ওবায়দুর রহমান
ইসলাম মানুষকে শান্তি ও সত্যের পথে আহ্বান করে। শান্তি ও সত্যের পথে সন্ত্রাসবাদের কোন স্থান নেই। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সর্বদা ইসলামের অবস্থান। একটি বিশেষ গোষ্ঠী ইসলামকে (ইসলামের নাম) ব্যবহার করে যখন নিজেদের স্বার্থ হাসিল, দখলদারিত্ব, সাম্রাজ্য বিস্তার ও বিশ্বে মুসলমানদের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করে ইসলামের নাম ব্যবহার করে তখন সেটা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়।
সম্প্রতি গত ২১ এপ্রিল (রবিবার) শ্রীলংকার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। এদিন ইস্টার সানডে প্রার্থনার সময় শ্রীলংকার একই সাথে র্গিজা ও হোটেলে ৮ টি সিরিজ বোমা হামলায় ৩১০ জন নিহত ও ৫ শতাধিক মানুষ আহত হয়।
হামলার পরপরই শ্রীলংকান নিরাপত্তা বাহিনী বেশ কয়েকজন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের পরিচয় শ্রীলংকান সরকার প্রকাশ না করলেও, ভারতীয় মিডিয়াতে আটককৃত ব্যক্তিদের নাম পরিচয় প্রকাশিত হয়, কিন্তু তারা কীসের ভিত্তিতে তার পরিচয় পেয়েছেন তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। শুধু ভারতীয় মিডিয়াই নয়, ইসরাঈলি কয়েকটি মিডিয়াকেও একই ধরণের প্রচার- প্রচারণা চালাতে দেখা যায়। পরে আইএস এই হামলার দ্বায় স্বীকার করলে শ্রীলংকান সরকার তাদের পরিচয় প্রকাশ করে ।
ভারতীয় মিডিয়াগুলো যখন মুসলিমদের সন্দেহ করে তাদেরই মনগড়া রিপোর্ট প্রকাশ করছিলো তখনই শ্রীলংকার মানুষ ফুঁসে ওঠে। শ্রীলংকার বিভিন্ন জায়গায় মুসলিম স্থাপনা ও মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটে। এমনকি কোনো কোনো মসজিদে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করা হয়। এই ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে কারা?
কোনো ধরনের প্রমাণ বা সুনির্দিষ্ট হুমকি না থাকা স্বত্ত্বেও যখন মুসলিমদের নাম শোনা যাচ্ছিল তখন আমার মনে হয়েছে, এই হামলার দ্বায়ভার মুসলিমদের উপরই আসবে। অবশেষে তাই হল, হামলার তিনদিন পর আইএস এই হামলার দ্বায় নিলো। তাদের দাবি, ‘নিউজিল্যান্ডের হামলার প্রতিশোধ হিসেবে তারা এই হামলাটি চালিয়েছে।’
গত ১৫ মার্চ ( শুক্রবার ) নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুই মসজিদ এ উগ্র শেতাঙ্গবাদী ব্রেন্টন ট্যারান্ট এর বর্বরোচিত সন্ত্রাসী হামলায় ৪৯ জন নিহত হয়েছে। স্থানীয় সময় বেলা ১টা ৩০ মিনিটে ক্রাইস্টচার্চের হ্যাগলি ওভাল মাঠের খুব কাছে অবস্থিত ডিনস অ্যাভ মসজিদ ও লিনউড মসজিদে এই হামলার ঘটনা ঘটে।
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা হামলার এ ঘটনাকে ‘নজিরবিহীন’ এবং ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু পশ্চিমা মিডিয়াগুলোর ব্রেন্টন ট্যারেন্টকে সন্ত্রাসী বলতে এতো সঙ্কোচ কেন? হামলাকারী অস্ট্রেলিয়ান বংশোদ্ভূত শ্বেতাঙ্গ বলে ? না কি হামলাকারী মুসলিম না এই জন্য ? মিডিয়ায় বর্তমানে একটা প্রবণতা চালু আছে। কোনো আক্রমণকারী যদি মুসলিম হয় তাকে ‘জঙ্গি’ কিংবা ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এবং ইসলামধর্মকে সামনে টেনে আনা হয়। তারা ইঙ্গিত করতে চায় ইসলাম সন্ত্রাসবাদের ধর্ম। অথচ ব্রেন্টন ট্যারেন্টের ক্ষেত্রে একবারও ধর্মের প্রশ্ন আসেনি। পশ্চিমা মিডিয়ার প্রোপাগান্ডায় বিশ্বের মানুষদের মনে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, অধিকাংশ জঙ্গি হামলার সঙ্গে মুসলমানরা জড়িত।
মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বে বর্তমানে যে অবয়ব ও আকারে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের ফিতনা বিরাজ করছে তার স্রষ্টা স্বয়ং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইহুদিবাদী ইসরাইল। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সমস্যা সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ উদ্ভব, বিকাশ ও প্রসারের ক্ষেত্রে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন এই দুই সরকারের নাম আসবে তখন তাতে অবশ্যই বর্ণবাদী ইসরাইলের জড়িত থাকার কথাও গোপন রাখার কোনো উপায় নেই। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যে এমন কোন সমস্যা নেই যেখানে দখলদার ইসরাইলের হাত নেই।
