আবদুর রহমান কবিরের কাব্যগ্রন্থ: কালপুরুষের জবানবন্দি

আল হাফিজ ।।
সাধারণত জাদুকরী পদ্যের পেখম মেলে কবিরা কথা বলে আবেগময় ভাষায় আর কবিতা তো আবেগকে জাগ্রত করার এক অনন্য শিল্পমাধ্যম। আবেগের সঙ্গে বেগের মিলন ঘটিয়ে কবিরা এমন এক জগৎ সৃষ্টি করেন যার স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে মানুষ। কেননা কবিতা মানুষের স্বপ্নের সুন্দর বয়ানে সতত সজাগ; হৃদয়ের ভাষা দিয়ে সহজ রীতিতে যা প্রকাশিত হয়। এই রীতিকৌশল কতোটা কল্যাণকর তা বিবেচনা করবেন পাঠককুল। তবে দেশ জাতি ও সমাজকে স্বপ্ন দেখিয়ে কল্যাণের পথে, সম্ভাবনার পথে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন কবিসমাজ।
কবিতা আশা-আকাক্সক্ষার কথা বলে, ভালোবাসার কথা বলে। আশা আর ভালোবাসার কথা বলতে আবেগের শিল্পিত প্রয়োগ জরুরি। এমনই নন্দিত আবেগ নিয়ে ‘কালপুরুষের জবানবন্দি’ শীর্ষক পদ্য-কবিতার বই রচনা করেছেন কবি আবদুর রহমান কবির। সহজ-সরল ভাষায় জীবনের নানামুখী আনন্দ-বেদনার গাঁথা উপমা-রূপকের মাধ্যমে বলার চেষ্টা করেছেন তিনি। তার ভাষায় রয়েছে সহজ জীবনদর্শন ও রোমান্টিক পরিবেশ, রয়েছে গ্রামীণ জীবন যাপনের আদর্শিক ছায়াচিত্র। ফেলে আসা শৈশব-কৈশোরের এক অনন্য সাধারণ স্বপ্নের জগৎ। জৈবনিক চাওয়া-পাওয়া, প্রেম-বিরহ, স্বপ্ন-সম্ভাবনার কথা তিনি বলার চেষ্টা করেছেন সহজ-সরল প্রেমময় ভাষায়। তার কবিতার একটি উজ্জ্বল দিক হলো তার স্মৃতি জাগানিয়া শব্দ প্রয়োগ, বাক্যশৈলীর সহজ-ব্যঞ্জনা ও চমৎকার উপমার ব্যবহার। যেমন-
ক. শ্যামল বরণ কাজল আঁখি, দূর দিগন্তে চায়,
শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে সে যে আলতা রাঙা পায়।
– [ নাইওর, পৃষ্ঠা- ১০ ]
খ. কৃষ্ণচূড়ার কুঞ্জ শাখে আগুন রাঙায় ফাগুন মাস,
চৈত্র এলে কুহু ডাকে, রং ছড়ানো লাল পলাশ।
– [ বারোমাস, পৃষ্ঠা- ৩৪ ]
রুচিস্নিগ্ধ ঐতিহ্য সচেতন কবি আবদুর রহমান কবির মূলত একজন শিক্ষক। অধ্যাপনা পেশার পাশাপাশি তিনি সাহিত্য চর্চা করেন প্রাণের টানে। পদ্য-কবিতা লিখে তিনি ইতোমধ্যেই যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছেন নিজস্ব পরিমণ্ডলে। তবে তার প্রথম প্রকাশিত কবিতার বইয়ে তিনি যাপিত জীবনের বৈচিত্র্যপূর্ণ ছবি আঁকার চেষ্টা করেছেন আন্তরিকতার সঙ্গে। তার কবিতার কেন্দ্রে রয়েছে আমাদের ঐতিহ্যময় গ্রামীণ স্মৃতিস্নিগ্ধ মা-মাটি আর মানুষ। তার কাব্যচেতনায় রয়েছে আনন্দময় নৈতিক সত্য-ন্যায় এবং মানবিক সৌন্দর্যের জীবন্ত উপলব্ধি যা তাকে প্রেমময় মানবতার স্মৃতি সন্ধানী করে তোলে। ফলে তার কবিতায় সামাজিক মূল্যবোধ, দৈনন্দিন আনন্দ-বেদনার কথা উঠে আসে সহজ ভাষায়। তার পদ্যময় কবিতার প্রাণজ ভাব, ছন্দের অনুরণন এবং বর্ণিল বর্ণনার কিছু পঙক্তি নিম্নে তুলে ধরা হলো-
ক. জাত-পাত নেই হেথা সব যেনো একাকার,
সাদা-কালো সব প্রথা ভেঙে আজ চুরমার।
– [ ঐকতান, পৃষ্ঠা- ৩৬ ]
খ. আমরা তো গড়ি শুধু তোমাদের স্বপ্ন,
তবু মোরা থাকি কেন নিরাশায় মগ্ন?
– [ মুটে, পৃষ্ঠা- ৩৭ ]
গ. আমরা তো সেই কলুর বলদ কবে থেকেই ঠকছি,
নানান মতের চাকায় ঘুরে স্বপ্ন দেখেই ঘুরছি।
– [ আমরা তো সব কলুর বলদ, পৃষ্ঠা- ৩৯ ]
এইসব পঙক্তি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের মনের পর্দায় আমাদের সমাজের এমন কিছু চিত্র ভেসে ওঠে যা তাকে আবেগমথিত করে দেয়, ভাবায় এবং ব্যথিত করে। তাকে জীবনের বাস্তবতা ও প্রকৃতির মেলবন্ধনের পার্থক্যের বেদনায় ব্যাকুল করে তোলে। তার হৃদয় জুড়ে প্রতিবাদের বারুদ হতে সাহস যোগায় । এ রকম জীবনমুখী চিন্তা-চেতনা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সহজ ভাষাচিত্র রয়েছে এই গ্রন্থের পাতায় পাতায়। এমন আবেগঘন অনেক বিষয়ে কবি উচ্চারণ করেছেন সাবলীল পঙক্তিমালায়। তার কবিতার ভাষা যেমন সহজ পদ্যগন্ধী তেমন তিনি ব্যবহার করেছেন সহজ উপমার কল্পচিত্র কিন্তু সমকালের জীবনবাস্তবতা তো এতো সহজ-সরল নয়- এ বিষয়টি কি কবি এড়িয়ে গেছেন? তার কবিতা থেকে জীবনমুখী কিছু পঙক্তি তুলে দিচ্ছি:
ক. মুখগুলো যে ঢেকে রাখে সৌম্য কমল পরশে,
ফনা তোলে স্বার্থ গেলে হিংসা আর আক্রোশে।
– [ মুখোশ, পৃষ্ঠা- ৪২ ]
খ. জোনাক জ্বলা দাদুর আসর নেই তো আগের মতোন,
হারিয়ে গেছে গল্প-কথা জোছনা ভরা উঠোন।
– [ ফেরারি স্বপ্ন, পৃষ্ঠা- ৪০ ]
গ. কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে উড়ছে তাহার কালো কেশ,
ঝুলছে তাহার ভাতের থালা, ঝুলছে দেখো আমার দেশ।
– [ দুখিনির গল্প, পৃষ্ঠা- ২০ ]
কবি আবদুর রহমান কবির রচিত কাব্যগ্রন্থে ‘নাইওর’ যাওয়ার দৃশ্যাবলি, ‘মাঝির বৈঠা বাওয়া’, ‘রূপালি ইলিশ হয়ে জেলেদের হাসি’, ‘দুরন্ত কৈশরে ছুটে যাওয়া’ ইত্যাদি বিষয়ের মধ্য দিয়ে যে ভাবনাচিত্র ফুটিয়ে তোলেন তা পাঠককে বিশেষ ভাবে ভাবায়। তাছাড়া মানুষের সুখ-দু:খ, আনন্দ-বেদনা, আশা-নিরাশা, যুদ্ধ-সংগ্রামসহ সবই তার কবিতায় ধরা দেয় নান্দনিক আন্তরিকতায়। নিছক শিল্পের জন্য শিল্প নয়। বরং সামাজিক অরাজকতা, জৈবনিক বাস্তবতা কোনো কিছুই বাদ যায় না তার কাব্যচিন্তার জগৎ থেকে। ‘কালপুরুষের জবানবন্দি’ নামক কাব্যগ্রন্থে যেমন ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার চিত্র ফুটে উঠেছে তেমনি উঠে এসেছে শৈশবের জন্য আকুলতার চিত্রও। প্রকৃতির নানান অনুষঙ্গ দিয়ে নানান ব্যঞ্জনায় সাজিয়ে তিনি মানুষের হারানো ঐতিহ্যকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন তার পদ্য পাতায়। তার কবিতা থেকে কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরছি-
ক. হারাবো নিজেরে আমি কোনো পথহারা পথিকের মতো
সোনালি আলো খেলে যেথা সবুজের বুকে অবিরত।
– [ তাহাদের কাছে চলে যাবো একদিন, পৃষ্ঠা- ১৪ ]
খ. নৌকার পালে খেলা সোনালি রোদ্দুর
মেঠো পথে গাওয়া সেই ভাওইয়ার সুর।
– [ জন্মভূমি, পৃষ্ঠা- ১৫ ]
পুরোনো পয়ার-ত্রিপদী ছন্দের খেলায় শিল্পবোধকে মান্য করে কবি অত্যন্ত দরদ দিয়ে আমাদের হারানো অতীতের মুগ্ধতাকে ব্যক্ত করেছেন। ফলে তার পদ্যময় কাব্যভাষা ও ছন্দজ্ঞান, রূপবৈচিত্র্য ও আঙ্গিক উপস্থাপনা কৌশল ও শব্দব্যবহারের স্টাইল এবং উৎকর্ষিত চিন্তার বহু বর্ণিল ব্যবহার পাঠকহৃদয় ছুঁয়ে যায়। তার কবিতায় কোনো দুর্বোধ্যতা নেই, নেই কোনো জড়তা, যা বলার তা তিনি সোজাসুজি বলার চেষ্টা করেছেন যা প্রকৃত সাহিত্যের সহজিয়া বৈশিষ্ট্য। মূলত এখানেই তার কবিতার গূঢ় রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। ছন্দ-ভাব-চিন্তা-বিশ্বাস ও সৌন্দর্য্যে তার কবিতা অনন্য। তিনি তার শৈশবকে, হারানো ঐতিহ্যকে, গ্রামীণ বাস্তবতাকে আজকের মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন খোলামেলা ভাবে। যেমন-
ক. সেই খোকাটি হারিয়ে গেছে অনেক দূরের দেশ,
সেথায় সে যে সব পেয়েছে, পায়নি মায়ের কেশ।
– [ আমিও শিশু, পৃষ্ঠা- ১৬ ]
পদ্যশিল্পী আবদুর রহমান কবির এমনই বোধগম্য সুন্দর ভাষায় তার পঙক্তিমালা উপস্থাপন করেছেন ‘কালপুরুষের জবানবন্দি’ নামক কবিতাগ্রন্থে। প্রচ্ছদশিল্পী আতিক মামুন কর্তৃক অলংকৃত প্রচ্ছদে পথিমিতা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ১৫০ টাকা মূল্যের ৪৮ পৃষ্ঠার ঝকঝকে ছাপা এ কাব্যগ্রন্থটি কবিতাপ্রেমিক পাঠকসহ সমালোচকদের কাছে ভালো লাগবে বলে আমরা মনে করি। আমরা কবির সাফল্য কামনা করি। তার কাব্যজীবন সুষমামণ্ডিত হোক।

২ comments

  1. কবি আল হাফিজের সমৃদ্ধ আলোচনায় কবি আবদুর রহমান কবিরের কাব্যগ্রন্থ কালপুরুষের জবানবন্দি পাঠকের সামনে আরো সতেজ হয়ে উঠবে, ভালোবাসা দুই কবিকেই৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *