বেগম ফয়জুন নাহার শেলী ।।
কলেজে যাব একটি কাজে। তাই যার কাছে কাজ তিনি আছেন কি না জানতে সহকর্মী শফিকুর রহমানকে ফোন দিলাম। তিনি বললেন, আপা কাল আসেন। আজ বন্ধ। আমি জিজ্ঞেস করলাম- কিসের বন্ধ? জবাব এলো ‘আজ আখেরি চাহার সোম্বা।’ জবাব শুনে আমার সমস্ত দেহ মনে একটা শিহরণ জেগে উঠলো। ইয়া আল্লাহ! কি করে এই দিনটি ভুলে গেলাম । ১২ রবিউল আউয়াল মনে আছে অথচ আখেরি চাহার শাম্বে মনে নেই। কিভাবে এটা হয়? এযে আমার প্রিয় নবীজি (স.)র পার্থিব জীবনে সুস্থ হয়ে ওঠার শেষ দিন। সাহাবীরা এই দিনটিতে তাঁদের প্রিয় নবী (স.) এর সুস্থ হওয়ার আনন্দে তাঁদের দাসমুক্তি, উট ও সাধ্যমত অর্থ দান করে আল্লাহ শুকরিয়া আদায় করেছিলেন। নবীজি সুস্থ হলে হযরত আয়েশা (স.) তাকে গোসল করিয়ে মসজিদের সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে পাঠালেন। সেদিনের পর তিনি আবার অসুস্থ হলেন এবং ১২ ই রবিউল আউয়াল নিখিলের চির সুন্দর ফুল, মানবজাতির উত্তম আদর্শ, আমাদের কাছ থেকে শারীরিকভাবে বিদায় নিলেন। রেখে গেলেন আল্লাহর অমোঘ বাণী আল কুরআন ও তাঁর দেখানো পথনির্দেশনা।
অনেকের এই জানা কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করলাম। কারণ আমি যখন ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের রেডিও তেহরানে কাজ করতাম তখন এই দিনটির উপর বহির্বিশ্ব কার্যক্রমের দেয়া একটি স্ক্রিপটের অনুবাদ শুনিয়েছিলাম শ্রোতাদের। আরেকটু ব্যাখ্যা দিচ্ছি, আখেরি চাহার শাম্বে শব্দটি আরবি ফার্সি মিশ্রিত ভাষা। আখিরি আরবি শব্দ অর্থাৎ শেষ আর চাহার শাম্বে অর্থাৎ বুধবার । ফার্সি ভাষায় সপ্তাহের শুরু শনিবারকে বলা হয় শাম্বে। রবিবার- এক (১) শাম্বে, সোমবার- দো (২) শাম্বে, মঙ্গলবার- ছে (৩) শাম্বে বুধবার -চাহার (৪) শাম্বে, পাঞ্জ (৫) শাম্বে বৃহস্পতিবার আর শুক্রবার জুম্মে। এভাবে আখেরি চাহার শাম্বে অর্থাৎ শেষ বুধবার। মুসলিম বিশ্বে রবিউল আউয়াল মাসের পূর্বের মাস সফর মাসের শেষ বুধবারকে বলা হয় আখেরি চাহার শাম্বে বা আখেরি চাহার সোম্বা। এবারে যার কারণে এ লেখা সে অনুবাদটি যতটুকু মনে পড়ে তাই বলছি:-
সফর মাসের শেষ বুধবার নবীজি (স.) কিছুটা সুস্থ হয়ে স্নান সেরে মসজিদে নববীতে গেলেন সালাত আদায় করতে। জীবনের শেষ ইমামতির শেষে তিনি সবার কাছে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনারা কেউ কি আমার কাছে কিছু পান?’ সমস্ত সাহাবীগন নিরব। না, নবীজি কারো কাছে দেনাদার নন। এমন সময় নিরবতা ভেঙ্গে একজন কাফ্রী ক্রীতদাস দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমি পাই’।
: কত পান?
: অর্থ নয়, অন্য কিছু।
: কি সেই অন্যকিছু?
: আমি একদিন আপনার উটের যত্ন নিচ্ছিলাম হঠাৎ করে একটা চাবুক ফস্কে গিয়ে আমার শরীরে আঘাত হানে। আমি সেই আঘাতের প্রতিদান চাই।
: বেশ তো। আপনি প্রতিদানে কত চান?
: আমি কোন অর্থ চাই না। আমি আঘাতের বিনিময়ে আঘাত দিতে চাই।
উপস্থিত সাহাবাগণ হাহাকার করে উঠলেন। বললেন, আপনি যত চান তত দেব কিন্তু আমাদের প্রিয় রাসুল (স.) এর শরীর মুবারকে আঘাত করবেন না। এছাড়া তিনি তো একজন অসুস্থ মানুষও। দয়া করুন।’
কিন্তু কাফ্রী ক্রীতদাসটি কোন অনুরোধ শুনতেই রাজি নয়। তিনি আঘাতের বিনিময়ে আঘাতই দিবেন। অগত্যা কি করা।মানুষের দাবি থেকে মুক্তি লাভের জন্য রাসুল( স.) তাকে আঘাত দেওয়ার জন্য আহবান করলেন । ক্রীতদাস চাবুক হাতে নবী (স.)এর দিকে এগিয়ে আসছেন। তার এক একটা পদক্ষেপে সাহাবীরা হাহাকার করে উঠছেন। তিনি নবীজী (স.) এর কাছে এসে বললেন, ‘এভাবে তো হবে না। আমি তখন খালি গায়ে ছিলাম। আপনাকেও আপনার পোশাক খুলতে হবে।’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি সালাম তাই করলেন। সমস্ত মসজিদে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। পিন পতনের শব্দটি পর্যন্ত নেই। সাহাবীদের চোখে পানি। এমন সময় কাফ্রি ক্রীতদাস নবীজিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি আপনার দেহ মুবারক স্পর্শ করতে চেয়েছিলাম। আমায় ক্ষমা করুন।
আজও যখন আমার সেদিনটির কথা মনে পড়ে দু’চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনা। তাই বলছিলাম, কীভাবে এ দিনটিকে আমি ভুললাম? বলাবাহুল্য, এ অনুষ্ঠানটি প্রচারের পর সেদিন অনেক শ্রোতার কান্নাভেজা চিঠি পেয়েছিলাম।কারণ তাঁরাও আশেক-এ-রাসুল (স)।
বেগম ফয়জুন নাহার শেলী প্রাক্তন বাংলা প্রভাষক, বরিশাল ইসলামিয়া কলেজ এবং সাবেক অনুষ্ঠান ঘোষক, রেডিও তেহরান, ইরান।