শামসুর রাহমানকে লেখা আল মাহমুদের চিঠি

শ্রদ্ধাস্পদেষু,
আমার সালাম জানবেন। সেদিন ঢাকায় আপনার কামরা থেকে বেরিয়ে এসে আর অরুণাভের সাক্ষাৎ পাইনি। অরুণ নিশ্চয় মনে আঘাত পেয়েছে। আমি তাকে গুলিস্তান এলাকার প্রত্যেকটি রেস্তোরাঁয়, বারে আঁতিপাতি করে খুঁজেও আর পেলাম না। এমনকি শেষ পর্যন্ত বাংলাবাজারের বিউটি রেস্তোরাঁয় তরুণদের আড্ডায় পর্যন্ত ধাওয়া করেছি, সেখানেও সে ছিল না।
এবার ঢাকা আমার কাছে এত ভালো লাগছিল যে, ১৯৫৩-৫৪ সনের আমাদের ঢাকার জীবনের কথা মনের মধ্যে তোলপাড় করছিল। আমি নির্মলেন্দু গুণ ও আবুল হাসানকে এ কথা বললাম। এদের সাথে তখন আরও পাঁচ-ছয়জন তরুণ লেখক ছিলেন, আমি সবার নাম জানি না—তারা সবাই মুগ্ধ হয়ে আমার সে কাহিনি শুনল। আপনার “স্মৃতির শহর” যদি আর মাত্র দু–বছর এগিয়ে আসত, তাহলেই সেখানে উপস্থিত হতাম আমরা, আমি, ফজল (ফজল শাহাবুদ্দীন), শহীদ (শহীদ কাদরী)। কিন্তু আপনি বোধ হয় এতটুকু আসার প্রয়োজন বোধ করেননি। এবার সত্যি ঢাকা ছেড়ে আসার সময় আমার খুবই খারাপ লাগছিল। মনে মনে ভাবছিলাম, জীবিকার যৎসামান্য সুবিধা পেলে আমি আবার ফিরে আসব। কিন্তু ঢাকায় আমাকে কে সে ব্যবস্থা করে দেবে? রাইটার্স গিল্ডে অবশ্য চাকরি করতে পারতাম। কিন্তু প্রথম থেকেই গিল্ডের সাথে আমার সম্পর্ক খারাপ হয়ে আছে। কর্মকর্তাদের সবার মন জুগিয়ে চলতে না পারলে আমাকে আবার অচিরেই বের হয়ে রাস্তায় ঘুরতে হবে ভেবে সাহস হলো না। বেকার হওয়া যে কী ব্যাপার, তা আমার মতো অন্য কোনো পূর্ব-পাকিস্তানি লেখক উপলব্ধি করতে পারবেন না। অবশ্য জাফর ভাইয়ের (সিকান্দার আবু জাফর) ওপর ভরসা রেখে চাকরিটা নিতে পারতাম। তাঁর প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা ও অটল বিশ্বাস রয়েছে। কিন্তু শেষের দিকে তিনিও আর তেমন উৎসাহ দেখালেন না। আর সত্যি কথা বলতে কি, রাইটার্স গিল্ড ধরনের সাহিত্যান্দোলনে আমার ব্যক্তিগতভাবে কোনো আস্থা নেই, আমি সব সময় এ ধরনের পৃষ্ঠপোষকতাকে এড়িয়ে চলেছি। অনেকে এ ধরনের প্ল্যাটফর্মের মধ্যে প্রগতিশীল সংস্কৃতি প্রয়াসের বীজ বপন করার স্বপ্নে মশগুল হয়ে আছেন। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিভূমিটাই লেখকদের দাসত্বে আবদ্ধ করার গুরুতর ষড়যন্ত্রের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, সেখানে আমার মতো বন্য লোকের প্রবেশ এবং পোষ মানা সম্ভব নয়। এবার জাফর ভাইয়ের সাথে এ নিয়ে ক্ষণস্থায়ী আলোচনা হয়েছে। তিনি আমার কথা স্বীকার করেন না—তাঁর ধারণা এতে কিছুই আসে যায় না। কিন্তু আমি জানি, অত্যন্ত দুঃখজনক অভিজ্ঞতা নিয়ে আপনাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে। আমি নিরপেক্ষ, বিচ্ছিন্ন বা অস্তিবাদী লেখক নই। আমার পরিষ্কার রাজনৈতিক মতামত ও আদর্শ রয়েছে। সমাজ বিশ্বাস আমার কাছে যেমন বড় কথা, সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে সংগ্রাম করাকে আমি তারও চেয়ে মূল্য দিয়ে থাকি। এর জন্যে নিশান নিয়ে রাস্তায় নামতে আমার আর কোনো দ্বিধা নেই। দরকার হলে পার্টি সংগঠনের মধ্যে থেকে কাজ করব, রাস্তায় রাস্তায় পোস্টার সাঁটব। কবিতা লেখার মতোই এসব কাজ আমার জীবনের সাথে যুক্ত। ভয় এবং আপস আমার মধ্যে আপনি কোনোদিনই দেখতে পাবেন না। অনেক ভুল করেছি, তা বলে আজীবন ভুল পথে চলার কোনো মানে হয় না। কোনো লেখক সাহস হারিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন না।
জাফর ভাইয়ের কাছে লেখা আমার সামান্য চিঠিখানা বুঝতে পারলাম আপনাকেও ক্ষুব্ধ করেছে। “পরিক্রম”–এ প্রকাশিত কবিতা তিনটির শেষেরটি আমাকেই বিদ্রূপ করে লেখা বলে আমার মনে হয়েছিল। আমার ভুল হতে পারে, কিন্তু এ ধরনের একটা সন্দেহ ও আশঙ্কা হাসান সাহেব আমার মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছেন অনেক দিন ধরে। তিনি যখনই সুযোগ পেয়েছেন, আমাকে সর্বসমক্ষে অপমান করতে ছাড়েননি। এর কিছু কিছু ঘটনা আপনারও অজানা নয়। জাফর ভাইও জানেন। হাসান সাহেব সর্বত্র আমাকে একজন মূর্খ ও গ্রাম্য লোক বলে প্রচার করে আনন্দ পান। আমার সাহিত্যকর্ম সম্বন্ধে তাঁর অশ্রদ্ধার কথা সর্বজনবিদিত।
[আমি আমার ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা উত্তমরূপে জানি না বলে তিনি আমাকে অকবি মনে করেন। এবং শুধু এ কারণে আমার কবিতা লেখার অধিকার নেই বলে তাঁর ধারণা। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাস আমার যে যৎসামান্য জানা আছে, তাতে আমি তার সাথে একমত নই বলেই কবিতা লিখতে সাহস পাই। (এই অংশটুকু শামসুর রাহমানকে পাঠানো চিঠিতে আল মাহমুদ লেখেননি, তবে চিঠির মূল খসড়ায় এটা ছিল)। ] আমি মূর্খ লোকই বটে, তবে খোঁড়াকে খোঁড়া বললে সে দুঃখ পায়, এ কথা পি তদেরও জানা থাকলে ভালো।
গত রাত্রে সৈয়দ আলী আহসান সাহেবের সাথে আমার অনেকক্ষণ পর্যন্ত আলাপ হলো। সাথে রশীদ আল ফারুকীও ছিল। তিনিই কথাটা তুললেন। সাহিত্যের ইতিবৃত্তে আধুনিক কবিতার ওপর আলোচনার শেষাংশ তাঁর নিজের লেখা নয় বলে তিনি অকপট স্বীকার করলেন। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান সাহেবই এই কাণ্ড করেছেন। ভূমিকায় তার উল্লেখ আছে বলে জানালেন। আপনার ওপর তাঁর বক্তব্য তিনি আমার কাছে যেভাবে পেশ করলেন, তাতে তো কই মনে হলো না যে তিনি আপনার সম্বধে কোনো খারাপ ধারণা পোষণ করেন। বরং আপনার কবিতার আঙ্গিক গঠনের নতুনত্ব আমাকে বোঝাবার প্রয়াস পেলেন। শুধু তাঁর সমালোচনা এইটুকুই যে, আপনি কিছু কিছু রচনায় এমন কিছু উপমা ব্যবহার করেছেন, যা হৃদয়ের চেয়ে বুদ্ধিই বেশি গ্রাহ্য করে। এটা যে খারাপ, এটাও তাঁর বক্তব্য নয়। তিনি যখন আমাদের সাথে আলোচনা করছিলেন, তখন চট্টগ্রাম রেডিও থেকে পূর্ব-পাকিস্তানের সাহিত্যের ওপর তারই রেকর্ড করা একটি ভাষণ প্রচার করা হচ্ছিল। তিনি সেদিকে আমার মনোযোগ আকর্ষণ করলে আমি শুনলাম, তিনি আপনার ওপর সহৃদয় আলোচনা করছেন।
পূর্ব-পাকিস্তানে যে কজন পূর্বসূরির প্রতি আমার শ্রদ্ধা কোনো দিন খাটো হবে না, তাঁদের মধ্যে আবুল হোসেন, সিকান্‌দার আবু জাফর, সৈয়দ আলী আহসান ও শওকত ওসমানের নাম আমি কোনো দিন ভুলব না। অন্যের প্রতি আমার কোনো শ্রদ্ধা নেই তা নয়, তাঁদের সাথে আমার ব্যক্তিগতভাবে মেলামেশার সুযোগ খুব কম হয়েছে। কিন্তু ওপরে তিনজন আমার লেখক জীবনের অনেকখানি জুড়ে আছেন। এঁদের ব্যক্তিত্ব, ভালোবাসা ও উপদেশ থেকে অনেক কিছু গ্রহণ করেছি।
আমার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ আমি ফজল ও শহীদের নামে উৎসর্গ করব। আর ‘সোনালি কাবিন’ নামে একটি সনেট সংকলন আপনার নামে। এ তিনজনের সাথেই আমার সম্পর্ক সহোদরের মতো। বন্ধুত্ব, ঈর্ষা, মনোমালিন্য ও ঐকমত্য যদি প্রগাঢ়ভাবে কারও সাথে জীবনব্যাপী বিনিময় করা যায়, তাহলে সে লোক তো আপনারাই, কোনো রক্তসম্পর্কের আত্মীয়-কুটুমের সাথেও আমার এ ধরনের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়নি। আমার মনে হয় শিল্পীদের তা কোনোদিন হয়ও না। ‘সোনালি কাবিন’ নামে যে গ্রন্থটি প্রকাশিত হবে, তার কিছু অংশ অর্থাৎ প্রথম সাতটি সনেট এ সংখ্যা ‘সমকাল’–এ বেরোবে। ‘সমকাল’ অফিসে কবিতার ফর্মাটা দেখলাম। ছাপার কিছু কিছু ভুল থেকে গেছে যেমন ১নং সনেটে যেখানে হবে অনায সেখানে অনার্য, ২নং সনেটে প্রাচীনের জায়গায় প্রাচীর, ৭নং সনেটে শলা-এর জায়গায় শালা ছাপা হয়েছে। আরও কিছু কিছু ছাপার ভুল আছে হয়তো, যা এ মুহূর্তে আমার নজরে পড়েনি। আপনার প্রতি আমার অনুরোধ, কবিতাগুলো আপনার কেমন লাগল, আমাকে পরবর্তী চিঠিতে জানাবেন। এখনো ‘সমকাল’ বেরিয়ে না থাকলে আপনি তো ‘সমকাল’ অফিসে যান, একফাঁকে জাফর ভাইকে বলে দেখে নিতে পারেন। এর পরের সংখ্যায় আরও সনেট ছাপা হবে, যার কিছু অংশ ইতিমধ্যেই জাফর ভাইয়ের হস্তগত হয়েছে।
