শায়খ আহমাদুল্লাহ ।।
প্রথম প্রশ্ন : ভাগে কোরবানি করার বিষয়ে আমাদের সমাজে অনেকগুলো প্রশ্ন প্রচলিত আছে। যেমন- ভাগে কোরবানি করা জায়েজ কী না? জায়েজ থাকলে ভাগীদারদের সংখ্যা বিজোড় হতে হবে, নাকি জোড় হলেও চলবে? পশু ক্রয় করার পর ভাগীর সংখ্যা বাড়ানো যাবে কী না?
উত্তর : গরু, উট এবং বড় পশুতে ভাগে কোরবানি করা যাবে। সর্বোচ্চ সাতজন ব্যক্তির তরফ থেকে গরু এবং উট যথেষ্ট হবে। এটি সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামায়ে কেরামের মত। এই মতটি দলিলের দিক থেকে সমৃদ্ধ এবং বিশুদ্ধতম।
কোরবানির ভাগের সংখ্যা বিজোড় হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বড় পশুতে সর্বোচ্চ সাত ভাগ পর্যন্ত জোড়-বিজোড় যেকোনো সংখ্যক ভাগ হতে পারবে। তবে এক ভাগ একাধিক ব্যক্তি নিতে পারবেন না বা একাধিক ব্যক্তির তরফ থেকে একটি ভাগ হতে পারবে না।
সচ্ছল ব্যক্তিরা কোরবানির পশু কেনার পর ভাগীর সংখ্যা বাড়াতে চাইলে বাড়ানো যাবে। উদাহরণস্বরূপ- দু’জন মিলে কোরবানি করবেন বলে পশু ক্রয় করেছেন; অতঃপর তৃতীয় আরেকজনকে তারা যুক্ত করলেন, এটি জায়েজ আছে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন : জবাইয়ের সময় কোরবানিকারীদের নামের তালিকা পাঠ করা আবশ্যক কী না?
উত্তর : এটি জরুরি কিংবা আবশ্যক নয়, তবে নাম উচ্চারণ করা মুস্তাহাব। সহিহ মুসলিমের হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- রাসূলে কারিম সা: কোরবানির পশু জবাই করার সময় বলেছিলেন, ‘আল্লাহর নামে কোরবানি করছি। হে আল্লাহ! আপনি এটিকে মুহাম্মাদ, তার পরিবারবর্গ ও তার উম্মতের পক্ষ থেকে কবুল করুন।’ (সহিহ মুসলিম-১৯৬৭)
অতএব যাদের পক্ষ থেকে কোরবানি করা হবে, জবাইয়ের আগে তাদের নাম উল্লেখ করা মুস্তাহাব। যদি বলা হয় ‘হে আল্লাহ! অমুকের সন্তান অমুকের তরফ থেকে কবুল করে নিন’ এরপর ছুরি চালনা করলে মুস্তাহাব আমলের সওয়াব পাওয়া যাবে। তবে এটি জরুরি বা আবশ্যক নয়।
তৃতীয় প্রশ্ন : অংশীদারদের মধ্যে গোশত অনুমান করে ভাগ করা যাবে কী না?
উত্তর : না, এটি উচিত নয়। বরং যথাসম্ভব পরিমাপ করে সমান হারে সবার মধ্যে বণ্টন করা উচিত।
চতুর্থ প্রশ্ন : গোশত তিন ভাগ করা কি জরুরি?
উত্তর : যার যার ভাগের অংশকে তিন ভাগে ভাগ করে এক ভাগ নিজের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীর জন্য কোরবানি করেছেন এমন আত্মীয় এবং প্রতিবেশীদেরও দেয়া যাবে, আরেক ভাগ গরিব-দুঃখী মানুষের জন্য। এরূপ বণ্টন করা মুস্তাহাব। কিন্তু এরূপ তিন ভাগ করা জরুরি কিংবা আবশ্যক নয়। এতে হেরফের বা কমবেশি করলে কোনো অসুবিধা নেই। আপনি চাইলে গরিবকে একটু বাড়িয়ে দিলেন কিংবা প্রতিবেশীর জন্য একটু বেশি রাখলেন কিংবা আপনি নিজের জন্য একটু বেশি রাখলেন, এতে কোরবানির কোনো ক্ষতি হবে না। তবে আবশ্যক নয় বলে পুরোটা নিজে খাওয়া মানবিকতার দিক থেকে অনুচিত।
পঞ্চম প্রশ্ন : ঋণ করে কোরবানি করা যাবে কি না?
উত্তর : ঋণ করে কোরবানি করা যাবে। যদি পরবর্তীতে ঋণ পরিশোধ করার ব্যবস্থা থাকে, তাহলে অবশ্যই ঋণ করে কোরবানি করতে পারবেন। তবে ঋণ করে কোরবানি করা কারো জন্য আবশ্যক নয়। আপনি যদি অভাবী হন, ঋণ করে কোরবানি করা আপনার জন্য উচিত হবে না। যদি ঋণ পরিশোধের বাহ্যিক ব্যবস্থা না থাকে এবং যদি যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করতে না পারার আশঙ্কা থাক, তাহলে ঋণ করে কোরবানি না করাই উচিত। তবে যদি দেয়ার ব্যবস্থা থাকে এবং তাহলে ঋণ করে কোরবানি করতে পারবেন।
ষষ্ঠ প্রশ্ন : মৃত ব্যক্তির তরফ থেকে কোরবানি করার বিধান কী?
উত্তর : এ মাসয়ালা নিয়ে উলামায়ে কেরামের বিস্তর মতভিন্নতা আছে। তবে অধিকতর শুদ্ধ মত হলো, মৃত ব্যক্তির তরফ থেকে কোরবানি করা যাবে। নবী করিম সা:-এর ওফাতের পর তাঁর তরফ থেকে আলী রা: কোরবানি করেছেন।
অতএব, নিজের মৃত মা-বাবা কিংবা অন্য কোনো আত্মীয়স্বজনের তরফ থেকে কোরবানি করা যাবে। মৃত ব্যক্তির তরফ থেকে কৃত কোরবানির গোশত বণ্টনের বিধান হলো- যিনি মৃত ব্যক্তির তরফ থেকে কোরবানি করছেন, অর্থাৎ যার অর্থ দিয়ে কোরবানি করা হয়েছে, এই গোশতের হকদার তিনি। নিজের পক্ষ থেকে কোরবানি করলে গোশতের যে বিধান প্রযোজ্য হয়, মৃত ব্যক্তির তরফ থেকে কোরবানি করলেও একই বিধান প্রযোজ্য হবে। তিন ভাগ বণ্টন করা মুস্তাহাব, জরুরি নয়।
তবে কোনো ব্যক্তি যদি মৃত্যুর আগে ওয়ারিশকে কোরবানি করার জন্য ওসিয়ত করে থাকে, তাহলে সেই কোরবানির গোশত গরিবদের মধ্যে সম্পূর্ণ দান করে দিতে হবে। সাধারণ কোরবানির গোশতের বিধান এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।
সপ্তম প্রশ্ন : নিস্তেজ হওয়ার আগে পশুর চামড়া ছাড়ানো শুরু করা জায়েজ আছে কি?
উত্তর : এটি পুরোপুরি গুনাহের কাজ। এমনকি জবাইয়ের পর অনেক সময় কসাইরা চাকু দিয়ে খোঁচাতে থাকে, এর ফলে কোরবানির পশুর স্বাভাবিক মৃত্যু না হয়ে অস্বাভাবিক মৃত্যু হতে পারে; যার ফলে গোশত খাওয়া পর্যন্ত হারাম হয়ে যেতে পারে। এ জন্য চাকু দিয়ে জবাইয়ের পরে খোঁচানো উচিত নয় এবং নিস্তেজ হওয়ার আগেই চামড়া ছাড়ানো কিংবা রগ কাটা সম্পূর্ণভাবে নাজায়েজ। সহিহ মুসলিমের হাদিসে বিনা প্রয়োজনে পশুর প্রতি অমানবিক হতে নিষেধ করা হয়েছে। সুতরাং এটি করা যাবে না।
অষ্টম প্রশ্ন : ভুঁড়ির অংশবিশেষ দেয়ার শর্তে পরিষ্কার করালে কোরবানি হবে কি?
উত্তর : এটি জায়েজ নেই। কারণ নবী করিম সা: কোরবানির পশুর গোশত প্রস্তুতকারীদের কোরবানির পশুর গোশত দিতে নিষেধ করেছেন (সহিহ বুখারি-১৭১৭)। সে জন্য এটা জায়েজ নেই। হয়তো সম্পূর্ণ ভুঁড়ি বা ভুঁড়ির অংশবিশেষ কাউকে বিনামূল্যে দিয়ে দেবেন। পরিষ্কারকারীকে যথাযথ মূল্য দেবেন। কিন্তু পরিষ্কার করার বিনিময়ে ভুঁড়ির অংশবিশেষ দেয়া জায়েজ নেই।
নবম প্রশ্ন : অমুসলিমকে কোরবানির গোশত দেয়া যাবে কি না?
উত্তর : অমুসলিমকে কোরবানির গোশত দেয়া যাবে। কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।
দশম প্রশ্ন : কোরবানির গোশত কত দিন ফ্রিজে রেখে খাওয়া যাবে?
উত্তর : কোরবানির গোশত যত দিন ইচ্ছা ফ্রিজে রেখে খাওয়া যাবে। এটি একান্তই প্রত্যেকের নিজস্ব ব্যাপার। এ ব্যাপারে শরিয়ত কোনো সীমা নির্ধারণ করে দেয়নি।
তথ্যসূত্র: দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২০ জুলাই ২০২১