি আনকোরা নতুন কবিতা পত্রিকা বের করার তোড়জোড় করছিলেন, যার নাম দেয়া হয় কবিতা। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যাতেই জীবনানন্দের একটি কবিতা স্থান করে নেয়, যার নাম ছিল ‘মৃত্যুর আগে’। কবিতাটি পাঠ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুদ্ধদেবকে লেখা একটি চিঠিতে কবিতাটিকে ‘চিত্ররূপময়’ বলে মন্তব্য করেন। কবিতা পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যাতে (পৌষ ১৩৪২ সংখ্যা; ডিসে ১৯৩৪/জানু ১৯৩৫) তার কিংবদন্তিসম বনলতা সেন কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এই ১৮ লাইনের কবিতাটি বর্তমানে বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতার অন্যতম হিসেবে বিবেচিত। পরের বছর জীবনানন্দের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ধূসর পাণ্ডুলিপি প্রকাশিত হয়। জীবনানন্দ এর মধ্যেই বরিশালে সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছিলেন। ১৯৪২ সালে কবির পিতৃবিয়োগ হয় এবং ঐ বছরেই তার তৃতীয় কবিতাগ্রন্থ বনলতা সেন প্রকাশিত হয়।
 
জীবনানন্দ দাশ প্রধানত কবি হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছেন৷ তবে ১৯৫৪ সালে মৃত্যুর পূর্বে তিনি ২১টি উপন্যাস এবং ১২৬টি ছোটগল্প রচনা করেছিলেন যার একটিও তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি৷ দীর্ঘ সময় তিনি চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিনাতিপাত করেছেন৷ তিনি নিজেই স্বীয় রচনার অর্থায়ন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন যদিও শেষাবধি তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে কবি নিজেই নিজ রচনার কড়া সমালোচক ছিলেন। তাই সাড়ে আটশত কবিতার বেশি কবিতা লিখলেও তিনি জীবদ্দশায় মাত্র ২৬২টি কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও কাব্যসংকলনে প্রকাশ করতে দিয়েছিলেন। এমনকি, রূপসী বাংলার সম্পূর্ণ প্রস্তুত পাণ্ডুলিপি তোরঙ্গে মজুদ থাকলেও তা তিনি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন নি। তবে তিনি এ কাব্যগ্রন্থটির নাম দিয়েছিলেন বাংলার ত্রস্ত নীলিমা যা তার মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত হয় এবং রূপসী বাংলা প্রচ্ছদনামে প্রকাশিত হয়। আরেকটি পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয় মৃত্যু পরবর্তীকালে যা বেলা অবেলা কালবেলা নামে প্রকাশিত হয়। জীবদ্দশায় তার একমাত্র পরিচয় ছিল কবি। অর্থের প্রয়োজনে তিনি কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন ও প্রকাশ করেছিলেন। তবে নিভৃতে গল্প এবং উপন্যাস লিখেছিলেন প্রচুর যার একটিও প্রকাশের ব্যবস্থা নেননি। এছাড়া ষাট-পঁয়ষট্টিটির বেশি খাতায় “লিটেরেরী নোটস” লিখেছিলেন যার অধিকাংশ ২০০৯ সাল অবধি প্রকাশিত হয়নি।
গ্রামবাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গ ও রূপকথা-পুরাণের জগৎ জীবনানন্দের কাব্যে হয়ে উঠেছে চিত্ররূপময়, তাতে তিনি ‘রূপসী বাংলার কবি’ অভিধায় খ্যাত হয়েছেন৷ বুদ্ধদেব বসু তাঁকে ‘নির্জনতম কবি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন৷ অন্যদিকে, অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে ‘শুদ্ধতম কবি’ অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন। সমালোচকদের অনেকে তাঁকে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি বলে মনে করেন। কবির বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনে পুরস্কৃত (১৯৫৩) হয়৷ ১৯৫৫ সালে শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থটি ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করে। জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলোর মাঝে রয়েছে রূপসী বাংলা, বনলতা সেন, মহাপৃথিবী, বেলা অবেলা কালবেলা, শ্রেষ্ঠ কবিতা ইত্যাদি৷
কবিকে বহুবছর বেকারত্বের দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে দিন কাটাতে হয়েছিল, এর জেরে পরিবারটির আর্থিক দুরাবস্থার অন্ত ছিল না। হয়তো এসব কারণেই স্ত্রী লাবণ্যের খিটিমিটি আর জীবনানন্দের হতাশাবোধ। কবি বিয়ের পর দীর্ঘদিন দিল্লিতে ফিরে যাননি। এরপর প্রায় বছর পাঁচেক সময় জীবনানন্দ কর্মহীন অবস্থায় ছিলেন। মাঝে কিছু দিন একটি বীমা কোম্পানির এজেন্ট হিসাবে কাজ করেছেন; ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে অর্থ ধার করে ব্যবসা করেছেন; কিন্তু কোনোটাই স্থায়ী হয়নি। এ সময় তার পিতা জীবিত এবং জীবনান্দের স্ত্রী বরিশালেই ছিলেন বলে জীবনানন্দের বেকারত্ব পারিবারিক দুরবস্থার কারণ হয়নি। তিনি একটি চাকুরির জন্য হন্যে হয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। এক সময় স্ত্রী লাবণ্য দাশ স্কুলে শিক্ষকতা করে জীবিকার অভাব কিছুটা পুষিয়েছেন। ১৯৫৪ সালে অকাল মৃত্যুর সময় তিনি হাওড়া গার্লস কলেজ কর্মরত ছিলেন। অসংখ্য কবিতা লিখে বেশিরভাগই ট্রাঙ্কে তুলে রেখে দিয়েছিলেন। প্রেম হারিয়ে বেদনাক্লিষ্ট ছিল মনের অভ্যন্তর। অর্থনৈতিক অস্বাচ্ছন্দ্য আর দাম্পত্য-সম্পর্ক নিয়ে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ চারদিকে সমস্যার পাহাড় তৈরি করে তার জীবনটাকে থিতু হতে দেয়নি।
কবি জীবনানন্দের কবিতার সবচেয়ে বড় প্রচারক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। বুদ্ধদেব বসুর ভাষায়, “জীবনানন্দকে আমি প্রথম দেখেছিলাম ঢাকায়, তার বিবাহ-সন্ধ্যায় উপস্থিত ছিলাম ঢাকার ব্রাহ্ম সমাজে, যুক্ত ছিলাম ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ পর্যায় থেকে তার মৃত্যুকাল পর্যন্ত তার কবি জীবনের সঙ্গে। কিন্তু তার সঙ্গে কোনো ব্যক্তিগত সম্বন্ধ আমি স্থাপন করতে পারিনি, অন্য কেউ পেরেছিলেন বলেও জানি না।” মূলত এমনই ছিল তার স্বভাব। ধ্যান এবং নিমগ্নতাকে জীবনানন্দ দাশ নিছক সাহিত্যচর্চার উপাদান বিবেচনা করেননি, তার জীবনচর্যার মধ্যে বিষয়গুলো ঢুকে পড়েছিল। নির্জন-একাকী, কিছুটা কুয়াশাঘেরা জীবনযাপন। খুব কম লোকের সঙ্গে তিনি মিশেছেন। তাই তার সৃষ্টিমূলক লেখা থেকে প্রত্নখনন করেই ব্যক্তি জীবনানন্দকে খুঁজে নিতে হয়।
কবির মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা, না আত্মহত্যা এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেকেই কবির মৃত্যুকে আত্মহত্যা মানতে রাজি নন। প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্যে, কবি যখন ট্রাম লাইন পার হচ্ছিলেন তখন তার হাতে ডাব ছিল। একজন মানুষ হাতে ডাব নিয়ে আত্মহত্যা করতে পারেন না। ১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর ট্রামের নিচে পড়ে মারাত্মক আহত অবস্থায় কয়েকটা দিন কাটিয়ে ২২ অক্টোবর শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের নির্জন কক্ষে জীবনাবসান হয়েছিল কবির। “আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে– এই বাংলায়/হয়তো মানুষ নয়– হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে,/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে / কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়; / হয়তো বা হাঁস হ`ব–কিশোরীর–ঘুঙুর রহিবে লাল পায়, / সারা দিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে ভেসে; / আবার আসিব আমি বাংলায় নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে।’ কবি জীবনানন্দ দাশ সশরীরে না এলেও কবিতার মধ্যদিয়ে তিনি আমাদের মাঝে এই বাংলায় ফিরে আসেন বারবার।
মো. জিল্লুর রহমান
ব্যাংকার ও লেখক
সতিশ সরকার রোড,
গেন্ডারিয়া, ঢাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *