আবেগহীন মানুষ যন্ত্রের মত

লায়ন মোঃ শামীম সিকদার

প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী জন সি. রাস এর ভাষায়, ‘আবেগ হল একটি অনুভুতিমূলক অভিজ্ঞতা, যা শারীরিক উত্তেজনার কারন এবং অভিজ্ঞতা অর্জনকারীর নিকট যার অর্থ বা মূল্য রয়েছে’। মানুষের সহজাত ধর্ম হল আবেগ। আবেগহীন মানুষ যন্ত্রের মত। আবেগ হল এক ধরনের অস্থির ভাবাবেগ বা অনুভূতি। এ অনুভূতি প্রকাশের রূপ ভিন্ন হয়। কী ছিল, কী আছে, কী নেই, যেমন চেয়েছি, তেমন পেয়েছি কিনা এ ভাবনা সব সময় জীবনকে তাড়িত করে। তাড়া খেতে খেতে আমরা যখন হাপিয়ে উঠি তখন জীবনের প্রতি অনিহা চলে আসে। জীবনের প্রতি যখন একজন মানুষ বিরক্তি বোধ করে তখন তার মধ্যে আবেগ কাজ করে। আবেগ হল এক ধরনের অস্থির ভাবাবেগ বা অনুভুতি। আবেগের ফলে মানুষের দেহের ভিতরে পরিবর্তন ঘটায়। তখন মানুষের মধ্যে যে আলোড়নের সৃষ্টি হয় যা তার অভিজ্ঞতা, আচরণ এবং শারীরিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় আবেগ। আবেগ সকলের মধ্যে কম-বেশি থাকে। আবেগহীন মানুষ যন্ত্রের মত। কোনো অবস্থায়ই আবেগ নিয়ন্ত্রনের বাইরে যেতে দেয়া যাবে না। মানুষের আচরণে উত্তেজনা, অস্থিরতা, চঞ্চলতা ও তীব্রতার যে তারতম্য ঘটে তার মুলে রয়েছে আবেগ। মানুষ ইতিবাচক আবেগের ফলে ভাল কাজ এবং নেতিবাচক আবেগের ফলে খারাপ কাজ করে থাকে।

সব মানুষের চাহিদা এক রকম নয়। কেউ অল্পতেই খুশি হয়। আবার প্রচুর পাওয়ার পরও আক্ষেপ থেকে যায়। চাহিদার সাথে প্রাপ্তির তারতম্য বেশী হলে আবেগও বেশী হয়। এমন কিছু আশা করা ঠিক না যা কোনো দিন পূরণ হবে না। আবেগপ্রবণ মানুষেরা পূরণ না হওয়া চাওয়াই বেশী আশা করে। এখানে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। মাঝবয়সী এক নারী তার স্বামীর মৃত্যুর বছর যেতে না যেতেই এক বিবাহিত চাকরীজীবী পুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। ভালই যাচ্ছে তাদের সময়। মুঠোফোনের ফলে তাদের মধ্যে প্রতিমূহুর্তের খবর আদান প্রদান হয়। দিনে সব মিলিয়ে ৫ থকে ৬ ঘন্টা কথা হয় তাদের। কথা বলতে বিলম্ব হলেই অস্থির হয়ে পরে দু’জনই। মাঝে মধ্যে তাদের দেখা সাক্ষাতও হয়। কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারছে না। মোটা দাগে বলা যায় প্রতিষ্ঠিত কোন রোমান্টিক উপন্যাসের নায়ক-নায়িকার মত। প্রচন্ড রকম আবেগের ফলে তাদের এ রকম সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এখানে বয়স, সমাজ ও পরিবার তাদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরীতে কোন বাধা হতে পারেনি। যখন পুরুষ লোকটির আবেগ কমতে শুরু করে তখনই আস্তে আস্তে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। এক পর্যায়ে এ সম্পর্কটা একেবারেই ভেংগে যায়। ফলে ঐ মাঝ বয়সী নারী মারাত্মক অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। আগের মত আর তার মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্যতা নেই। আবেগ নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারায়, তার এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

যে কোন ঘটনাই ঘটুক না কেন তার পিছনে আবেগ কাজ করে। কোন ঘটনায় আবেগ মুখ্য ভূমিকায় থাকে আবার কোন ঘটনায় আবেগ পরোক্ষ ভুমিকায় থাকে। নিজের উপর যাদের দখল বেশী থাকে তারাই আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। তারা বিপদেও কম পরে। তাই আমরা যাই করি না কেন বেশী আবেগ প্রবণ হওয়া যাবে না। সহজাত ভাবেই মানুষের মধ্যে আবেগ থাকবে, তবে তা কোন অবস্থায় নিয়ন্ত্রের বাহিরে চলে যেতে না পারে। মানুষের মধ্যে আবেগ না থাকলেও মানুষ যন্ত্র মানবে পরিনত হবে। সমাজ থেকে উঠে যাবে প্রেম-ভালবাসা, স্নেহ-মায়া-মমতা ও সামাজিকতা। এ জন্য আবেগ স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া থেকে ভিন্নতর। আবেগের প্রভাবে মানুষ কখনও কখনও আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ভাবাবেগ অনুভুতি বহির্ভুত আচরণ স্বাভাবিক আচরণ হিসেবে স্বীকৃতি হয় এবং বিপরীত আচরণই আবেগ হিসেবে পরিগণিত হয়।

আনন্দ, ভালবাসা, সুখ ইত্যাদি ইতিবাচক আবেগ। ইতিবাচক আবেগ ব্যক্তির জীবনযাত্রা সুন্দর করে তোলে এবং অন্যান্যদের সাথে ভাল সম্পর্ক সৃষ্টিতে সাহায্য করে। অপরদিকে নেতিবাচক আবেগ ব্যক্তির জীবনযাত্রার মানকে ক্ষুন্ন করে এবং অন্যান্যদের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টিতে বাঁধা প্রদান করে। প্রাথমিক আবেগের মধ্যে আছে সুখ, বিস্মায়, দুঃখ, রাগ, ভীতি, ঘৃণা এবং লজ্জা। এর মধ্যে একাধিক আবেগ একত্রিত হয়ে হতাশার সৃষ্টি হয়। আবার ভালবাসা ও ক্রোধের মিশ্ররূপ প্রতিহিংসা। ভালবাসার বিপরীত আবেগ হল ঘৃণা তেমনি দুঃখের বিপরীতে আনন্দ কোন কোন সময়ে আবেগের তীব্রতার মাত্রা পরিবর্তিত হতে পারে। কোন একটি আবেগ পরিবর্তিত আবেগকে আমরা বিভিন্ন নামে অবিহিত করি যেমন অস্থির, বদমেজাজি, পীড়িত, বিক্ষুদ্ধ ও আতঙ্ক, ভয়, ক্রোধ, হিংসা।

বেশী আবেগপ্রবন মানুষের শরীরে বিভিন্ন লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। শরীরের হৃদ স্পন্দন বৃদ্ধি পায় ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায়। আবেগের সময় সমবেদী স্নায়ুতন্ত্র যেসব শারীরিক পরিবর্তন সৃষ্টি করে সেগুলোর চোখের তারা প্রসারিত হয়। আবেগ বেশী হলে রক্তের উপাদানের পরিবর্তন সাধিত হয়। আবেগ উদ্রেকের (সঞ্চার) সংগে ত্বকের রাসায়নিক তড়িৎ প্রবাহে বাঁধা দেওয়ায় তা হ্রাস পায়। আবেগের ফলে স্বাভাবিক শ্বাস- প্রশ্বাসের গতি বৃদ্ধি পায়। তীব্র আবেগের সময় মুখে লাল নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায় এবং পাকস্থলীর ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। অতিরিক্ত আবেগের সময় বা কোন কারণে ভয় পেলে চোখের পাপড়ি দাঁড়িয়ে যায়।

আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেই মানুষের ব্যক্তিত্ব সুষমভাবে বিকাশ হবে। পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হ’ল আবেগের পরিপক্কতা। বয়স ভেদে আবেগের ধরন ভিন্ন হয়। শিশু বয়সের আবেগ একরকম, কৈশোর বা বয়ঃসন্ধিকালের আবেগ আরেক রকম, যুবক বয়সে যে রকম আবেগ থাকে বৃদ্ধ বয়সে সেরকম থাকে না। যে পরিবার স্নেহ মমতায় পূর্ণ, সে পরিবারের শিশুরা একটু বেশী আবেগী হয়। বড় হয়ে অন্যকে ভালবাসতে শেখে। সন্তানকে কখনোই অতি আদরে গড়ে তোলা উচিত নয়। আবার অতি রক্ষনশীল পরিবেশে সন্তান বেড়ে উঠরে সে যে কোন পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়াতে পারে না, ফলে দুঃখ পেলে তার মানসিক বিপর্যয় ঘটতে পারে। বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে-মেয়েদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে আবেগ প্রকাশে সুযোগ দিতে হবে। এ সময়ে কিশোর-কিশোরীদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের পরিবর্তন হয়। তাই তাদের আবেগ নির্বিগ্নে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তাহলেই তার দেহ-মন পরিপূর্ণভাবে বিকাশ হবে। হয়ে উঠবে একজন আলোকিত মানুষ।

মনের মধ্যে কৌতুক রস সৃষ্টি করে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বেশী টেনশন হলে বেশী হাসি খুশি পরিবেশ সময় কাটান। অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বৃদ্ধি করে ব্যক্তির আক্রমনাত্বক আচরণ প্রশমিত করা সম্ভব হয়। প্রচুর কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকলে অনেক সময় কষ্ট ভুলে থাকা সম্ভব। কাজের ব্যস্ততা মানুষকে মানসিকভাবে ব্যস্ত রাখে বিধায় আবেগের উত্তেজনা তাকে খুব একটা ভাবিত করে তোলে না। কোন ঘটনায় উৎকন্ঠিত না হয়ে ঘটনার কারন নিয়ে ভাবতে হয়। তাহলেই আবেগের চাপ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। নতুন কোন সখ সৃষ্টি করে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। সখ নিজের মধ্যে আনন্দের যোগান দেয়। ফলে আবেগের চাপ ও টেনশন হ্রাস পায়। আত্মসচেতনতা আবেগ প্রশমনে যথেষ্ট সাহায্য করে। সারাদিন একা একা না থেকে মানুষের মধ্যে থাকুন। এতে জনসংযোগ বাড়বে ফলে ব্যস্ততা বৃদ্ধি পাবে। ব্যস্ত মানুষের মধ্যে আবেগের স্থান কম থাকে। ধর্মীয় রীতি নীতি বেশী পালন করেও আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।  যে কোন সমস্যা ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে চিন্তা করলে টেনশন মুক্ত থাকা যায়।

অতিরিক্ত রাগ, ঘৃণা ও হীনমন্যতা ক্ষতিকর আবেগ। এ গুলো প্রশ্রয় না দেওয়াই ভাল। তাই সুন্দর ও স্বাভাবিক ভাবে আবেগ বিকাশে আমাদের সচেষ্ট থাকতে হবে এবং আবেগের যথাযথ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি পরিবারে পিতা মাতা বা অভিভাবক তাদের সন্তানদের বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। কারন এ সময়কালে প্রতিটি মানুষের আবেগ প্রবনতা বেশী থাকে। এ সময়ে শিশু কিশোররা অনিয়ন্ত্রিত থাকলে তাদের মধ্যে আবেগ প্রবনতা বেশী দেখা দিতে পারে। তাই আবেগ নিয়ন্ত্রনের জন্য প্রয়োজনীয় কৌশল অবলম্বনে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

তথ্যসূত্র: ‘মুক্তবুলি’ নবম সংখ্যা, প্রকাশকাল- জুলাই ২০১৯।

লায়ন মো. শামীম সিকদার

কলেজ শিক্ষক ও কলাম লেখক

০১৭১৬২৬৫৩২৯

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *