মোঃ জাফরুল ইসলাম ।।
আমরা জানি প্রত্যেকটি শিশু অনন্য, প্রত্যেক শিশুরই রয়েছে নিজের মতো একটি কল্পনার জগৎ। আমার ৬+ বছর বয়সী ছেলে নাওয়াল (তাহমিদ) কে পড়া-লেখা শিখতে হবে, তাই ২০২১ খ্রি. প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়েছে বরিশাল শহরের সিসটারস ডে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়টির নাম শুনেই সে বলল, এটাতো ইংরেজি নাম। সিসটার মানেতো বোন। তার বড় বোন তাকিয়া-কে সে দিদিয়া বলে ডাকে। দিদিয়া বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ে সেখানেতো ছেলেরা পড়ে না। তাহলে আমাকে ব্রাদার্স স্কুলে ভর্তি করো। আমি তাকে বললাম দিদিয়ার মতো বড় হলে তোমাকে ছেলেদের স্কুলে ভর্তি করানো হবে।
প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য NCTB এর ৩টি পাঠ্য বই রয়েছে- বাংলা, ইংরেজি ও গণিত। বাংলা ও গণিতে সে ভালো। ইংরেজি পড়া শুরু করতেই সে বলে উঠে কষ্ট করে ইংরেজি পড়ার দরকার কি ? ইংরেজরা যেমন গরগর করে ইংরেজি বলে আমিও তেমন বাংলা বলতে পারি। আমাদের কষ্ট করে ইংরেজি শিখতে হয় কিন্তু ইংরেজদেরতো কষ্ট করে বাংলা শিখতে হয় না। মাতৃভাষা ছাড়াও আমাদের ইংরেজি, আরবি (মুসলিমদের), সংস্কৃত ( হিন্দুদের ) শিখতে হয় ( তাহমিদ আমার কাছ থেকে জেনেছে হিন্দুদের বেদ কোন ভাষায় লেখা )। আমাদের ৩টি ভাষা পড়তে শিখতে হচ্ছে অন্যদিকে ইংরেজদের শিখতে হচ্ছে ১টি ভাষা। তাহমিদের মতে অল্প কষ্ট করেই ইংরেজরা পড়া-লেখা শিখে। মূলত তাহমিদের এ কথাকে সুত্র ধরেই লিখতে বসা।
প্রকৃতপক্ষে ইংরেজদের নিজেদের ভাষা শিখানোর কৌশলও সহজ। ছোট বেলা থেকেই তাদের বর্ণ ও শব্দ উচ্চারণের বিষয়টির উপর জোর দেওয়া হয় । অথচ আমাদের দেশে ইংরেজি ভাষার ক্ষেত্রে বর্ণ ও শব্দ উচ্চারণ এবং কন্ঠস্বরের সঠিক ওঠানামার ক্ষেত্রগুলো তেমন গুরুত্ব পায়না প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। যদিও এক্ষেত্রগুলো ব্যবহারের কথা কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তকে নির্দেশনা দেওয়া আছে। কিন্তু আমাদের প্রতিটি বিদ্যালয়ে কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তকের সেই নির্দেশনা মেনে পাঠদানের মতো শিক্ষক আছেন কি ?
কেননা বর্তমানের শিক্ষকদেরতো তাদের শিক্ষকরা সেইভাবে শেখাননি। ভাষা শেখানোর জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে মনে হয় একজন ইংরেজিতে পাশ করা শিক্ষক থাকা আবশ্যক যার ওপরে ভাষা শেখানোর দায়িত্বটি থাকবে। এছাড়া আমাদের মাতৃভাষা বাংলার ক্ষেত্রেও উচ্চারণের উপর তেমন কোন জোর নেই, শুধু ভালো আবৃত্তিকার ও বক্তাদের কথা শুনলে বুঝা যায় উচ্চারণ ভাষাকে কতটা শ্রুতিমধুর করে। যে পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা ভাষা শিখে সে পর্যায়ে মানসম্মত শিক্ষকের সংখ্যা কম অন্যদিকে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কথা বলা শুরু হয় পরিবার থেকে। মানসম্মত শিক্ষক কম থাকার হয়তো কারণ রয়েছে অনেক। তাহমিদের কথা হলো- আমরা ইংরেজ শিক্ষার্থীদের চেয়ে কোন অংশেই খারাপ নই। তাদের বাড়তি চাপ নেই বিদেশি ভাষার। ওদের কোন বক্তব্য, তত্ত্ব সারা বিশ্বে কত সহজেই প্রচার হয়ে যায়। মুহূর্তে জেনে যায় সারা বিশ্বের লোক। তাদের অনুবাদ করার প্রয়োজন হয় না। ভাষার দাপুটের সুযোগ তাদের ভাগ্যকেও সুপ্রসন্ন করে। তার একথা আমাকে মনে করিয়ে দিলো স্যার জগদীশ চন্দ্রবসু এবং মার্কনীর রেডিও আবিস্কারের বিষয়টি। মার্কনী (১৯০১ খ্রি.) এর অনেক আগেই স্যার জগদীশ চন্দ্রবসু (১৮৯৫ খ্রি. ) বিনা তারে রেডিও আবিস্কার করেছেন কিন্তু ভাষার কারণে তা প্রচার এবং প্রসার না ঘটায় বাঙালি বিজ্ঞানীর সেই স্বীকৃতি পাওয়া হলো না। সত্যি মানুষের জীবনে উত্থান-পতনেও ভাষার গুরুত্ব রয়েছে একথা অনস্বীকার্য। বিশেষ করে ইংরেজি ভাষা সারাবিশ্বে দাপুটে বেড়াচ্ছে।
আমেরিকার সাথে ভিয়েতনামের যুদ্ধের পর ভিয়েতনাম তাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কারিকুলাম হতে ইংরেজিকে বাদ দিয়েছে কিন্তু ৫০ বছর পর তারাও বুঝতে পেরেছে ইংরেজিকে বাদ দিলে বিশ্ব হতে তারাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তাই ২০১৭-১৮ খ্রি. হতে তারাও পুণরায় ইংরেজি ভাষাকে কারিকুলামে অন্তর্ভূক্ত করেছে।
অন্যদিকে তাহমিদের বোন তাকিয়া বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী। তার ভাবনা আমাদের দেশে কারিকুলামে ইংরেজি ভাষা রাখা হয়েছে ফরেন লেংগুয়েজ হিসেবে কিন্তু ইংরেজির উচ্চারণ (প্রোনানচুয়েশন) আমরা যেভাবে করি বা যেভাবে শেখানো হয় তা ফরেনরা বুঝেন না। তাই এধরনের ফরেন লেংগুয়েজ শেখার কোন গুরুত্ব নেই। অন্যদিকে সেকেন্ড লেংগুয়েজ হিসেবে যদি ইংরেজি শেখানো হতো তাহলে আমাদের নিজেদের মধ্যে এক প্রকার চর্চা হতো পেশাশ্রমিকরা বিদেশ গেলে কিছু না কিছু ইংরেজি বলতে পারতো, তাহলে শ্রম বাজারে আমাদের লোকদের কিছু চাহিদা থাকতো। আমরা সেটাও পারছিনা। ফলে ইংরেজি শেখা আর তার ব্যবহারের এক অন্ধকার রাজ্যেই আমাদের বাস।
অপরপক্ষে আমি যা ভাবছি- আমাদের দেশে ইংরেজি ফরেন লেংগুয়েজ বা সেকেন্ড লেংগুয়েজ যাই হোক না কেন উদ্দ্যেশ্য একটাই যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ইংরেজিতে কথোপকথন করতে পারে বিদেশীদের সাথে। যেহেতু কথোপকথনই হচ্ছে মূল উদ্দেশ্য তাই ফরেনদের মতো করে উচ্চারণ শিখলে নিজেদের কথোপকথনে ব্যবহার করতে পারবে এবং সেটা বিদেশীরাও বুঝতে পারবে। কিন্তু ফরেনদের মতো করে আমাদের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শিখাবে কেমন করে ?
এর জন্য উপায় রয়েছে ২টি। প্রথমত প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১/২ জন করে ইংরেজ ফরেনার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করতে হবে। এটি আমাদের দেশের জন্য ব্যয় বহুল। দ্বিতীয়ত শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ইংরেজিতে পাশ করা যেসব শিক্ষক পাওয়া যায় তাদেরকে ইংল্যান্ড বা এরূপ অন্যকোন দেশ হতে ১/২ বছরের ইংরেজি ভাষা কোর্স প্রশিক্ষণ করিয়ে আনা এমন শর্ত সাপেক্ষে যে, প্রশিক্ষণ শেষে তারা এ চাকুরি হতে অব্যাহতি নিতে পারবেন না। যদিও ব্যয়বহুল তবুও প্রথম উপায়টির চেয়ে দ্বিতীয় উপায়টি কম ব্যয় সাপেক্ষ। অতঃপর প্রতিটি শ্রেণিতে প্রতিদিন একটি পিরিয়ড লেংগুয়েজ পিরিয়ড হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। এই পিরিয়ডে শ্রেণি অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের বয়স ও সামর্থ হিসেবে শিক্ষক ইংরেজিতে প্রয়োজনীয় কথোপকথন করবেন এবং শিক্ষার্থীরাও অংশগ্রহণ করবে। এভাবে শুনেশুনে ও চর্চার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ফরেন লেংগুজের ব্যবহার শিখবে। প্রচলিত রুটিনে ফরেন লেংগুয়েজ ব্যতীত ইংরেজি বিষয়ের পিরিয়ড সপ্তাহে অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। এভাবে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করলে একদিন হয়তো আমাদের শিক্ষার্থীরা তথা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও দেশ ফরেন লেংগুয়েজ ব্যবহারের সুফল পাবে। বাংলাদেশের জনবলের গুরুত্ব বাড়বে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পদে এবং শ্রম বাজারে। বিদেশী রেমিটেন্স বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের শ্রমিকদের ভূমিকা অতুলনীয় অথচ এই শ্রমিকরা ভাষার জন্য কর্ম ও অর্থ আয়ের দিক থেকে পিছিয়ে পরছে।
অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন এটা অর্থ ও সময় সাপেক্ষ বিষয়, এটা সম্ভব নয়। তাদের উত্তরে প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বই কেনা’ প্রবন্ধের সেই উক্তিটিই তুলে ধরবো- ‘ বই সস্তা নয় বলে লোকে বই কেনে না, আর লোকে বই কেনে না বলে বই সস্তা করা যায় না।’ অর্থাৎ পাঠকদের মতে বই এর দাম বেশি বলে বই কেনা সম্ভব নয়। আবার প্রকাশকদের মতে ক্রেতারা বই কম কিনেন বলেই বই এর দাম কমানো সম্ভব নয়। এভাবে পাঠক ও প্রকাশক একে অপরের উপর দোষ চাপিয়ে সমস্যার সমাধান এড়িয়ে যান। ফলে পাঠক ও প্রকাশকদের দ্বন্দ্বের আর সমাধান হয় না। অবশ্য তিনি (সৈয়দ মুজতবা আলী) পাঠক তথা ক্রেতাদের হাতেই এর সমাধান তুলে দিয়েছেন। কাজেই ফরেন লেংগুয়েজ বা সেকেন্ড লেংগুয়েজ যা-ই বলিনা কেন, এটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের ( অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের ) উপর। এটা বাস্তবায়ন করতে হলে যে টাকার প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি টাকা ব্যয় হয় এর চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কাজে। এটা বাস্তবায়ন করতেই হবে এই মনোভাব আগে তৈরি করে পরবর্তীতে কাজে হাত দিতে হবে। সময় ও অর্থের উপর দোষ না চাপিয়ে ১০-১২ বছরের পরিকল্পনা নিয়ে দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে গেলে ফরেন লেংগুয়েজ বা সেকেন্ড লেংগুয়েজ সমস্যার সমাধান হবে, উপকৃত হবে শিক্ষার্থী উপকৃত হবে দেশ।