ইসলামী বিশ্ব বিশেষকরে মধ্যপ্রাচ্যের যে কোন নেতিবাচক ঘটনায় প্রকাশ্যে ও গোপনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাত থাকলে সেখানে অবশ্যই প্রকাশ্যে অথবা গোপনে ব্রিটেন ও ইসরাইলেরও হাত থাকবেই। কারণ এরা হচ্ছে বিশ্ব-লুটেরা ও সাম্রাজ্যবাদী চক্র তথা ইঙ্গ-মার্কিন-ইসরাইলি অক্ষ বা শয়তানি জোট।
সমসাময়িক বিশ্বরাজনীতিতে ৯/১১-এর ঘটনা একটি বড় ধরনের ঘটনা। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী মুসলমানবিদ্বেষী যে ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছিল, তা আজও চলমান। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মানুষ জেনেছে আল-কায়েদা নামে একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের নাম। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যে ‘ঘটনা’ ঘটেছিল, তার রেশ এখনো ফুরিয়ে যায়নি। একের পর এক ‘ঘটনা’ ঘটে চলেছে। আফগানিস্তান দখল, ইরাক-লিবিয়ায় ক্ষমতার পরিবর্তন, আইএসের উত্থানÍএসবই মূলত একই সূত্রে গাঁথা। অর্থাৎ মুসলমানপ্রধান দেশগুলোতে নেতৃত্বশূন্য করা, সারা বিশ্বে ইসলামবিদ্বেষী মনোভাব ছড়িয়ে দেওয়া, ইসলামকে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সঙ্গে তুলনা করাÍদীর্ঘ ১৭ বছর আগে যে ‘স্ট্র্যাটেজি’ রচিত হয়েছিল, তা আজও রয়ে গেছে। সন্ত্রাসী ব্রেন্টন টারান্ট কর্তৃক ৪৯ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করা এরই সর্বশেষ উদাহরণ। এর মধ্য দিয়ে এই স্ট্র্যাটেজির (অ্যান্টি ইসলাম) যে এখানেই শেষ, তা বলা যাবে না। এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটতে পারে আগামী দিনে। এটা ঠিক, বিশ্বনেতারা এ ধরনের হত্যাকা-ের নিন্দা জানিয়েছেন বটে। কিন্তু এই ‘হেইট ক্রাইম’ বন্ধে কোনো বড় ধরনের উদ্যোগ বিশ্বসম্প্রদায় নিতে পারেনি। এমনকি ইসলামিক ঐক্য সংস্থার মতো সংগঠনও এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ। ইসলামকে যে পশ্চিমা বিশ্ব ‘সন্ত্রাসী ধর্ম’ (?) হিসেবে চিহ্নিত করছে, সে ব্যাপারেও ওআইসি উদাসীন। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের উত্থান ‘অ্যান্টি ইসলামিক’ সেন্টিমেন্টকে আরো উসকে দিয়েছে। তাই কোনো কোনো গণমাধ্যম মন্তব্য করেছে এভাবে ,জুয়ান কোল নামের একজন সাংবাদিক বলেছেন, ‘আইএসআইএল বা ইসলামিক স্টেট যে অব্যাহত সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালনা করত, ট্রাম্পবাদ কি তার স্থলাভিষিক্ত বা প্রতিস্থাপিত হয়েছে’? অর্থাৎ ট্রাম্পের মতবাদ যে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ‘হেইট ক্রাইম’-এর জন্ম দিয়েছে, এটাই হচ্ছে কোলের মূল্যায়ন।
১৯৭৯ সালে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান দখল করলে সোভিয়েত দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রক্সি ওয়ার চালানোর জন্য বর্তমান ধারার সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের বীজ বপন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন তথা পাশ্চাত্য। তারা এ লক্ষ্যে পাকিস্তানের মাধ্যমে আফগান মুজাহিদ দলগুলোকে সামরিক সাহায্য ও ট্রেনিং দেয়ার কার্যক্রম শুরু করে। এ কাজে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও পাশ্চাত্য এগিয়ে চলেছে একযোগে।
আর এরই ধারাবাহিকতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান, পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় গঠন করা হয় আল-কায়দা। আর এই গোষ্ঠীই পরবর্তীতে সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে ইরাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যেরই তত্ত্বাবধানে পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রত্যক্ষ মদদ ও সহায়তায় আইএসআইএস (আইএসআইএল বা আইএস বা দায়েশ)-এ রূপান্তরিত হয়। এ বক্তব্যের সমর্থনে করঃ
Daniels প্রণীত Trump is right : Here’s proof Hillary and Obama founded ISIS (infowars.com 11-8-2016)
লেখার অংশ বিশেষ তুলে ধরছিঃ
মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করা এবং পুলিশি রাষ্ট্রের সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সিরিয়া ও লিবিয়ায় জিহাদি সন্ত্রাসী জঙ্গিদের ব্যাংকরোলিং করে, অস্ত্রায়নের মাধ্যমে (অস্ত্রে সুসজ্জিত করে) এবং সমর্থন দিয়ে হিলারি ক্লিনটন এবং ওবামাই হচ্ছেন আইএসআইএসের(ওঝওঝ) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
এমনকি ২০০৯ সালে হিলারি ক্লিনটন স্বীকার করেন যে অনেক ঘনিষ্ঠ মিত্রের সাথে একযোগে কাজ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও আল-কায়দা প্রতিষ্ঠার জন্য দায়ী যা পরবর্তীতে আইএসআইএস-এ রূপান্তরিত হয়েছে।
হিলারি ক্লিনটনের সাক্ষ্য , হিলারি বলেন: আমার অভিপ্রায় যে আমাদের এখানে মনে রাখা উচিৎ যে সব লোকের বিরুদ্ধে আজ আমরা যুদ্ধ করছি আমরাই ২০ বছর আগে তাদেরকে অর্থায়িত করেছিলাম। আর আমরা তা এজন্য করেছিলাম যে তখন আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। ‘তারা (সোভিয়েত ইউনিয়ন) আফগানিস্তান আক্রমণ ও জবরদখল করে। আর আমরাও(মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) চাই নাই যে তারা(সোভিয়েত ইউনিয়ন) মধ্য এশিয়া নিয়ন্ত্রণ করুক। তাই আমরা তখন কাজে হাত দেই।
তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিগ্যান ডেমোক্র্যাট প্রাধান্যের কংগ্রেসের অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা প্রসঙ্গে বলেছিলেন: ‘আপনারা জানেন এটার মতো উত্তম ও ভালো ধারণা আর কী হতে পারে যে আসুন আমরা আইএসআই এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে চুক্তি ও সমঝোতায় যাই। আসুন আমরা এসব মুজাহিদকে রিক্রুট করি। সত্যিই এটা খুব বিরাট চিন্তা। আসুন আমরা সৌদি আরব ও অন্যান্য দেশ থেকে কিছু ব্যক্তিকে আফগানিস্তানে তাদের ওয়াহাবি মার্কা ইসলামের আমদানি করতে দেই যাতে আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরাস্ত ও ধরাশায়ী করতে সক্ষম হই। পূর্ববর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও কর্মকর্তারা শত শত কোটি ডলার আফগান মুজাহিদ দলগুলোর পিছে ব্যয় করেছেন এবং এর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নেরই পতন ঘটেছে। তাই এখানে একটা শক্তিশালী যুক্তি রয়েছে আর সেটা হচ্ছে যে সোভিয়েত ইউনিয়নের যবনিকাপাতের জন্য এটা কোনো খারাপ পূঁজি বিনিয়োগ ছিল না। তবে আমরা যা বুনেছি ও রোপণ করেছি সে ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই সাবধান থাকতে হবে। কারণ আমাদের এখন ফসল উঠাতে হবে।’
ভূ-রাজনৈতিক কৌশলবিদ এবং প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার প্রশাসনের নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা এবং হিলারি ক্লিনটনের মিত্র ব্রেজনস্কি সোভিয়েত ইউনিয়নকে আফগানিস্তানে এক অজেয় যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলার লক্ষ্যে আফগান মুজাহিদদেরকে ব্যবহার করেছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে অপারেশন সাইক্লোন নামের এক (গোপন) সি.আই.এ প্রজেক্টে ১৯৭৯ সালে আফগান মুজাহিদরা ছিলেন (সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন হাতিয়ার।
সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্টের জো বাইডেন বেফাঁস মন্তব্য: গত বছর (২০১৬) হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব গভর্নমেন্টে এক অনুষ্ঠানে প্রাক্তন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কূটনৈতিক রীতিনীতির খেলাফে মুখ ফসকে সত্য কথা বলে ফেললে এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। তিনি উক্ত অনুষ্ঠানে বলেছিলেন: মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের মিত্ররাই ছিল সিরিয়ায় সবচেয়ে বড় সমস্যা। তুর্কিরা ছিল (আমাদের) অনেক বড় বন্ধু এবং ঠিক একইভাবে সৌদিরা, আরব আমিরাত ইত্যাদি(এরা সবাই আমাদের বড় বন্ধু ও মিত্র)। তারা কী করছিল (সিরিয়ায়)যে কেউ বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে বলে মনে হয়েছে, ব্যস তার পেছনেই তারা শত শত মিলিয়ন ডলার এবং টন টন অস্ত্র ঢেলেছে, কেবল এই বাবদে যে যাদের কাছে টাকা-পয়সা ও অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছিল তারা ছিল আল-নুসরা,আল-কায়দা এবং ঐ সব চরমপন্থী জিহাদি (জঙ্গি) যারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সিরিয়ায় আগমন করছিল।
সম্প্রতি ভিওন নামের এক ভারতীয় সংবাদ চ্যানেলের সাথে সাক্ষাৎকারে সিরিয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ বলেছেন যে যদি পাশ্চাত্য বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স সিরিয়ায় উগ্র জঙ্গি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সাহায্য না করত তাহলে বহু আগেই সিরিয়ায় এদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে যেত।
এটা স্পষ্ট পাশ্চাত্য অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন এবং তাদের আন্তর্জাতিক জোট সন্ত্রাসবাদ জঙ্গিবাদ দমন ও নিশ্চিহ্ন করার অজুহাত দেখিয়ে আফগানিস্তান ও ইরাক দখল করে প্রকৃতপক্ষে সমগ্র বিশ্বজুড়ে উগ্র জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদকে ছড়িয়ে দিয়েছে। একইসঙ্গে ইহুদিবাদী ইসরাইল সিরিয়ায় গণতন্ত্র কায়েমের ধুয়ো তুলে বাশার আল আসাদ সরকারের পতনের লক্ষ্যে আল-কায়দা, দায়েশ তথা আইএসআইএস, আল-নুসরা ফ্রন্ট, জাইশুল ইসলাম ইত্যাদির মতো উগ্র জঙ্গি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ও দলগুলোকে সর্বাত্মক সাহায্য করে যাচ্ছে।
চরম সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে এবং ধর্মীয় উগ্রপন্থা ব্যবহার করেই যে যায়নবাদি তথা ইহুদিবাদি ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা হয়েছে তা সবারই জানা। সূতিকা-লগ্ন থেকেই ইসরাইল সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত বিধায় এ দেশটি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের (ঝঃধঃব ঞবৎৎড়ৎরংস) উৎকৃষ্ট নমুনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো গত বিংশ শতাব্দীতে বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র হত্যা করে বেড়িয়েছে। ১৯৫২ সালে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ইরানের নির্বাচিত ডঃ মোসাদ্দেক সরকারকে পতন ঘটিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের শাহসহ বিভিন্ন দেশে স্বৈরাচারী অগণতান্ত্রিক জালেম শাসকদের সমর্থন ও সহায়তা করেছে এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বর্তমানেও তা অব্যাহত রেখেছে।
মূলত বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহ বাহ্যিকভাবে নিজেদেরকে ধর্মনিরপেক্ষ দাবি করলেও তাদের মুখোশের নিচে লুকায়িত রয়েছে হিংস্র সাম্প্রদায়িকতা ও পরধর্ম, পরজাতি বিদ্বেষ। উপরোক্ত উদাহরণ এবং ভারতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সরকারের নীতি-কৌশলই এর সপক্ষে জ্বলন্ত প্রমাণ। পক্ষান্তরে মুসলমান নামধারী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও কম্যুনিস্টরা হলো নিজ ধর্ম, দেশ ও জাতির দুশমন এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহযোগী গোলাম।
বস্তুত ইসলামের আবির্ভাব পৌত্তলিক ও ভোগবাদী গ্রীক ও রোমান সভ্যতার প্রতি ছিল এক প্রচ– হুমকি। তাওহীদবাদী ইসলামের আবির্ভাব ও তৎসংশ্লিষ্ট সভ্যতা ও সংস্কৃতির বাস্তব অবদান বহু ঈশ্বরবাদী গ্রীক-রোমান সভ্যতার ধারা ও প্রভাবকে ব্যাহত করেছে দেখে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে সমগ্র ইউরোপ। এই আতঙ্কের ফলশ্রুতিতে এবং নিজেদের মধ্যকার তীব্র দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করে জাতিকে উজ্জীবিত করতে ১০৯৫ খ্রিস্টাব্দের পোপ দ্বিতীয় আরবান ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করেন। তার ঘোষিত প্রথম ধর্মযুদ্ধের মেয়াদকাল ছিল ১০৯৫ থেকে ১২৯১ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০০ বছর। উক্ত সময়ে প্রমে ২টি পর্যায়ে মুসলমানরা পরাজিত হলেও পরবর্তীতে ক্রুসেডাররা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। কিন্তু তারা তাদের পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তীতে বিজয়ীর বেশে আবির্ভূত হয়ে অদ্যাবধি মুসলিম নিধনে ব্যাপৃত রয়েছে। পক্ষান্তরে মুসলমানরা নিজেদের বিজয় থেকে শিক্ষা নেয়নি এবং সমকালীন শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের বিষয়ে গাফেল ছিল দীর্ঘদিন। ইত্যবসরে প্রাচীন ক্রুসেডাররা সমকালীন শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে বিশ্বব্যাপী মুসলিম দেশ দখল, মুসলমান হত্যা ও সম্পদ লুণ্ঠনে নিজেদেরকে নিয়োজিত রেখেছে। পূর্বে তারা মুসলমানদের দেশ দখল করেছিল পোপের ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে, আর বর্তমানে তারা দেশ দখল করছে যায়নবাদী ইসরাইলের গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে।
যায়নবাদী ইসরাইল, তার বরকন্দাজ আমেরিকা, বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও ভারত। বিগত প্রায় এক হাজার বছর যাবত ইহুদীগণ কর্তৃক রচিত বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক মতবাদ ও গোপন ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকা-ের মাধ্যমে এ সকল সাম্রাজ্যবাদী দেশসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে ইহুদীদের তল্পীবাহকগণ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়। ফলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রত্যাশা মোতাবেক এ সকল দেশে সরকার গঠিত হয় না, এ সকল দেশ পরিচালিত হয় না। পূর্বে ক্রুসেড শুরু হয়েছিল পোপের আহ্বানে আর বর্তমানে ক্রুসেড পরিচালিত হয় যায়নবাদী ইহুদীদের চাহিদা মোতাবেক। বর্তমান রাশিয়া যতদিন পর্যন্ত ইহুদী কার্লমাক্স, লেনিন, ট্রটস্কি, ব্রেজনেভ-এর আদর্শে পরিচালিত হয়েছিল ততদিন রাশিয়াও সাম্রাজ্যবাদী ছিল। ইহুদীদের একমাত্র রাষ্ট্রটি একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র। কিন্তু পৃথিবীর অন্য কোনো জাতি ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে ইহুদীদের বরকন্দাজরা উক্ত রাষ্ট্রকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে ঝড়ের বেগে ধেয়ে আসে।
রাশিয়ার দখল থেকে আফগানিস্তান মুক্ত করার লড়াইয়ে পশ্চিমা শক্তি আফগান মুজাহিদ বাহিনী গড়ে তোলে। রাশিয়া পরাজিত হওয়ার পর আফগানরা গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হলে পশ্চিমারাই তালেবানদের সংঘটিত করে আফগানিস্তানে ক্ষমতাসীন করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর মধ্য এশিয়ার বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য পশ্চিমারা আফগানিস্তানের উপর দিয়ে পাইপলাইন স্থাপনের জন্য তালেবান সরকারের সাথে একাধিক বৈঠক করে। পশ্চিমারা চেয়েছিল আফগান মোল্লাদেরকে নামমাত্র ভাড়া দিয়ে পাইপ লাইন স্থাপন করবে। কিন্তু মোল্লারা বলল- আমাদের দেশের উপর দিয়ে আমরা পাইপ লাইন বসাব, আপনারা আমাদেরকে ন্যায্য হিস্যা প্রদান করবেন। মোল্লাদের এরূপ জবাবে অসন্তুষ্ট হয়ে তালেবান সরকার উৎখাতে ৯/১১ কে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে আফগানিস্তানে দখলদারিত্ব কায়েম করা হয়। স্বার্থে আঘাত লাগায় মুজাহিদরা হয়ে যায় জঙ্গী, তালেবানরা হয়ে যায় সন্ত্রাসী।
তুর্কীরা মধ্য এশিয়ার তাতার জাতির বংশধর ছিল। তারা ছিল যাযাবর ও প্রকৃতিপূজারী। নবম ও দশম শতাব্দীতে তুর্কীরা ইসলাম গ্রহণ করে। ১০৫৫ খ্রিস্টাব্দে সেলজুক তুর্কীরা বাগদাদ দখল করে এবং ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে হালাকু খান কর্তকৃ ক্ষমতাচ্যুত হয়। অপরদিকে ১২৯০ সালে ১ম ওছমান ওছমানিয়া তুর্কী সালতানাতের ভিত্তি স্থাপন করেন তুরস্কের ইশকি শহরকে কেন্দ্র করে। প্রত্যেক শাসক তুর্কী সাম্রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি করে ১৮২৮ পর্যন্ত অত্যন্ত প্রতাপের সাথে এশিয়া মাইনর, আরব ভূখ– ও ইউরোপের বর্ণিত দেশসমূহ শাসন করেন এবং এর পর থেকে ১৯১৩ সাল নাগাদ ইউরোপীয় অংশসমূহে পর্যায়ক্রমে তুর্কী শাসন লোপ পায় এবং ১ম মহাযুদ্ধে পরাজয়ের পর বর্তমান আকার ধারণ করে। তুর্কী সেনাপতি কামাল পাশা ১৯২২ সালের ২৯ অক্টোবর তুর্কী সুলতানকে ক্ষমতাচ্যুত করে তুরস্কে প্রজাতন্ত্র স্থাপন করেন। কামাল পাশা প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে কামাল পাশা খিলাফত ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেন। অসংখ্য আলেম হত্যা করেন। ধর্মচর্চা নিষিদ্ধ করেন। আরবীতে নাম রাখা, আরবী পড়া, আরবীতে আজান দেয়া নিষিদ্ধ করেন। তুরস্ককে তথাকথিত সেক্যুলার (অর্থাৎ ইসলামবিরোধী) দেশে পরিণত করেন। মূলত ৬৩২ বছর পর্যন্ত প্রবল প্রতাপান্বিত তুর্কী সালতানাত কামাল পাশা ও তার অনুসারীদের দ্বারা ১৯২২ সাল থেকে সামরিক শাসনের দেশ, ইসলাম বিরোধীদের দেশ, জরুরি অবস্থা জারির দেশ ও ভিক্ষুকের দেশে পরিণত হয়। এই সেক্যুলাররা তুরস্কে ২৫টি মার্কিন ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ দিয়ে তুরস্ককে গোলামে পরিণত করেছিল।
১ম বিশ্বযুদ্ধের সময় উক্ত ইউনিট কামাল পাশার নেতৃত্বে তুর্কী সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ও তুর্কী খেলাফত ধ্বংস করে। কামাল পাশা ইহুদীদের গোপন আন্দোলন ফ্রী ম্যাসন এর সদস্য ছিল। ইহুদীদের নির্দেশে সে তুরস্ক থেকে ইসলামকে উচ্ছেদ করার কর্মসূচি গ্রহণ করে। (তথ্য সূত্র: জাতির উত্থান-পতন সূত্র, প্রবন্ধকার, পৃ. ৪২)
বর্তমানে ইসলামপন্থী রজব তাইয়ে এরদোগানের ক্ষমতা গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত তুরস্ককে বলা হলো ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’। কিন্তু মাত্র এক দশকের মধ্যে এরদোগান সরকার তুরস্ককে ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশে পরিণত করেন। দুর্নীতিবাজ সেক্যুলারগণ যে তুরস্ককে ইউরোপের ভিক্ষুকে পরিণত করেছিল সে তুরস্ক এখন ইউরোপের সবচেয়ে ধনী ও শক্তিশালী দেশে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোর সহযোগিতায় দেশটির সেনাবাহিনীর এই অংশ অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে। রজব তাইয়ে এরদোগান তাঁর রাজনৈতিক কূটকৌশল ও জনগণ কে সাথে নিয়ে তা প্রতিহত করেন। এর মাধ্যমে আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলো তুরস্কে তাদের ষড়যন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়।
২০১২ সালের ২৪ জুন মিসরের ইতিহাসে প্রথমবারের মত অনুষ্ঠিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে ইসলামপন্থী দল ইখওয়ানুল মুসলিমীন বা মুসলিম ব্রাদারহুড। ৩০ জুন ক্ষমতারোহণ করেন ইখওয়ানুল মুসলিমীনের রাজনৈতিক শাখা জাস্টিস এন্ড ফ্র্ডীম পার্টির নেতা ডঃ মুহাম্মাদ মুরসী ঈসা আল-আইয়াত্ব (১৯৫১-)। উপনিবেশবাদ উত্তর মিসরে দীর্ঘ ৬০ বছরের (১৯৫২-২০১২ইং) স্বৈরশাসন ও সামরিক শাসনের ধারাবাহিকতায় ছেদ টেনে এই প্রথম সেখানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
কিন্তু মুরসির ক্ষমতারোহনের ঠিক একবছর পর ৩০ জুন মিসরের তাহরীর স্কয়ারে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ সমাবেশ। বিগত নির্বাচনে পরাজিত ধর্মনিরপেক্ষ আহমাদ শফিক ব্লকের আয়োজিত এই বিক্ষোভ সমাবেশের পরদিন ১ জুলাই পশ্চিমা বিশ্বের ইশারা পেয়ে সেদেশের সেনাবাহিনী কালবিলম্ব না করে মুরসী সরকারের প্রতি ৪৮ ঘন্টার মধ্যে পদত্যাগের আল্টিমেটাম দেয়। ২ জুলাই প্রেসিডেন্ট মুরসী স্বাভাবিকভাবেই এই আল্টিমেটাম প্রত্যাখ্যান করেন। অতঃপর ৩ জুলাই সেনাপ্রধান আব্দুল ফাতাহ আল-সিসি প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ মুরসীর পদচ্যুতি ঘোষণা করে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসাবে আদলী মনসূরের নাম ঘোষণা করেন। এভাবেই পশ্চিমা নীল নকশা মোতাবেক পতন ঘটল ইসলামপন্থী ব্রাদারহুড সরকারের। দৃশ্যপটে দেখা গেল মাত্র একবছর পূর্বে যে জনগণ সেনাশাসনের বিরুদ্ধে সারা মিশর কাপিয়ে দিয়েছিল এবং লৌহকঠিন স্বৈরশাসক হোসনী মোবারককে পদত্যাগে বাধ্য করেছিল, সেই একই জনগণ সেনাবাহিনীর ক্ষমতা পুনর্দখলে বন্য উল্লাসে মেতে উঠেছে। যেই আমেরিকা সারাবিশ্বে গণতন্ত্রের কলরব তুলে মুখে ফেনা তুলে দিচ্ছে সেই আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি মিসরীয় সেনাবাহিনীর এই অবৈধ ক্ষমতাদখলের কোন নিন্দা করলেন না, এমনকি একে ‘সেনা অভ্যুত্থান’ও বললেন না। উপরন্তু ঘোষণা করলেন যে, সেনাবাহিনী ‘গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা’ করেছে (!)। যেই মিডিয়া মোঘলরা মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র নেই, গণতন্ত্র নেই বলে মাতম করে আকাশ-বাতাস উজাড় করে আসছে, সেই মিডিয়া মোঘলদের কন্ঠে শোনা গেল সম্পূর্ণ বিপরীত সুর (!)। এভাবে গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্রসেবীদের নগ্ন প্রতারণা বিশ্ববাসীর সামনে আরো একবার ধরা পড়ে গেল।
মিসরে গণতন্ত্র উচ্ছেদের পর পশ্চিমাদের বক্তব্য, মুরসী সরকার ছিল অদক্ষ, দুর্নীতিগ্রস্ত, এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ। তাই তাদের পতনের বিকল্প ছিল না। তাদের এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে এ কথাই বলতে হয় যে, কেবল মুরসী কেন, স্বয়ং ইমাম মাহদীও যদি এখন বিশ্বে আবির্ভূত হতেন এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহন করতেন তবুও তাঁকে অদক্ষতা ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিদায় করা হত। কারণ তাদের কাছে মূল সমস্যা তো এখানে নয়, সমস্যা হল ইসলাম। অভিযোগটি যদি অদক্ষতা ও দুর্নীতিরই হত তবে তা নিরসনের জন্য মাত্র ১টি বছর সময় কি খুব বেশী ছিল? এত সংক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণে কি একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে এমন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া যায়? কোন যুক্তিতেই এটা সমর্থনযোগ্য? তবুও সারা বিশ্ব এই অন্যায়ের পক্ষে সরব কিংবা মৌন স্বীকৃতি দিয়েছে। তার কারণ একটাই-‘ইসলাম ঠেকাও’।
স্যামুয়েল বাকের লিউ রকওয়েল লিখেছেন-
১৯৬৩ সালে সি.আই.এ সাদ্দাম হোসেনের বাথ পার্টিকে সামরিক অভ্যুত্থানে সাহায্য করে। অভ্যুত্থানের পর সি.আই.এ’র তালিকা অনুসারে জেনারেল করিম কাসেমসহ জাতীয়তাবাদীদেরকে হত্যা করা হয়। মার্কিনীরা তাদের সাম্রাজ্য নির্মাণে তেলসমৃদ্ধ অঞ্চলকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। এর ধারাবাহিকতায় ইরানের মোসাদ্দেক সরকারের পতন ঘটিয়ে রেজা শাহকে ক্ষমতাসীন করা হয়। ইরাক দখল ও নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা করা হয় ১৯৯৬ সালে। বর্তমান মার্কিন সরকারের পরামর্শদাতা রিচার্ড পার্ল, ডগলাস ফেইথ, ডেভিড ওরম্সসহ কয়েকজন অ ঈষবধহ ইৎবধশ : অ ঘবি ঝঃৎধঃবমু ভড়ৎ ঝবপঁৎরহম ঃযব জবধষসং” শিরোনামে জুলাই ১৯৯৬ সালে একটি প্লান পেশ করেন, যাতে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন ও ইরানের সরকার পরিবর্তনের নীল-নকশা উপস্থাপন করা হয়। উক্ত রিচার্ড পার্ল-এর গ্রুপ ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে “ Rebuilding Americas De Defence Strategy Fores ” নামক আর একটি নীল্ নক্শা প্রণয়ন করে, যা বাস্তবায়নের অজুহাত সৃষ্টির জন্য পার্ল হারবারের ন্যায় একটি সর্বনাশা অজুহাত প্রয়োজন বলে মন্তব্য করা হয়। টুইন টাওয়ার হামলা ছিল উক্ত অজুহাত, যা ইসরাইল কর্তৃক বাস্তবায়ন করা হয়। পাকিস্তানের পরমাণু বিজ্ঞানী ড. কাদির খান দ্য নিউজ- বিবিসিকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ২০১৫ সালের মধ্যে পাকিস্তান ভাঙার পরিকল্পনা করেছে। সাদ্দাম হোসেন ও বাগদাদের তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত এপ্রিল গ্লাসপাই-এর মধ্যে দীর্ঘ বৈঠকের ৮ দিন পর সাদ্দাম কুয়েত দখল করেন। বিশ্বের বেশির ভাগ সংবাদ মাধ্যমের মতে, ইরাকের কুয়েত আক্রমণের পিছনে মার্কিন ইন্ধন ছিল। (সূত্র : আলমগীর মহিউদ্দীন, নয়া দিগন্ত, ১৪-০৬-০৮ইং) আমেরিকার উস্কানিতে ইরাক ১৯৮০ সালে ইরানে হামলা করে। এতে ১০ লাখ মুসলমান নিহত হয়। (দৈনিক সংগ্রাম, ২৭-০৬-০৮) বিখ্যাত আন্তর্জাতিক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সিমুর হার্শ ৭ জুলাই ২০০৮ সালের নিউইয়র্কের পত্রিকায় লিখেন- “ইরানকে অস্থিতিশীল করতে যুক্তরাষ্ট্র ৪০০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। ইরানের ধর্মীয় নেতৃত্বে ও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি, আরবী ভাষী ইরানী ও বালুচদের সাথে পার্সী ভাষী ইরানীদের বিভেদ সৃষ্টি করে অস্থিতিশীল করা এ পরিকল্পনার অংশ।
মার্কিন কর্নেল রালফ পিটারের অংকিত Broader Middle East Planও উপরোক্ত তথ্যসমূহ থেকে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ নিজেদের অন্যায্য লুণ্ঠনবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য মুসলিম বিশ্বকে ধ্বংস ও দখল করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাদের টার্গেটকৃত দেশের মধ্যে পাশ্চাত্যের পক্ষের ও বিপক্ষের উভয় শ্রেণীর মুসলিম দেশ অন্তর্ভুক্ত। তবে পার্থক্য এই যে, সাম্রাজ্যবাদীরা প্রথমে পাকিস্তানে, ইরানে, সিরিয়ায়, ইরাকে ও তুরস্কে তাদের আগ্রাসী হামলা পরিচালনা করবে এবং তৎপর পাশ্চাত্যের বন্ধুরাষ্ট্র বা বশংবদ মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের জানকবজ করবে। মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা কি এসব তথ্য অবগত নয়? যদি অবগত না থাকে তাহলে এমন অযোগ্য বেখবর রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের পদত্যাগ করে যোগ্য ব্যক্তিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা দরকার। আর যদি জানা থাকে তাহলে তাদের উচিত আর কোনো মুসলিম দেশ সাম্রাজ্যবাদী হামলার শিকারে পরিণত হওয়ার পূর্বে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের মতভেদ দূর করা ও নিজ নিজ জনগণকে সাম্রাজ্যবাদীদের আসন্ন হামলার ব্যাপারে সজাগ -সতর্ক -ঐক্যবদ্ধ ও সশস্ত্র করা। মনে রাখতে হবে। সাম্রাজ্যবাদীরা কখনও কোনো স্বাধীন দেশের বন্ধু নয়। সাম্রাজ্যবাদীর পুতুল সরকারগণ সাম্রাজ্যবাদীদের দৃষ্টিতে টয়লেট পেপারের চেয়ে বেশি মূল্যবান নয়। সিরিয়ার বিপদে যদি তুরস্ক সহযোগিতার পরিবর্তে সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষাবলম্বন করে, তবে তুরস্ককেও ধ্বংস হতে হবে। ইরানের বিপদে যদি সৌদি আরব, পাকিস্তান ও জিসিসি দেশসমূহ ইরানকে সাহায্যের পরিবর্তে সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষাবলম্বন করে তবে ইরানের পতনের সাথে তাদেরও পতন হবে। আমাদের পবিত্র ভূমি অভিশপ্ত ইহুদী নাছারাদের পদতলে পিষ্ট হবে। এমতাবস্থায় একবিংশ শতাব্দীর জাগ্রত মুসলিম তরুণেরা প্রথমে তাদের দুর্ভোগের কারণ শাসকদের খুঁজে বের করে বিচারের সম্মুখীন করবে এবং সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে নির্মম-কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলে সাম্রাজ্যবাদীদের পতন নিশ্চিত করবে। সবাইকে স্মরণ রাখা উচিত, আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে মুসলিম তরুণ-যুবকগণ এখন অনেক বেশি সচেতন সজাগ ও স্বাধীনতা প্রিয়। অযোগ্য-অথর্ব তাঁবেদার সরকারকে তারা জীবন্ত কবর দেবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররাই যখন গণতন্ত্রকে গলা চিপে শ্বাসরুদ্ধ করে,সন্ত্রাসী-জঙ্গি সংগঠন,দল,গোষ্ঠী ও মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করে সমগ্র বিশ্বে উগ্র জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসবাদের প্রসার ঘটায় তখন কোন্ মুখে তারা সন্ত্রাসবাদ বিরোধী সংগ্রামের কথা বলে? তাদের মুখে তাই সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও প্রতিরোধের জিগির শোভা পায় না। বরং তাদের কথিত সন্ত্রাসবাদ জঙ্গিবাদ বিরোধী যুদ্ধ যেমন অতীতে কোন শুভ ফল বয়ে আনেনি ঠিক তেমনি বর্তমানেও তাদের সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদ বিরোধী সংগ্রাম ও যুদ্ধের প্রতিশ্রুতি ও জোট গঠন কেবল বিশ্বব্যাপী উগ্র সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদ, চরম অসহিষ্ণুতা ও হিংস্রতার প্রসার ছাড়া আর কোন ফায়দাই বয়ে আনবে না। কারণ তাদের নিষ্ঠার অভাব রয়েছে। তাই তাদের কথা ও আশ্বাসে বিশ্বাস স্থাপন করা যায় না এবং যে সব দেশ মার্কিন নেতৃত্বাধীন এই লুটেরা-সাম্রাজ্যবাদী-শয়তানী জোটে যোগ দেবে তাদের পরিণতিও শুভ হবে না এ কারণে যে, ঐসব দেশেই সর্বাগ্রে সন্ত্রাসবাদ-উগ্র জঙ্গিবাদের নতুন করে উত্থান ও প্রসার ঘটবে ইঙ্গ-মার্কিন–ইসরাইলি অক্ষের মদদে। তাহলে ইসলামের নামে সন্ত্রাসবাদ আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র নয় কি !!!!
লেখক:
শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক