মেজর এম এ জলিল
১৬ই ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের সূত্র ধরেই যদি বলা যায় তাহলে ১৬ই ডিসেম্বরের পরে বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্তৃক ব্যাপক লুণ্ঠন প্রক্রিয়া ভারত এবং তার তাবেদার গোষ্ঠীর দৃষ্টিতে তা মোটেও অপরাধযোগ্য ছিলো না। কারণ বিজিত ভূখ-ে বিজয়ী সেনাবাহিনীর কর্তৃক সম্পদ লুটতরাজ করাকে আনন্দ-উল্লাসেরই স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ বলে বিবেচনা করা হয়।
স্বাধীনতার উষালগ্নে ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক সম্পদ লুন্ঠন প্রক্রিয়াকে যারা উপরিউক্ত দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করেন, তারা প্রকারান্তরে এই সত্যটিই স্বীকার করে নিয়েছেন যে, বাংলাদেশ ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক একটি বিজিত ভূখণ্ড মাত্র।
আর যারা ১৬ই ডিসেম্বরকে বাঙালির বিজয় দিবস এবং বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন সার্বভৌম বলে মনে করেন এবং এ কথাও বলেন যে, স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী কোনো সম্পদ লুটতরাজ করেনি, তারা যে বন্ধু ভারতের কোনো দোষ-ত্রুটিই অনুসন্ধান করতে রাজি নয় এ কথা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু যারা দেশপ্রেম সমৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা, সত্যান্বেষী এবং মুক্তিপিপাসু তারা নিজেদের ভূখ-কে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েই স্বাধীন করেছে বলে বিশ্বাস করে, তারা বাংলাদেশকে ভারতের বিজিত ভূখ- বলে কখনোই মনে করে না। তারা মনে করে ভারতের সম্প্রসারণবাদী প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের শেষপর্বে সমগ্র মুক্তিযোদ্ধার ভয়ে ভীত হয়েই বাঙালির স্বাধীনতা গৌরবকে জবর দখলের মধ্য দিয়ে নিজেদের হীন স্বার্থ উদ্ধার করেছে মাত্র। উপরিউক্ত ধ্যান-ধারণায় পুষ্ট দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা ১৬ই ডিসেম্বরের পরে মিত্রবাহিনী হিসেবে পরিচিত ভারতীয় সেনাবাহিনীকে নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন সম্পদ, মালামাল লুণ্ঠন করতে দেখেছে। সে লুণ্ঠন ছিলো পরিকল্পিত লুণ্ঠন, সৈন্যদের স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ নয়। সে লুণ্ঠনের চেহারা ছিলো বীভৎস বেপরোয়া। সে লুণ্ঠন একটি সচেতন প্রতিক্রিয়ারই ধারাবাহিক কর্মতৎপরতা। মুক্তিযুদ্ধের নবম সেক্টরের অধিপতি হিসেবে আমি সেই ‘মটিভেটেড’ লুণ্ঠনের তীব্র বিরোধিতা করেছি- সক্রিয় প্রতিরোধও গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছি। লিখিতভাবেও এই লুণ্ঠনের প্রতিবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন, কর্নেল ওসমানী এবং ভারতীয় পূর্ব অঞ্চলের সর্বাধিনায়ক লে. জেনারেল অরোরার কাছে চিঠিও পাঠিয়েছি। তাজউদ্দীন সাহেবের পাবলিক রিলেশন অফিসার জনাব তারেকই আমার সেই চিঠি বহন করে কলকাতায় নিয়েছিলেন। ১৭ই ডিসেম্বর রাতেই সেই বিশেষ চিঠিখানা পাঠানো হয়েছিল। খুলনা শহরে লুটপাটের যে তা-ব নৃত্য চলেছে তা তখন কে না দেখেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক সেই লুটপাটের খবর চারিদিক থেকে আসা শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক পরিত্যাক্ত কয়েক হাজার সামরিক-বেসামরিক গাড়ি, অস্ত্র, গোলাবারুদসহ আরো অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র ট্রাক বোঝাই করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ‘প্রাইভেট কার’ পর্যন্ত রক্ষা পায়নি, তখনই কেবল আমি খুলনা শহরের প্রাইভেট গাড়িগুলো রিকুইজিশন করে খুলনা সার্কিট হাউজ ময়দানে হেফাযতে রাখার চেষ্টা করি। এর পূর্বে যেখানে যে গাড়ি পেয়েছে সেটাকেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে সীমান্তের ওপারে।
যশোর সেনানিবাসের প্রত্যেকটি অফিস এবং কোয়ার্টার তন্ন তন্ন করে লুট করেছে। বাথরুমের ‘মিরর’ এবং অন্যান্য ফিটিংসগুলো পর্যন্ত সেই লুটতরাজ থেকে রেহাই পায়নি। রেহাই পায়নি নিরীহ পথযাত্রীরা। কথিত মিত্রবাহিনীর এই ধরনের আচরণ জনগণকে ভীত সন্ত্রন্ত করে তুলেছিল। বাংলাদেশের প্রবেশের সাথে সাথেই যাদের শ্রী এমন তারা যদি বাংলাদেশ ত্যাগ না করে বাংলাদেশের মাটিতেই অবস্থান করতে থাকে, তাহলে কী দশা হবে দেশ ও জাতির। একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ কোন ধরনের স্বাধীনতা অর্জন করলাম আমরা, এ ধরনের নানা প্রশ্ন দেখা দিলো জনমনে। আমি জনগণ থেকে যেহেতু মোটেই বিচ্ছিন্ন ছিলাম না, সুতরাং ভারতীয় সেনাবাহিনীর আচরণে আমি বিক্ষুব্ধই হয়ে উঠিনি বরং তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার পর্যায়ে চলে গেলাম। খুলনার নিউজপ্রিন্ট মিলের রেস্ট হাউজে অবস্থানরত আমার প্রতিপক্ষ ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধিনায়ক মেজর জেনারেল দানবীর সিংকে আমি সতর্ক করে দিয়ে বললাম, ‘দেখা মাত্র গুলির হুকুম দিয়েছি আমি। ভারতীয় সেনাবাহিনীকে লুটতরাজ করা হতে বিরত রাখুন।’
জেনারেল দানবীর আমার হুঁশিয়ারবাণী খুবই হালকাভাবে গ্রহণ করে এমন ভাবখানা দেখালেন যেন আমি তারই অধিনস্থ একজন প্রজামাত্র। তার পরের ইতিহাস খুব দ্রুত ঘটে গেছে। খুলনার বিভিন্ন জায়গায়, যশোর বর্ডারে, সাতক্ষীরা-ভোমরা বর্ডারে ভারতীয় লুটেরা বাহিনীর সঙ্গে বেশ কিছু বাদানুবাদ এবং সংঘর্ষও হয়েছে। ভারতীয় বাহিনীর এ ধরনের আচরণ সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়ার জন্য আমি ২১শে ডিসেম্বর তারিখ রাত্রে স্টিমার যোগে বরিশাল যাওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করি।
খুলনা পরিত্যাগ করতে হলে নাকি ভারতীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডের হুকুম নিতে হবে-একথা শোনার পরে ভারতের আসল মতলবখানা আমার কাছে পরিস্কার হয়ে উঠল। আমি সেক্টর কমান্ডার হিসেবে ভারতীয় নির্দেশ মেনে চলতে মোটেও বাধ্য ছিলাম না। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যুহ ভেঙ্গে দেশ মুক্ত করলাম ভারতীয় সেনাবাহিনীর নির্দেশ মেনে চলার জন্য নয়। একটি মুক্তিপিপাসু জাতির ভাবাবেগ অনুধাবন করতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কেবল চরমভাবেই ব্যর্থ হয়নি, বরং অনুধাবন করার সামান্যতম ধৈর্যও প্রদর্শন করেনি তারা। অন্য কথায় তারা কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করেনি। সংগ্রামী বাংলাদেশ নয়, ভারত যেন একটা মগের মুল্লুক জয় করেছে বলে মনে হলো আমার কাছে। সে যাই হোক, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বাধা-নিষেধের উপেক্ষা করেই আমি দলবলসহ ‘ইনভেসটিগেশন’ জাহাজটিতে চড়ে ২০শে ডিসেম্বরেই বরিশাল অভিমুখে রওয়ানা হই। বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী ইত্যাদি জায়গাগুলোতে জনসভার আয়োজন করা হয় এবং জনগণকে ভারতীয় বাহিনীর আচরণ সম্পর্কে সচেতন করে দিই। আওয়ামী ছাত্রলীগের যৌথ আয়োজনেই সেই জনসভাগুলো অনুষ্ঠিত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল অবিলম্বে মুক্তিযোদ্ধাদের নিরস্ত্র করবে এবং সকল অস্ত্র জমা করে সীমান্ত্রের ওপারে নিয়ে যাওয়া হবে। ভারতীয় বাহিনীর এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধেও আমি জনসভাগুলোতে সোচ্চার হয়ে উঠলাম। আমার পরিস্কার নির্দেশ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দী স্বাধীন বাংলার স্থপতি জনগণের প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত না করা পর্যন্ত বাঙালি জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চলতে থাকবে। শেখ মুজিবের হস্তেই কেবল মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অস্ত্র সমর্পণ করে দেবে।
আমার এই মহান আহ্বান এবং নির্দেশ মুক্তিযোদ্ধা এবং জনগণের মধ্যে ব্যাপক উদ্দীপনার জন্ম দেয়। বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় গোয়েন্দাবাহিনী এবং কট্টর ভারত সমর্থগোষ্ঠী আমার চেতনা এবং অনুভূতির তাৎপর্য সঠিকভাবে বুঝে উঠতে সক্ষম তো হয়নি বরং ভুল বুঝেছে। এখানে একটা বিষয় সকলেরই পরিস্কার হওয়া প্রয়োজন এবং তা হচ্ছে স্বাধীনতার সেই উষালগ্নে বিধ্বস্ত বাংলাদেশের সম্পদ রক্ষা করার যে আগ্রহ এবং বাসনা আমরা প্রদর্শন করেছি তা ছিলো আমাদের জাতীয় সম্পদ রক্ষা করারই স্বার্থে কেবল, ভারত বিরোধী হয়ে উঠার জন্য নয়। জাতীয় সম্পদ রক্ষার চেষ্টা কেবল নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমেরই লক্ষ, কারো বিরুদ্ধে শত্রুতা সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্র মোটেও নয়। বন্ধু ভারত এখানে হিসেবে ভুল করেছে আর তাই দেশপ্রেমের পুরস্কার হিসেবে আমাকে যশোর থেকে ‘এমবুশ’ করে অর্থাৎ গোপনে ওৎ পেতে থেকে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনী সশস্ত্র উদ্যোগে গ্রেফতার করে।
আমারই সাধের স্বাধীন বাংলায় আমিই হলাম প্রথম রাজবন্দী। ২১শে ডিসেম্বর বেলা ১০টা সাড়ে দশটায় আক্রমণকারী বাহিনীর হাতে বন্দী হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আসল রূপের প্রথম দৃশ্য দেখলাম আমি। ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর মদদে বাংলাদেশ স্বাধীন করার অর্থ এবং তাৎপর্য বুঝে উঠতে আমার তখন আর এক মিনিটও বিলম্ব হয়নি।
১৯৭১ সনের সেই ৩১শে ডিসেম্বর রাত ১২টা ১ মিনিটের কথা আমি কোনো দিনই ভুলতে পারব না। যশোর সেনাছাউনির অফিসার কোয়ার্টারের একটি নির্জন বাড়িতে আমাকে সকাল ১১টায় বন্দী করা হয়। বাড়ি না যেন হানাবাড়ি। ঘুটঘুটে অন্ধকার, আশে-পাশে বেশ কিছু নর-কংকাল পড়ে আছে। ঘরের ভিতর মানুষের রক্তের দাগ। কোনো ধর্ষিতা বোনের এলোমেলো ছেঁড়া চুল। বাইরে কাক, শকুন, শেয়াল একযোগে ব্যস্ত। ভেতরে মশারা কামান দাগিয়ে আছে। বাথরুমে পানি নেই। ডিসেম্বরের ভিজে শীত। বাইরে সেন্ট্রির বুটের কটমট আওয়াজ। সারাদিন গেল কোনো খাওয়া বা খাবার পানি পর্যন্ত এলো না। ৫ রুম বিশিষ্ট বাড়িটির রুমে রুমে যেন কান্না আর হাহাকার। সন্ধ্যা হতেই প্যাঁচার গোঙ্গানি শুরু হয়। সহযোগী ভুতুমও পেছনে পড়ে নেই। বাড়িটার একটা রুমেও লাইট নেই। একটা খাটের উপর একটা আধছেঁড়া কম্বল এবং তখন সেটাই আমার আপন একমাত্র আশ্রয়স্থল। কোনোমতে কম্বলটা জড়িয়ে বসে আছি। রাত ১২টা ১ মিনিটে যশোর সেনাছাউনি নতুন বছরের উজ্জীবনী গীতিতে মুখর হয়ে উঠল। নারী-পুরুষের যৌথ কণ্ঠের মন মাতানো সংগীত নাচ, হাততালি, ঘুঙুরের ঝনঝনানি, উল্লাস, উন্মাদনা সবই ভেসে আসছিল কর্ণকুহরে। আমার মাটিতে প্রথম নববর্ষেই আমি অনুপস্থিত। এ কথা ভাবতেই আমি কানে আর কিছুই শুনতে পেলাম না। শুনলাম কেবল একটা ব্যাঙ্গাত্মক অট্টহাসি। -‘রক্ত দিয়ে এই স্বাধীনতা আনলে তোমরা” যার অর্থ দাঁড়ায় কতকটা এরকম।
রাতের ঘুটঘুটে সেই অন্ধকারে আমি সেদিন কম্বল জড়িয়েও ঘেমে উঠেছিলাম, শিহরিয়ে উঠেছিলাম পুনঃপুনঃ। স্বাধীনতার সতেরো বছর পরেও আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। অন্ধকারে আজো আমি একইভাবে শিহরে উঠি আর যেন শুনতে পাই- “রক্ত দিয়ে এই স্বাধীনতা আনলে তোমরা।”
[মেজর এম এ জলিলের ‘অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা’ বইয়ের নবম অধ্যায়টিই আজকের এই নিবন্ধ। ইতিহাস পরিষদ, জুলাই ২০০৯, পৃ ৬৩-৬৭। লেখকের বানান ঈষৎ পরিবর্তিত]