সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে মুক্তবুলি

মোহাম্মদ নূরুল্লাহ ।। 

তোমার সঙ্গে আমার পরিচয়, তোমার যখন বয়স তিন বছর;

ঠিক অমনি সময়ে পড়েছি তোমারি প্রেমে; হে প্রাণের মুক্তবুলি!

তোমাকে নিয়ে লিখেছি পূর্বেও কয়েকটি চরণ,

‘ভালোবাসি মুক্তবুলি’ কবিতায়।

মানুষের জীবন ও সাহিত্য অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একজন রুচিশীল মানুষ যেমনি সাহিত্যকে লালন করে; ঠিক তেমনি সংস্কৃতির ঝর্ণাধারায় অবগাহন করে প্রতিনিয়ত। মানব জাতির চিন্তা ও সুপ্ত প্রতিভার বিকাশে সাহিত্য প্রতিনিয়ত অনুপ্রেরণা দেয়, বাহ্‌বা দেয়, ক্রিকেটীয় দর্শকের মতো করতালি দিয়ে। সিক্স-ফোরের প্লাকার্ড উঁচু করে ধরে।

সাহিত্যের প্রভাব অস্বীকার করার উপাউ নেই। একজন সুস্থ বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তি স্বতঃফূর্তভাবে নিজের অজান্তেই সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। ড. মুহাম্মদ আব্দুল মুনিম খানের উক্তি এতদপ্রসংগে স্মরণীয়:

‘যে শক্তির দ্বারা মানুষের ব্যক্ত অনুভূতি আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর হয়ে ওঠে সেই শক্তিই হচ্ছে সাহিত্য। কেউ যদি সুস্থ বিবেক ও সজীব রুচি থেকে বঞ্চিত না হয়, তার উপর সাহিত্যের প্রভাব পড়বে।‘

উদ্ধৃত, মহানবি (স.) এর সাহিত্যপ্রীতি ও সংস্কৃতিবোধ, ভূমিকাংশ, প্রবন্ধ, অগ্রপথিক, পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি  (সা) সংখ্যা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, জানুয়ারি -২০১৪,পৃ.23

জীবন যেখানে যেমন। কবি সাহিত্যিকগণ জীবনের নানা অভিজ্ঞতা কলমের তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলেন। চারদিক চারপাশ। ভালো মন্দ। আকাশ। সমুদ্র। অন্তরীক্ষ। খগোল। ভূগোল। সবি যে সাহিত্যের কথা বলে। মানব জাতির জন্যে যা কিছু সত্য। যা কিছু কল্যাণকর। যা স্বস্তি দেয়। যা বেদনা লাঘব করে তাকেই আমরা সাহিত্য বলে অভিহিত করতে পারি। সাহিত্যবিষয়ক আলোচনা সমালোচনায় নানামুনি নানামত ব্যক্ত করেছেন।

  • কেউ কেউ বলেন, ‘The Best words in the best ’*–Coleridge
  • কেউ কেউ এ মতের সমর্থন করেন, ‘Our sweetest songs are those  that  tell of  saddest thought.’*-Percy Bysshe Shelly
  • আবার কেউ এ মতকে অকপটে স্বীকার করেছেন, ’Beauty is truth, truth beauty’*  -John Keat    ***সূত্র: ইন্টারনেট
  • এভাবে ‘সত্যম্‌ শিবম্‌ সুন্দরম্‌’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

মুক্তবুলি এ সত্য বিকাশে অন্ধকার পথে লন্ঠন নিয়ে আলোকবর্তিকা হয়ে সাহিত্যাকাশে সেতারার মতো জ্বলজ্বল করছে। হাটি- হাটি পা-পা করে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি প্রতিনিয়ত লালন করে চলেছে মুক্তবুলি।

এ পর্যায়ে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে সাহিত্য সম্পর্কে আলোকপাত করতে চাই।

সাহিত্য সম্পর্কে প্রিয়নবি হযরত মুহম্মদ (স.) চমৎকার মতামত ব্যক্ত করেছেন। প্রিয়নবি (স) এর মন্তব্য এতদ্‌প্রসংগে স্মরণীয়:

সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী, প্রখ্যাত সাহাবি হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেন, তিনি মহানবি (স) কে বলতে শুনেছেন, ’যে বাণীর বিন্যাস হয়েছে কোনরূপ চিন্তাভাবনা ছাড়াই, সে বাণী তাকে নিয়ে যাবে পূর্বপশ্চিমের ব্যবধানের চেয়েও  আরো দূরে নরক গহ্বরে।‘  –  বুখারি ও মুসলিম