পরে এই রচনাগুলো গ্রথিত করে ছাপার ব্যাপারে আমার একটা পরিকল্পনা আছে। হয়তো এ কথা আপনাকে বলেছিলামও। পঁচিশটি সনেট দিয়ে একটি বই করব। প্রতিটি রচনার বাম পাশের পৃষ্ঠায় থাকবে একটি করে রেখাচিত্র। চিত্রগুলো আঁকবেন এখনকার প্রবীণ ও নবীন চিত্রকরেরা। আমি এ ব্যাপারেই আসলে ঢাকায় গিয়েছিলাম এবং হাশেম খানের সাথে এ ব্যাপারে আলাপও করে এসেছি। তিনি কথা দিয়েছেন, তাঁর সাধ্যমতো করবেন এবং সমকালীন পঁচিশজন চিত্রকরের রচনা আদায় করে দেবেন।
এখন কথা হলো, আমার তৃতীয় বইয়ের নাম বোধহয় পরিবর্তন করতে হবে। আমি আমার একটি কবিতার নামে নাম রাখব ভেবেছিলাম ‘অবগাহনের শব্দ’। কিন্তু কাইয়ুম চৌধুরী টেলিফোনে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে জানালেন, নামটা তার মনমতো নয়। আমি জানি, তিনি আমার কবিতার অনুরাগী পাঠক। প্রায়ই এ কথা আমায় বলে থাকেন। আমিও তাঁর অনেক চিত্রে আমার মনের সমর্থন খুঁজে পাই। তাই ভাবছি, আমি আমার মত পাল্টাব। অন্য কেউ এ কথা বললে আমার বিরক্ত লাগত, কিন্তু কাইয়ুম চৌধুরীর অনুরোধে একটি বইয়ের নাম পাল্টাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। এই বইটি প্রকাশ করবেন এখানকার একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান—নাম ‘প্রজ্ঞা প্রকাশনী’। আমি তাদের কাছ থেকে পাণ্ডুলিপি হস্তান্তর না করেই দেড় শ টাকা নিয়েছি। ‘সোনালি কাবিন’-এর জন্য আমার একজন প্রকাশক দরকার। ‘বইঘর’-এর সাথে এ ব্যাপারে যেচে আলাপ করতে আমার ইচ্ছা নেই। আর ছোটদের কবিতাগুলি দিয়ে এরা আমার একটা বই ছাপাবে বলে আমি আর এদের অন্য কোনো কবিতার বই দিতে চাই না। এ ব্যাপারে মাওলা ব্রাদার্সের সাথে একটা যোগাযোগ ঘটাতে পারলে ভালো হতো। আপনি কি আমার হয়ে তাদের সাথে একটু আলাপ করবেন? আমার মনে হয়, আপনি আলোচনা করলে আমার বইটি নিখুঁত হয়ে বেরোবে। এ সম্বন্ধে আপনার চিঠিতে কিছু উল্লেখ করবেন।
আমার কবিতা সম্বন্ধে আপনার মতামত কোনো দিন স্পষ্ট জানতে পারিনি। যদিও আমার লেখা আপনার ভালো লাগে, এ ধরনের আশ্বাস বহুবার আপনার কাছ থেকে পেয়েছি। আমাকে ও শহীদকে আপনি অত্যন্ত ভালোবাসেন, এটা আমরা উভয়েই জানি। আপনার সাথে শহীদের যে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়েছে, এটা সাময়িক। শহীদ তার নিজের জালে আটকা পড়েছে। অত্যন্ত অভিমানী ছেলে, কিন্তু মুখ সামলে কথা বলতে জানে না। আমার সম্বন্ধে তো মাঝে মাঝে যা–তা বলে। সেদিন তো একটা ব্যাপার আপনাকেই বললাম। দেখুন, কী কাণ্ড! এটা হতো না, যদি আমি ঢাকায় থাকতাম। আমার অনুপস্থিতির ফাঁকটা সে যাদের দিয়ে পূরণ করেছে, তারা কেউ কবি নয়। অনবরত শহীদ তাদের কাছ থেকে প্রশংসা আদায় করে নকল স্বর্গে আরোহণ করছে আর অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। শহীদ যাদের সাথে এখন মেশে তারা কেউ জ্ঞানে, বুদ্ধিতে ও প্রতিভায় শহীদের সমকক্ষ নয়। তাদের সাথে সমীহ করে কথা বলবার তার কোনো প্রয়োজনই নেই। কিন্তু আমরা যখন একত্র ছিলাম, তখন আমাদের অজ্ঞাতেই ভারসাম্য রক্ষিত হতো। ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপ যা শহীদ অহরহ তার সঙ্গে নিয়ে ফিরত, তা–ও ছিল আনন্দদায়ক। যা হোক, শহীদের ওপর আপনি নির্দয় হবেন না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি, শহীদ আপনাকে কী পরিমাণ শ্রদ্ধা করে। একটা জিনিস মনে রাখবেন, একদল লোক সব সময় আমাদের সৌহার্দে ফাটল ধরিয়ে স্বার্থসিদ্ধির তালে আছে। আজ দশ বছর সাহিত্য প্রয়াসের পর যখন এটা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে পূর্ব বাংলার—শুধু পূর্ব বাংলা কেন, মোটামুটি বাংলা ভাষার প্রবহমান কাব্যধারার কারা প্রতিনিধিত্ব করেন, তখন প্রগতিশীল খেতাবপ্রাপ্ত একদল লোক যারা ১৯৫২ সালের ভাষা বিক্ষোভের সময় এ দেশে আঁতেলেকচুয়াল বলে নিজেদের জাহির করার অবাঞ্ছিত সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল, তাদের গাত্রদাহ আরম্ভ হয়েছে। সত্যমূল্য না দিয়ে যারা সাহিত্যের খ্যাতি চুরি করে, তাদের ধস নামা কেউ ঠেকাতে পারবে না। ঢাকায় হম্বিতম্বি করলেও সারা প্রদেশে তাদের সুনাম ক্রমান্বয়ে অবসিত হচ্ছে। প্রদেশের কথা বললাম এ জন্যে যে এ সম্বন্ধে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে।
বিশেষ আর কী লিখব। সমকাল–এ প্রকাশিতব্য লেখার ওপর আপনার মতামতের জন্যে অধীর অপেক্ষায় থাকব। আমার আগ্রহ দেখে আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, সনেটগুলোতে আমি বোধ হয় নতুন কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। তা করিনি। আমি অন্যান্য কবিতায় যা করি, এগুলোতেও তা–ই করেছি। কিছু মনোরম আঞ্চলিক শব্দ, সংস্কৃত তৎসম শব্দের পাশে আমার পক্ষে যত দূর সম্ভব নিপুণতার সাথে গেঁথে দিয়েছি। এভাবে আমার কবিতার জন্যে আমি একটি ভাষা সৃষ্টি করতে চাই। বিষয়বস্তু হিসেবে নিয়েছি প্রাচীন ইতিহাস, প্রেম ও স্বাজাত্যবোধ। এই স্বাজাত্যবোধ উগ্র জাতীয়তাবাদের নামান্তর নয়। সমাজ সম্বন্ধে আমার ধারণাও এতে অতি সরলভাবে বিবৃত হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। যেটুকু জাতীয়তাবাদী মনোভাব কবির না থাকলে চলে না, ঠিক ততটুকু আমার অন্যান্য কবিতাতেও আপনি হয়তো লক্ষ করে থাকবেন। ইতি—
আপনার স্নেহসিক্ত
আল মাহমুদ। ২৮-১১-৬৮
আল মাহমুদের চিঠিটা আমার কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। আমি সম্প্রতি বিউটি বোর্ডিং গিয়েছিলাম। প্রাচীন সেই ভবনের পুরোনো স্থাপত্যরীতি, বর্তমানের হলদেটে রঙের আড়ালে ঢেকে রাখা পুরোনো দিনের ইট, হয়তো বা চুন-সুড়কির সঙ্গে, আমাদের প্রথম আধুনিক কবিদের শ্বাস-প্রশ্বাস হয়তো এখনো লিপ্ত আছে। বিউটি বোর্ডিংয়ে যখন পঞ্চাশ-ষাটের দশকের শ্রেষ্ঠ কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-চলচ্চিত্রকারেরা আড্ডায় মাততেন, তখনকার দিনরাত্রিগুলো কেমন ছিল! এটা আমরা এখন কেবল কল্পনা করতে পারব, প্রবীণেরা স্মৃতিতর্পণ করতে পারবেন, কিন্তু টাইমমেশিন তো হাতে নেই যে সেই সময়টা পুনর্নির্মাণ করতে পারব।
আল মাহমুদ লিখেছেন শামসুর রাহমানকে: ‘আমার পরিষ্কার রাজনৈতিক মতামত ও আদর্শ রয়েছে। সমাজ বিশ্বাস আমার কাছে যেমন বড় কথা, সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংগ্রাম করাকে আমি তারও চেয়ে মূল্য দিয়ে থাকি। এর জন্যে নিশান নিয়ে রাস্তায় নামতে আমার আর কোনো দ্বিধা নেই। দরকার হলে পার্টি সংগঠনের মধ্যে থেকে কাজ করব, রাস্তায় রাস্তায় পোস্টার সাঁটব। কবিতা লেখার মতোই এসব কাজ আমার জীবনের সাথে যুক্ত।’
এর সঙ্গে যুক্ত করতে হয়, ‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়।’ মুনীর চৌধুরীর ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নাটকের সংলাপ। আল মাহমুদও বদলেছেন।
শামসুর রাহমান বলতেন, তিনি ছিলেন বুদ্ধদেব বসুর মতানুসারী, অনেকটাই কলাকৈবল্যবাদী। তাঁর বন্ধু হাসান হাফিজুর রহমান ছিলেন রাজনীতিসচেতন এবং রাজনীতি-সক্রিয়। হাসান হাফিজুর রহমান বামপন্থী ছিলেন। শামসুর রাহমান তাঁর সঙ্গে একমত হতেন না, ভাবতেন, কবিদের রাজনীতি থেকে দূরে থাকা উচিত। পরে, ১৯৮৭ সালে জাতীয় কবিতা উৎসব করার সময় তিনি লিখলেন, তিনি এই মত থেকে দূরে সরে এসেছেন। রাজনীতি মানুষের জীবনকে অনেকটাই প্রভাবিত করে। কবি তা থেকে মুখ ফিরিয়ে গজদন্তমিনারবাসী হয়ে থাকতে পারেন না।
পোলিশ কবি চেশোয়াভ মিউশ বলেছিলেন, কাকে বলে কবিতা, যদি তা না বাঁচায় দেশ কিংবা মানুষকে!
দেশ বা মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্নে কবিতা গৌণ হয়ে ওঠে, কিন্তু দেশ কিংবা মানুষকে উন্নততর ভাবে, সুন্দরতরভাবে বাঁচাতে কবিতার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই বা কী আছে?
তথ্যসূত্র
শামসুর রাহমানকে আল মাহমুদের চিঠিটা ১৯৬৮ সালে লেখা। ‘সমকাল’ পত্রিকায় ‘কালের খেয়া’য় ১২ জুলাই ২০১৯ সংখ্যায় শামসুর রাহমানকে লেখা আল মাহমুদের একটা চিঠি প্রকাশিত হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *