মাহমুদ ইউসুফ
কুরবানি দেশের অর্থনীতির ভিত মজবুত করছে। দেশ ও মানুষের জন্য কুরবানি আশির্বাদ। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পুষ্টির যোগান, অর্থপ্রবাহকে গতিশীল রাখছে কুরবানি। শ্রমিক থেকে শিল্পপতি সকলেই সংশ্লিষ্ট কুরবানির সাথে। চাষি, মজুর, ব্যবসায়ী, কর্মকার, পরিবহন মালিক, উদ্যোক্তা, কারখানার মালিকসহ বিভিন্ন শ্রেণির লোকজন জড়িত কুরবানির বাজারে। গরু লালন পালন বলেন, খরকুটো ঘাস সরবরাহ, খইল উৎপাদন, সরবরাহ, পশুর রোগ প্রতিরোধের জন্য ওষুধ, ভ্যাকসিন, প্রতিষেধক তৈরি, বাজারজাতকরণ, সংগ্রহ, পশু ক্রয়-বিক্রয় প্রভৃতি ক্ষেত্রে লাখ লাখ লোক কর্মরত। এখানে নির্দিষ্ট কোনো ধর্মসম্প্রদায়ভুক্ত সংশ্লিষ্ট নয়। সকল ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়ের মানুষ এর সাথে সংশ্লিষ্ট।
১. কর্মসংস্থান: পশু উৎপাদন, প্রতিপালন, বাজারজাতকরণের সাথে নানা প্রক্রিয়া ও কর্মকা- জড়িত। একটি গরুকে কুরবানির উপযোগী কত বেগ পেতে হয় তা এর প্রতিপালকই ভুক্তভোগী। পরিমাণমতো খাবার সরবরাহ, অসুখ, বিসুখ, রোগ থেকে তাঁকে হেফাজত করা এত সহজ কাজ নয়। বাস্তবিক কারণেই এর বিভিন্ন সেক্টরে সৃষ্টি হয়েছে নানা কর্মক্ষেত্র।
২. উদ্যোক্তা: কুরবানিকে কেন্দ্র করে দেশে তৈরি হয়েছে একদল নতুন উদ্যোক্তা। তারা একটি পশুর জীবনচক্রের যাবতীয় কাজ সম্পন্নের জন্য বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছেন এ খাতে। আশানুরূপ লাভবানও হয়েছেন তারা। তারা সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। উদ্যোক্তাদের প্রায় ৭০ শতাংশই তরুণ। গবাদিপশু খাতে বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ।
৩. কৃষক: ৮৬ হাজার গ্রামের প্রতি বাড়িই রয়েছে কৃষক-চাষিদের বাস। তাদের সবার ঘরেই রয়েছে দু-চারটি গরু। হালচাষ ও দুধ প্রাপ্তির পাশাপাশি বকরি ইদে বাজারজাতকরণের জন্য পশু পুুষে থাকেন। দেখা গেল দুটি গরু চাষা ভাই কুরবানির উপযোগী করে বাজারে বিক্রি করে পেল ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এখানে তার ৪০-৫০ হাজার টাকা লাভ থাকা স্বাভাবিক। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সকলধর্মের চাষিরাই এই বাড়তি লাভটার সুযোগ হাতছাড়া করেন না। এজন্যই কুরবানি সার্বজনীন উৎসব। অন্যদিকে গাভীর বাচ্চা বিক্রি করেও প্রচুর পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে থাকেন কৃষকরা।
৪. খামারি: শুধু কুরবানিকে উপলক্ষ্য করে দেশে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার গরুর খামার। গরু ছাড়াও এসব খামারে ভেড়া, ছাগলও পালিত হয়। ইদের বাজারে পশুর প্রধান অংশ আসে এসব খামার থেকে। খামারকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি হয়েছে লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান। ২০১৭ সালে দেশে মোট খামারির সংখ্যা ছিলো প্রায় ৪ লাখ। বর্তমানে এর সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। মুলত কুরবানির বাজার ধরার জন্যই এসব খামার গড়ে উঠেছে। যত বেশি কুরবানি দেওয়া হবে, দেশ তত বেশি লাভবান হবে। পশুহত্যা বন্ধের নামে গরু জবাই সঙ্কুচিত করা হলে জনগণ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
৫. জনসাধারণের হাতে অর্থপ্রবাহ: কোনো সরকারের পক্ষে তৃণমূল পর্যন্ত অর্থপ্রবাহ পরিচালনা অসম্ভব। কারো পক্ষে সম্ভব নয় সব মানুষের দরজায় আর্থিক ও পুষ্টির যোগান পৌঁছান। ইদ-উল-ফিতর ও ইদ-উল-আযহায় ইসলামিক আইনে সেটা মুসলমানদের উদারতায় হয়ে যাচ্ছে। সকল ধর্মের নাগরিকরাই এর সুবিধাভোগী। আশরাফ, আতরাফ, হরিজন, শুদ্র, উপজাতি কেউই এর সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় না। ইদের নগদ অর্থপ্রবাহ অর্থনীতির গতিকে শক্তিশালী করছে।
৬. পুষ্টি যোগান: প্রত্যেক নাগরিকের কাছে প্রত্যেক পরিবারে পুষ্টির যোগান দেওয়া প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিদের পক্ষে কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। ১০০০ জন লোককে ত্রান বিতরণ করতে গেলে দেখা যায়, দাঙ্গা-হাঙ্গামা-রক্তপাতের বন্যা বয়ে যায়। অথচ ১৭ কোটি লোকের মুখে পুষ্টি তুলে দেওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভবই বটে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সরকারের কোনো পরিশ্রম ছাড়াই সব পরিবারে গোশত পৌঁছে যাচ্ছে অনায়াসে।
৭. সহযোগিতা: কুরবানির প্রধান উদ্দেশ্য অপরকে সহযোগিতা। প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, গরিব, দুস্থদের সহযোগিতা ও দানের মাধ্যমে একদিকে সৃষ্টি হয় সুদৃঢ় বন্ধন। অন্যদিকে আনন্দ অনুষ্ঠানে শরিক হতে পারছে সব নাগরিক। মূলত সকল মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ইদের লক্ষ্য। সম্প্রীতির সমাজ গড়ে তুলতে কুরবানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৮. সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব: ইসলামের মূলমন্ত্র বিভেদ নয়, ঐক্য চাই। সুদৃঢ় ঐক্য সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার সহায়ক। কুরবানি ঐক্যবদ্ধ জাতি তৈরি গঠন করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। ঐক্যবদ্ধ নাগরিকরাই শক্তিশালী রাষ্ট্র ও সমৃদ্ধশালী অর্থনীতির চালিকাশক্তি। ঐক্য, সৌভ্রাতৃত্ববোধ, পারস্পরিক সহানুভূতি অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি।
৯. চামড়া শিল্প: চামড়ার তৈরি উপকরণ ছাড়া আমাদের এক মুহূর্তও চলে না। জুতো, ব্যাগ, বেল্ট ছাড়া যাপিত জীবন কল্পনাও করতে পারি না আমরা। অনেকে আছেন গরু জবাইকে মহাঅপরাধ গণ্য করেন। তারা গরুর গোশত ভক্ষণ করেন না। তাদের কাছে গো-হত্যা বা গরুর গোশত ভক্ষণ জঘণ্য অপরাধ। কিন্তু আমি বলব, গরুর চামড়ার জুতো পরে টয়লেটে যাওয়া বা গরুর চামড়ার ঢোল পেটানো তো তারচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ! সেটা এক ভিন্ন আলোচনা। ভারতের দেখা গেছে, বিভিন্ন সময় গো-রক্ষা আন্দোলন চলছে। গো-হত্যা বন্ধে তারা নানারূপ কর্মসূচি পরিচালনা করেন তারা। সে কর্মসূচিতে দেখা গেছে, গো-রক্ষা কর্মীদের পায়ে চামড়ার জুতো, কোমড়ে চামড়ার বেল্ট, মেয়েদের হাতে চামড়ার ব্যাগ। চামড়ার তৈরি এসব পণ্যদ্রব্য নিশ্চয়ই গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষের। তবে চামড়া শিল্পের প্রধান কাঁচামাল গরুর চামড়া।
১০. বৈদেশিক মুদ্রা: গোটা চামড়াশিল্প টিকে আছে কুরবানির উপর। দেশে ১ কোটির উপরে কুরবানি দেওয়া হয়। গরুর চামড়া ছাড়া এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। এ শিল্পের সাথে জড়িয়ে আছে তরুণদের স্মার্টনেস, তরুণীদের সৌন্দর্যবর্ধন, কত সহস্র লোকের কর্মসংস্থান। উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, বিপণন, রফতানিকরণ প্রভৃতি পর্যায়ে বিপুল পরিমাণ লোকের জীবন-জীবিকার উৎস চামড়া শিল্প। বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে আয় হয় ১১৩ কোটি ডলার। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে রফতানি আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১১৬ কোটি ডলারে। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে এই আয়ের পরিমাণ আরও বেড়ে হয় ১২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে রফতানি আয় কমে ১০৮ কোটি ৫৪ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। তাই জাতীয় আয় বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্বার্থে কুরবানি দেওয়ার মানুষের সংখ্যা বাড়ানো জরুরি।