এ হাদিস থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই, তাহলো  সত্য ও সুন্দরের সাধনা করে সাহিত্য রচনা করতে হবে। রাসূলুল্লাহ্‌ (স.) অলংকারপূর্ণ ও মর্মস্পর্শী ভাষায় কথা বলতে পছন্দ করতেন। তাঁর মুখ নিঃসৃত বাণীতে বাগধারা, উপমা, উপদেশ প্রদান ও বক্তৃতায় সাহিত্যের এসব অলঙ্কার ব্যবহার লক্ষণীয়। মহানবী (সা) এর সাহিত্যপ্রীতিও উল্লেখ করার মতো। উম্মাহাতুল মুমিনিন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা) বর্ণনা করেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, আচ্ছা মহানবি (সা) কি বক্তৃতায় কখনো কবিতার উদাহ্‌রণ নিয়ে আসতেন, তিনি উত্তরে বললেন, হ্যাঁ, কখনো উপমা দিতেন। হযরত তারাফ বিন আবদের ‘অনাগত কাল শেখাবে তোমায় যা তুমি জানতেনা এবং নিয়ে আসবে খবর কভু যা শোননি।‘ এ কবিতা দিয়ে   -তিরমিযি

মুক্তবুলি ইসলামের এ সুমহান আদর্শকে ভিত্তি করে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সত্যের অনুসন্ধান করার প্রয়াস পেয়েছে। প্রতিটি সংখ্যায় নতুন নতুন বিষয়কে কেন্দ্র করে লেখার সূত্রে, খ্যাতিমান বিশিষ্ট কবি সাহিত্যিকদের সঙ্গে বিনে সুতোর মালায় গেঁথে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত পরস্পরে। একে অপরের সঙ্গে দৈহিক সাক্ষাৎ না হলেও মুক্তবুলি আমাদেরকে অসাধারণ মেলবন্ধনে আবদ্ধ করেছে। পাঠক-লেখকের  এক মধুরতম সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে মুক্তবুলির ভূমিকা অনন্য।

মুক্তবুলির প্রকাশক ও সম্পাদকের কথা না বললেই নয়, বয়সে আমার অনুজ হলেও ওর চিন্তা, চেতনা, বুদ্ধিমত্তা প্রসংসার্হ। একটি বীজ বপন করে  একজন কৃষক যেভাবে প্রতিনিয়ত, প্রতিদিন সকাল-বিকাল এর যত্ন আত্তি করেন; রোদে বুঝি গাছটা হেলে পড়লো, বাতাসে কিংবা একটু ঝড়ে গাছটা ভেঙ্গে যাবে; এই ভয়ে কৃষক যেভাবে চিন্তামগ্ন থাকেন; মুক্তবুলি সম্পাদনার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। সম্পাদক ও প্রকাশক আযাদ আলাউদ্দীন পত্রিকাটি প্রকাশের শুরু থেকে ২২তম সংখ্যা পর্যন্ত পরম যত্নে পত্রিকাটি যেভাবে লালন করে চলেছেন, তা সত্যিই বিরল নজির স্থাপন করেছে। প্রতিটি সংখ্যার বিষয় বৈচিত্র্য লেখক এবং পাঠককে সৃষ্টিশীল চিন্তার খোরাক জোগায়; নতুন দ্বার উন্মোচন করে। সাহিত্যের পাশাপাশি পত্রিকাটি স্বাস্থ্য, ঐতিহ্য, ধর্ম-দর্শন, স্মৃতিচারণ প্রভৃতি বিষয়ে লেখা প্রকাশের মাধ্যমে আমাদের তাহ্‌জীব, তা’লীম, তামাদ্দুন, তা’দীব ইত্যাকার সংস্কৃতির বিষয়গুলো লালন করে যাচ্ছে; যা সার্বিক ভাবধারায় পরিস্ফূটিত এবং মুক্তচিন্তার অবারিত সুযোগ করে দেয়। নতুন লেখক তৈরির ক্ষেত্রে এ পত্রিকাটির ভূমিকা অনস্বীকার্য।

সুতরাং নাতিদীর্ঘ এ আলোচনার ক্রান্তিতে এসে আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে যথার্থ পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাংলা ভাষা, বাংলাভাষাভাষী মানুষ যতদিন থাকবে এ জগতে; মুক্তবুলি সুবাস ছড়াবে ততদিন বিশ্বসহ বাংলার আকাশে বাতাসে।

মোহাম্মদ নূরুল্লাহ, সহকারী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ফরিদপুর । 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *