বরিশালের সংগ্রামী কবি বশিরুজ্জামান জীবন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে বর্তমানে বরিশাল নগরীর রূপাতলী গ্যাসটারবাইন এলাকার সামিট গেইট এলাকায় নিজের জরাজীর্ণ বাসায় মৃত্যুর প্রহর গুণছেন তিনি। ২০ জুলাই দ্বিতীয়বার ব্রেইন ষ্টক করার পর থেকে তার শরীরের বাম সাইড অবস হয়ে যায়। সেই তিনি কোন কথা বলতে পারছেন না, শুধু অপলক দৃষ্টিতে ফ্যাল ফ্যাল করে স্বজনদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ঠিক যেমনটি হয়েছিলো- জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের শেষ জীবনে।
‘‘মা, আছিয়ারা যেখানে আছে ওদের সেখানেই থাকতে বলো; পানতা ভাত আর কচুশাক খেয়ে আছিয়ারা বেশ ভালো আছে! মা, বিশ্বাস কর……..আমরা আজও স্বাধীনতা পাইনি। একমুঠো ভাতের নাম আছিয়ার ঈদ আছিয়ার গণতন্ত্র, আছিয়ার স্বাধীনতা’” -প্রতিবাদী লেখক, সংগ্রামী কবি বশিরুজ্জামান বশির। সাহসী একজন কলম সৈনিক, গণমানুষের কবি হিসেবেও অনেকে তাকে জানেন। নব্বই দশক থেকে আপসহীন লেখনীর গতি তার। ঝাকড়া চুলের বাবরীওয়ালা নিরঅহংকার, নির্লোভ ও নির্ভেজাল সাহিত্য অঙ্গনের এক সাদা মনের মানুষ বলা যায় কবি বশিরুজ্জামান বশিরকে।
তিনি একাধারে কবি, লেখক, সম্পাদক, প্রকাশক, পরিচালক ও বেতার সংগঠক। ১৯৭৪ সালের ২৫ জানুয়ারি চরকাউয়া ইউনিয়নের পেটকাটা গ্রামে মুন্সী বাড়িতে জন্ম কবি বশিরের। পিতা মৃত রসুল আলী মুন্সী, মা রওশন আরা বেগম মিনারা আর তার সহধর্মিনী আছিয়া বেগম আদুরী, তিন ছেলে ও এক মেয়ে খাদিজা আক্তার শিউলী, মোহাম্মদ রিয়াজ মুন্সী, মোহাম্মদ রাহিম মুন্সী, মোহাম্মদ রাতুল মুন্সী।
বরিশাল শহরের গ্যাস্টারবাইন সড়কের কবি নিবাস। অনেকটাই যেন কবি দুখু মিয়ার আরেক নাম কবি বশির। ১৯৮০ সালে কবি বশিরুজ্জামান বশির এর বাবা রসুল আলী মুন্সী মৃত্যুর মাধ্যমে পরিবারের দুখের জীবন শুরু হয়। তার মা রওশন আরা বেগম মিনারা স্বামীকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন। কবি বশিরের মা জীবিকার সন্ধানে শিশু সন্তানকে নিয়ে বরিশালে চলে আসেন। ১৯৮১ সালে তার মা শিশু সন্তান বশিরকে নিয়ে বরিশাল জর্ডন রোড়ে ওয়াইএমসি নামক একটি খ্রিস্টান মিশন স্কুলে বিনা বেতনে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করেন। দ্বিতীয় শ্রেণীতে সে প্রথম স্থান অধিকার করেন। সেখানে দ্বিতীয় শ্রেণীর পর লেখা পড়ার ব্যবস্থা না থাকায় ঝালকাঠি জেলার সরকারি শিশু সদনে তাঁকে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত প্রথম স্থান লাভ করেন কবি বশির। লেখা পড়ায় মেধাবী হলেও ১৯৮৯ সালে এতিম খানায় অষ্টম শ্রেণীতে দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা দিয়ে পড়ালেখা সমাপ্তি করে বাড়িতে চলে আসেন তিনি। এখান থেকেই শুরু হয় জীবন যুদ্ধের পথচলা।
১৯৮৯ সালে ৫০০ টাকা নিয়ে সাগর লঞ্চে মাত্র ১০ টাকায় ঢাকা চলে আসেন। ভাগ্যের কি পরিহাস লঞ্চে বসেই পকেট মার একমাত্র সম্বল ৫০০ টাকা পকেট কেটে নিয়ে যায়। ঢাকায় কোন আত্মীয় না থাকায় তাকে অনেক দিন রাস্তায় রাত যাপন করতে হয়েছে। রঙ্গিন আলোয়ে ঝলমলে ঢাকার শহরে প্রথম এসে রাতে গুলিস্তান বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের বারান্দায় রাত কাটান। ঐ রাতেই তার হাতের ব্যাগসহ জামা কাপড় চোরে নিয়ে যায়। একটু মাথা গোঁজার ঠাই খুঁজে প্রথমে শ্যামবাজার ঠেলা গাড়ির হেল্পার, সুত্রাপুরের ব্রীজে রিক্সা চালান দুই মাস। পেটের ক্ষুধা নিবারন করতে নরসুন্দরের কাজও করতে হয়েছে তাকে। অনেকদিন গুলিস্তান থেকে গাবতলী পায়ে হেটে দোকানে দোকানে কাজ খোঁজেন কোথাও কাজ মেলেনি। এদিকে অনেক দিন ছেলের খবর না পেয়ে মা তার ছুটে আসেন ঢাকায়। অনেক খুঁজতে খুঁজতে গাবতলী বাস টার্মিনালে দেখা মেলে মা-সন্তানের।
এতিমখানায় থাকাকালীন ৮৮ এর বন্যা তাকে মর্মাহত করে। দারিদ্রের কশাঘাত তাকে দিন দিন খাটিঁ মানুষে পরিনত করে। সাধারণ মানুষের পক্ষে দাড়াঁতে তিনি কলম হাতে তুলে নেন। প্রচন্ড প্রতিবাদী কবির হৃদয়কে প্রতিনিয়ত তাড়া করে অসহায় মানুষের ছবি। তাইতো তিনি বলেন- ‘দেশ ও মানুষের কল্যাণে অনেক কিছু লেখার ক্ষমতা আছে কিন্তু সংবাদপত্রের তা প্রকাশের ক্ষমতা নেই’। কবি তার স্বাধীনতা না পাওয়ার কাব্য-৮ এ বলেন-
‘‘ডাস্টবিনের পাশে বসে
দিন-রাত কাঁদছ কেনো?
একান্ত উচিত ছিল আমার
শিশুটিকে প্রশ্ন করব;
অথচ শিশুটি উল্টো আমাকে
প্রশ্ন করল, এখানে কী চান?
আমরা কি স্বাধীনতা টোকাই!’
কবির লেখালেখি শুরু ১৯৮৮ সালে ‘গরীরেব স্বপ্ন’ শীর্ষক একটি চলচিত্র কাহিনী দিয়ে। এরপর তিনি অসংখ্য কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, গান, উপন্যাস রচনা করেন, লেখালেখির পাশাপাশি প্রকাশনার কাজও করেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ প্রায় ১৫টি। সম্পাদিত গ্রন্থ ৩৫টি। তার মধ্যে “আমার সেই মুক্তিযোদ্ধা, আবার আমরা যুদ্ধে যাব, বাংলার মাটি ছাড়, স্বদেশ জরিপ, আলোচনা শেষ এখন শুধুই স্বপ্ন দেখার পালা, ভূমিহীন প্রেমিকের স্বপ্ন, ভূতের পাঠশালা, বাদশার বাদশাহী, রাতুল মামা ভূত চোর, একদিন তুমি কাদবে, বন্ধু হতে চাই, কাছে এসে বলো, পিংকির বিড়াল রহস্য, এইডস প্রতিরোধের ছড়া, ছড়ায় বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ, এসিড সন্ত্রাস প্রতিরোধের ছড়া, পিয়াজের গণতন্ত্র উল্লেখযোগ্য।
বশিরুজ্জামান বশির মাসিক সময়, আনন্দসহ কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি দেড় সতিনের ঝগড়া নামে একটি কমেডি এ্যালবাম পরিচালনা করেন। তার প্রকাশনী ‘রাতুল গ্রন্থপ্রকাশ’। এছাড়া ‘কিশোর কলম’ ও কবি বশিরুজ্জামান সাহিত্য পরিষদসহ চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে বই প্রকাশ করেন। স্বদেশ মৃত্তিকা রেডিও শ্রোতা ক্লাব পরিচালনা করেন।
২০২৩ সালের জাতীয় গ্রন্থমেলা শেষ করতে না করতেই মার্চ এর প্রথমদিকে কবি বশিরুজ্জামান বশির ব্রেইনষ্টক করেন। অনেকটা আরোগ্য লাভের পথে ঠিক সেই সময় ২০ জুলাই আবার তিনি দ্বিতীয়বার ব্রেইনষ্টক করে ঢাকা শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। তার চিকিৎসার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন কিন্তু পরিবারের সে সামর্থ্য নেই বলে জানিয়েছেন ছেলে রাতুল। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের কাছে তাই সাহায্যে আবেদন নিয়ে ঘুরছেন তারা।
বরিশাল সাহিত্য সংসদ এর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কবি জিল্লুর রহমান জিল্লু সাহিত্যে কিছুক্ষণ আড্ডায় তার অবস্থা তুলে ধরেন। এ সময় সভাপতি কাজী মিজানুর রহমানসহ সদস্যরা কিছু সহযোগিতা করলেও তা মোটেও পর্যাপ্ত নয় বলে জানান জিল্লুর। তিনি এসময় কবি বশিরের বড় ছেলে মোঃ রিয়াজ মুন্সি ০১৭১৬১৮৬৫৩১ এর ফোন নম্বর তুলে ধরে সাহিত্য সংস্কৃতিমনা সবাইকে সহযোগিতার আহ্বান জানান।