মুহাম্মাদ আবদুল মাননান
আমরা যারা নিজেকে একজন মোমিন হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকি, আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান অনুযায়ী সার্বিক জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে যারা সার্বক্ষনিক সচেতন, আল্লাহর একজন প্রিয় ও নেককার বান্দাহ হওয়ার প্রত্যাশায় সব কিছু উজার করে দিয়ে বিনয়াবনত ভাবে নিজেকে পেশ করার সর্বোত্তেম এবাদত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামায়াতের সাথে খুশু-খুজু ও একাগ্রতা নিয়ে আদায় করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে থাকি। আজকে আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মধ্যে একজন মোমিনের জন্য সবচেয়ে বরকতময় এবং গুরুত্ববহনকারী সলাত সলাতুল ফজর বা ফজরের নামাজ বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই যা কুরআন এবং সহীহ হাদীস দ্বারা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। আমরা যারা নামাজের ক্ষেত্রে অধিক সময়ে শৈথল্য প্রদর্শন করে থাকি বিশেষ করে ফজরের নামাজের ক্ষেত্রে আশাকরি আমার এ লিখুনী তাদের বিবেককে একটু হলেও নাড়া দিবে এবং আমাদেরকে আল্লাহর একজন প্রিয় বান্দাহ হিসেবে প্রস্তুত করতে সহায়তা করবে।
আল্লাহ তায়ালা সুরা বনি ইসরাঈল এর ৭৮ নং আয়াতে বলেন, ‘সালাত কায়েম করো সূর্য হেলে পড়া থেকে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত, আর ফজরের কুরআন-পাঠ। নিঃসন্দেহে ফজরের কুরআন-পাঠ লক্ষ্য করা হয়। আলোচ্য আয়াতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময়সূচির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। ‘ওয়া ক্বুরআনাল ফাজরি’ দ্বারা বিশেষভাবে ফজর নামাজ এবং ক্বুরআন তিলাওয়াত এর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। ফজরের ওয়াক্তে মুসলিম উম্মাহ্ সম্মিলিতভাবে কুরআন-চর্চা করে কিনা তা লক্ষ্য করা হয় কিংবা তার সাক্ষ্য রাখা হয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মধ্যে ফজরের নামাজে সর্বাধিক দীর্ঘ কিরাত পাঠ করতে হয় কেননা ফজরের নামাজের সঙ্গে কোরআনের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। হাদিসে আছে- রসূল (স.) বলেছেন- লোকজন যদি জানত এশার ও ফজর নামাজে কী সওয়াব তাহলে সাওয়াবের আশায় মসজিদে চলে যেতো। চাই তা হেঁচড়িয় হেঁচড়িয়েই হোক না কেন (বুখারি)।
নিম্নে ফজর নামাজের ১০ টি গুরুত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করা হল, যা কেনো মুমিন যদি গভীর ভাবে চিন্তা ও উপলদ্ধি করে তা হলে সে নিজেকে ঈমানিয়াত দ্বারা সিক্ত করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।
১) ঈমানদারের আলামত বা ঈমানদারীত্বের বিশেষ প্রমান। একজন মোমিন ঈমানের দাবীদার হলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে মসজীদে উপস্থিত হবেন এটাই চরম বাস্তবতা। বিশেষত ঈমানদারের বিশেষ আলামত হল ফজর নামাজে জামায়াতে উপস্থিত থাকা।বিনা ওজরে কেহ মসজীদে উপস্থিত হতে না পারার অর্থ দাড়ায় তার ঈমানদারীত্বের মধ্যে সমস্যা সংশয় আছে।
হযরত আবুহোরায়রা (রা.) হতে বর্নিত রাসুল (স.) বলেন, মুনাফেকদের নিকট ফজর ও ইশার নামাজের চেয়ে অধিক ভারি আর কোন নামাজ নেই। (বুখারি ৬৫৭, ৬৪৪, ৬৫৭, ২৪২০, ৭২২৪, মুসলিম ৬৫১) হযরত ইবনে মাসুদ (রা. )বলেন আমাদের সময় যারা ফজর ও এশার নামাজে আসতনা আমরা তাদের মুনাফেক ভাবতাম। রাসুল (স.) কে এমন এক ব্যাক্তি সম্পর্কে বলা হল যে সকাল পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটাল আর নামাজে উপস্থিত হতে পারেনাই। আল্লাহর রাসুল (স.) তার সম্পর্কে বললেন শয়তান তার কানের মধ্যে প্রশ্রাব করেছে। (বোখারী)
২) সরাসরি আল্লাহর জিম্মায় চলে যাওয়া : অর্থাৎ ফজর নামাজ আদায়কারী ব্যক্তির দায়দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা গ্রহন করেন। যুনদব ইবন আব্দুল্লাহ ইবন সুফইয়ান আলবাজালি রাযি. বলেন, রাসুলুল্লাহ বলেছেন, যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ আদায় করল, সে আল্লাহর জিম্মায় চলে গেল। অতএব আল্লাহ যেন তার জিম্মার বিষয়ে তোমাদেরকে কোনোরূপ অভিযুক্ত না করেন। (তিরমিযি ২১৮৪) সহীহ মুসলিমঃ ১৫২৫, তিরমিযীঃ ২২২, ইবনু মাজাহঃ ৩৯৪৫।
৩) আল্লাহর দরবারে নিজের নাম আলোচিত হবে : নামাজরত অবস্থায় থাকার বিষয়ে আল্লাহর কাছে ফেরেস্তাগন সাক্ষ্য প্রদান করে থাকেন। আবূ হুরাইরা রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেছেন, রাসুল (স.) বলেন, তোমাদের কাছে পালাক্রমে দিনে ও রাতে ফেরেশতারা আসে। তারা আসর ও ফজরের সময় একত্রিত হয়। যারা রাতের কর্তব্যে ছিল তারা উপরে উঠে যায়। আল্লাহ তো সব জানেন, তবু ফেরেশতাদের প্রশ্ন করেন, আমার বান্দাদের কেমন রেখে এলে? আমরা তাদের নামাজরত রেখে এসেছি। যখন গিয়েছিলাম, তখনও তারা নামাজরত ছিল।’(বোখারি)। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, রাতের ফেরেশতা ও দিনের ফেরেশতারা ফজরের সময় উপস্থিত হয়।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩১৩৫)
৪) সারা রাত এবাদতের সওয়াব লাভ : উসমান ইবন আফফান রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ বলেছেন, যে ব্যক্তি জামাতের সাথে ঈশার নামাজ আদায় করলো, সে যেন অর্ধেক রাত জেগে নামাজ পড়লো। আর যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ জামাতের সাথে পড়লো, সে যেন পুরো রাত জেগে নামাজ পড়লো। (মুসলিম ১০৯৬)
৫) ফজরের নামাজ কেয়ামতের দিন নূর হয়ে দেখা দেবে: ফজরের নামাজ আদায়কারী কিয়ামতে পরিপুর্ণ জ্যোতির অধিকারী হবে। সে পুলসিরাত কিংবা হাশর ময়দানে কোন আলোর সল্পতায় পড়বেনা। বুরাইদা আলআসলামি রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ বলেছেন, যারা আঁধারে (ফজর নামাযে) মসজিদের দিকে হেঁটে যায়, তাদের কেয়ামতের দিন পরিপূর্ণ নূর প্রাপ্তির সুসংবাদ দাও। (আবু দাউদ ৪৯৪)
৬) সব চেয়ে বড় ও দামী পুরষ্কারের ব্যবস্থা করা হবে:
হযরত জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ আল বাজলী রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক রাতে আমরা রাসূলুল্লাহ এর কাছে ছিলাম। হঠাৎ তিনি পূর্ণিমার রাতের চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন, শোন! নিশ্চয় তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে তেমনি স্পষ্ট দেখতে পাবে, যেমন স্পষ্ট ঐ চাঁদকে দেখতে পাচ্ছ। তাঁকে দেখতে তোমরা কোনো ভিড়ের সম্মুখীন হবে না। কাজেই তোমরা যদি সূর্য উঠার আগের নামাজ ও সূর্য ডুবার আগের নামাজ আদায়ে সমর্থ হও, তাহলে তাই কর। তারপর তিনি এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বে আপনি আপনার প্রতিপালকের প্রশংসার তাসবীহ্ পাঠ করুন।’ (বুখারি ৫৭৩)
৭) জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং জান্নাত প্রাপ্তির সুসংবাদ।
আবূ যুহাইর ‘উমারাহ ইবনে রুআইবাহ রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ -কে বলতে শুনেছি ,যে ব্যক্তি সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বে (অর্থাৎ ফজরের ও আসরের নামাজ) আদায় করবে, সে কখনো জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। (মুসলিম ৬৩৪, নাসায়ি ৪৭১, ৪৮৭, আবু দাউদ ৪২৭, আহমদ ১৬৭৬৯, ১৭৮৩৩)
আবু মুসা আশয়ারি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি দুটি শীতল সময়ে নামাজ আদায় করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’(বুখারি ও মুসলিম)। রাসূল (স.) বলেন, ওই ব্যক্তি কখনো জাহান্নামে যাবে না যে ব্যক্তি সূর্যদয়ের পূর্বে তথা ফজর এবং সূর্যাস্তের পূর্বে তথা আসর নামাজ নিয়মিত পড়ে (মুসলিম)।
৮) সকাল বেলার বরকত লাভ:
ফজরের নামাজ দিয়ে দিনটা শুরু করলে, পুরো দিনের কার্যক্রমের একটা বরকতম সূচনা হবে। নবী (স.) সকাল বেলার বরকতের জন্য দোয়া করেছেন, হযরত সখর ইবনে ওদায়া (রা.) হতে বর্নিত রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন’ হে আল্লাহ তায়ালা আমার উম্মতদেরকে সকাল বেলার কল্যান দান কর’ (তিরমিজি),
৯) ফজরের নামাজ পড়লে দুনিয়া ও আখেরাতের সেরা বস্তু অর্জিত হবে।
হযরত আয়শা (রা.) হতে বর্নিত তিনি আল্লাহর রাসুল (স.) থেকে বর্ননা করেন, রাসুল ( স. ) বলেছেন ফজরের দুই রাকাত সালাত জমীন ও তার মধ্য যা কিছু আছে তার থেকেও উত্তম। (তিরিমিযি)
১০) মানুষিক প্রফুল্লতা অর্জন: ফযর সালাত আদায়ের মাধ্যমে একজন মানুষ মানুষিক প্রফুল্লতাও প্রশান্তি অর্জন করে। ফযর সালাত কাযা করলে সেই দিনে বরকত কমে যায়, মনে বিষণ্ণতা অশান্তি ও অনুতাপ সৃষ্টি হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন তোমাদের কেউ ঘুমাতে যায়, শয়তান তখন তার মাথায় তিনটা গিঁট লাগিয়ে দেয়। প্রত্যেক গিঁট লাগানোর সময় সে বলে, এখনো অনেক রাত্র বাকী আছে’ অথাৎ তুমি শুয়ে থাক। যখন সে আল্লাহকে স্বরণ করে(আল্লাহর ভয়ে গভীর ঘুম থেকে) জেগে উঠে, তখন একটি গিঁট খুলে যায়। অতঃপর সে যদি ওযু করে, তাহলে আরো একটি গিঁট খুলে যায়। আর সে যদি সালাত আদায় করে, তাহলে সবগুলো গিঁট খুলে যায় এবং তার সকালটা হয় আনন্দ ও উদ্দীপনার সহিত। আর সে যদি (ঘুম থেকে না উঠে, আল্লাহকে স্মরণ না করে, ওযু না করে এবং ফযরের নামায না পড়ে), তাহলে তার সকালটা হয় ক্লান্ত ও বিষাদময়। সহীহ বুখারীঃ ১১৪২, সহীহ মুসলিমঃ ৭৭৬, নাসায়ীঃ ১৬১০।
লেখক: ব্যাংকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব