জিনাত তামান্না ।।
সৃষ্টিগতভাবেই মানুষ ভ্রমণ প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে, আলমে আরওয়াহ থেকে আলমে দুনিয়া, আলমে দুনিয়া থেকে আলমে বরযাখ, আলমে বরযাখ থেকে উঠে যাবো আখিরাতে! সুষ্ঠু বিচার সম্পন্ন হওয়ার পর আখিরাত থেকে চলে যাবো চূড়ান্ত গন্তব্য জান্নাত কিংবা জাহান্নামে।
.
ভ্রমণ প্রক্রিয়ার এ শৃঙ্খলিত সময়ের মধ্যে খুব সামান্য সময়ের জন্য আমরা বিচরণ করবো পৃথিবীর বুকে!পৃথিবী নামক সহস্র পৃষ্ঠার বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে মহান রবের অসংখ্য সৃষ্টি!
দুনিয়া ভ্রমণে আমাদের জন্য বিশেষ নিয়ামত হলো পারিবারিক জীবন। এখানে যেমন সম্মান, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা আছে , তেমন অভিমান, অনুযোগ, অভিযোগ আর ব্যস্ততাও আছে ! সংসার জীবনের নানা জটিলতায় যখন আমারা হতাশায় ডুবে যাই , তখন প্রকৃতির বুকে গিয়ে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে এলে মৃত সংসার আবার জীবন্ত হয়ে উঠে, তাই সাধ্য এবং সামর্থ্য মতো স্থান পরিবর্তন করে কিছু সময়ের জন্য ঘুরে আসতে হবে প্রকৃতির সবুজ বাড়ি থেকে।
.
ভ্রমণের জন্য আমরা সমুদ্রকে বেছে নিতে পারি। সাওয়াবের নিয়তে সমুদ্র দেখলে সংকীর্ণ মন প্রসারিত হয়। সমুদ্রপাড়ের জেলেদের মাছ ধরা দেখলে নিজের মধ্যে একটা অন্য রকম প্রশান্তিমেশানো আত্মবিশ্বাস কাজ করে। একটার পর একটা আছড়ে পড়া ঢেউ যেন মনের মধ্যে একেকটা নতুন কাজের স্পৃহা যোগায়।
গভীর অরণ্যানীর সবুজ দেশেও ঘুরে আসা যায়। সবুজ রং দেখলেও শান্তি লাগে। প্রত্যেকটা রঙের মাঝেই আলাদা আলাদা ভাইব্রেশনাল ফ্রিকোয়েন্সি থাকে, যা সবুজ রঙের মধ্যেও আছে। সারা বিশ্বের সব জায়গায় সবুজ রঙকে নিরাপত্তা ও নির্ভরতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে.। প্রকৃতির সবুজ রঙে ডুবে থেকে এনার্জি নিয়ে কাজ করলে দৈনন্দিন কাজ গোছানো এবং প্রাণবন্ত হয়।
.
তাছাড়া পবিত্র কুরআনে সবুজ রঙের ব্যাপারে বর্ণনা এসেছে , সেটা হলো জান্নাতিদের পোশাক হবে সবুজ, সবুজ আমাদের প্রিয় নবি (স.)এর পছন্দের রঙ. মেডিকেল অপারেশনের সময় সার্জন সবুজ রঙের এপ্রোন এবং গ্লাভস পড়েন। এসব তথ্য থেকে আমরা বুঝতেই পারি আমাদের জীবনে সবুজ রঙের প্রয়োজনীয়তা কত গভীর! তাই সুযোগ পেলেই ঘুরে আসবো সবুজ প্রকৃতি থেকে।
.
ঈমান বৃদ্ধিতে ভ্রমণের প্রয়োজনীয়তা:
মহান সৃষ্টিকর্তার নিখুঁত নিপুন সৃষ্টিগুলো চোঁখে না দেখলে কি করে এর সৌন্দর্য উপভোগ করবো ? এগুলো আমাদের জন্যই তিনি নিয়ামত হিসেবে সৃষ্টি করেছেন! পাহাড়, সমুদ্র, গভীর অরণ্য এগুলো তো তাঁর সৃষ্টির কিছু অন্যতম নিদর্শন! ভ্রমণের মাধ্যমে একজন মানুষ যেহেতু তার তত্ত্বীয় জ্ঞানের বাস্তব উপলব্ধি অর্জন করেন , সেহেতু নিজের ঈমান বৃদ্ধিতেও এই ভ্রমণ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। চোঁখের সামনে জলজ প্রাণী, বন্য প্রাণীদের জীবিকা সংগ্রহ দেখে মানুষ তার নিজের অবস্থানের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে সকল ধরণের হতাশা দূরে ঠেলে আল্লাহর শোকর আদায় করতে সক্ষম হয়। মৌমাছিদের মধু সংগ্রহের কৌশল দেখলে জ্ঞান পরিপক্ক হয়। তাছাড়া পৃথিবী ঘুরে বিভিন্ন জাতির লাইফস্টাইল দেখলে নিজের লাইফস্টাইলে পজেটিভ পরিবর্তন আনা সম্ভব হয় । প্রকৃতি থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে সৃজনশীল চিন্তা ও গবেষণার মাধ্যমে নিজের ভিতরের মানুষটাকে নতুন ভাবে সাজিয়ে নেয়া যায়।
.
আল্লাহর পক্ষ থেকে ভ্রমণের নির্দেশ:
পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা আমাদের কে পৃথিবী ভ্রমণের তাগিদ দিয়েছেন…
১) সূরা আল-ইমরানের ১৩৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন__
‘অতীতে তোমাদের পূর্বে বহু ঘটনা অতিবাহিত হয়েছে, সুতরাং তোমরা পৃথিবী ভ্রমণ করো এবং দেখো মিথ্যাশ্রায়ীদের পরিণাম কি হয়েছিলো!’
২) সূরা রুম এর ৪২ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন__
‘বলো! তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করে দেখো, তোমাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কিরূপ হয়েছে! ওদের অধিকাংশই ছিলো অংশীবাদী মুশরিক’
এছাড়াও অনেক অনেক আয়াতে আল্লাহ আমাদের ভ্রমণের নির্দেশ দিয়েছেন.
.
ভ্রমণে ইবাদতের সহজতা :
ভ্রমণকালীন শারীরিক ক্লান্তি ও সহজতার ওপরে গুরুত্ব দিয়ে আল্লাহ ভ্রমণকারীদের ইবাদত সহজ করে দিয়েছেন। যেমন চার রাকাআত নামাজকে দুই রাকাআত করে দিয়েছেন। সফরকালে রোজা ভাঙ্গার অনুমতি দেয়া আছে , যা পরবর্তীকালে রেখে দিলেই হবে কোনো কাফ্ফারা দেয়া লাগবে না!
.
ভ্রমণ সম্পর্কিত দোয়া:
ভ্রমণ সহজ হওয়ার জন্য প্রিয় নবি (স.) আমাদের দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন.
‘হে আল্লাহ! আমাদের জন্য আমাদের এ সফর সহজ করে দাও, আমাদের রাস্তার দূরত্ব কমিয়ে দাও. হে আল্লাহ ! আমাদের সফরের সঙ্গী এবং আমাদের পরিবারের কাছে তুমি স্থলাভিষিক্ত. হে আল্লাহ! তোমার কাছে সফরের ক্লান্তি কষ্ট ও ভয়ানক দৃশ্য দেখা থেকে এবং পরিবার, সম্পদ ও অধীনস্তদের কাছে খারাপ অবস্থায় ফেরত আসা থেকে রক্ষা চাই.’ (মুসলিম)
.
বাংলাদেশের উল্লখযোগ্য পর্যটন কেন্দ্র:
ঐতিহ্যের গরিমায় আমাদের প্রাচীন বাংলাদেশ সারাবিশ্বে পরিচিত। এ দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বাহিরের দেশের পর্যটকদের আকৃষ্ট করে দেশের জন্য আর্থিক সমৃদ্ধি নিয়ে আসে। বর্তমানে পর্যটনকে শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে. আর পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে! বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য কিছু পর্যটন স্থানঃ
১) কক্সবাজার:
বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমুদ্রসৈকতের অবস্থান বাংলাদেশের কক্সবাজারে। একশো বিশ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য নিয়ে বিস্তৃত এ সৈকতে ঘুরে আসা যায় খুব কম বাজেটে! উঁচু পাহাড়, সুগন্ধা বিচ, ইনানী পয়েন্ট, পটুয়ার টেক বিচ, ঝাউবনসহ সব দর্শনীয় স্থান ঘুরে আসা যায় মাত্র অল্প কিছু সময়েই!
২) কুয়াকাটা:
হাতে দু’একদিন সময় নিয়ে আমরা ঘুরে আসতে পারি কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে। দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত এই সৈকতে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের নয়নাভিরাম দৃশ্য নজর কাড়ে ছোটো বড়ো সকল পর্যটকের! লাল কাঁকড়ার বিচ, শুঁটকি পল্লী, লেবুর চর, তিন নদীর মোহনা, সুন্দরবনের পূর্বাংশ আর ঝাউবনের অপরূপ সৌন্দর্য দেখলে সৃষ্টিকর্তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশে সিজদাহ করতে ইচ্ছে করে সাথে সাথেই ! সমুদ্রের তীরে বসে ফ্রাই পল্লীর ফিশ ফ্রাই আর গরম পরোটার স্বাদ যেনো মুখে লেগে থাকে! রাখাইন পল্লীর রাখাইনদের লাইফস্টাইল আর কথা বলার ধরণও বেশ চমৎকার !!
৩) সেন্টমার্টিন:
বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন জগদ্বিখ্যাত প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। এর আরেকটি নাম নারিকেল জিঞ্জিরা। কারণ দীপটি হলো নারিকেল গাছে পরিপূর্ণ!
৪) রাঙামাটি ও বান্দরবান:
উঁচু-নীচু পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে পাহাড়ী নদী। সেখানে শুধু ঝর্ণা আর হ্রদের অপার নান্দনিকতার হাতছানি ! সবুজ বনানীর অপরূপ সৌন্দর্য মুহূর্তেই মন আকৃষ্ট করে! সেখানে উপজাতিদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ আলাদা!
৫) সুন্দরবন:
পৃথিবীর বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। যা আমাদের বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের একটি। সাগর, নদী, খাল দ্বারা বেষ্টিত সুন্দরবনের জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘ। জাতীয় পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বাড়ি কিন্তু সেখানেই ! অগনিত পাখির কলকাকলিতে মুখরিত সুন্দরবনে প্রবেশ করেই মন পাগল হয়ে যাবে স্রষ্টাকে সিজদাহ করার জন্য!
৬) চা বাগান ও জলপ্রপাত:
সিলেটের চা বাগান, জাফলংয়ের জলপ্রপাত, ছাতকের পাথর কেয়ারী সব নয়নভোলানো স্থান !
.
বিশ্ব পর্যটন দিবস:
ভ্রমণের গুরুত্ব বজায় রেখে জাতিসংঘের অধীনে ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের ২৭ তারিখ সারা বিশ্বে পালিত হয় বিশ্ব পর্যটন দিবস.
বাড়ির কাছের প্রকৃতি:
ঈমান বৃদ্ধি এবং জ্ঞান বৃদ্ধি করতে আমাদের কেবল দূরের ট্যুরেই যেতে হবে সেটা কিন্তু নয় ! আমাদের হাতের কাছে , বাড়ির উঠানে কিংবা নদীর তীর জুড়েই ছড়িয়ে আছে মহান স্রষ্টার নিখুঁত সৃষ্টি.
টলোমলো যৌবনা নদী, বর্ষার কদম যুথিকার ঘ্রাণ নিয়েও কিন্তু মৃত মনটা প্রফুল্ল করা যায় । হৃদয়ে প্রশান্তির বীজ বোনা যায় বিলের পাশে বসে পশ্চিম আকাশের গোধূলী দেখে!বিদায় লগ্নে সূর্যের ছড়ানো সৌন্দর্য দেখে আত্মবিশ্বাসে বুক ভরে যায়.উঠানে জোস্নার আলোর গড়াগড়ি আর আকাশে লক্ষ তারার ছড়াছড়ি , সব ই তো আমাদের উপভোগের জন্য !
.
প্রিয় পাঠক , আমাদের জীবন ফুলের বিছানা নয়! হাজার অভিযোগ , অনুযোগে যখন হৃদয় ক্লান্ত হয়ে উঠে , তখন আনন্দ চিত্তে ভ্রান্তির বেড়াজাল থেকে বেড়িয়ে এসে জীবনকে সহজভাবে মানিয়ে নেয়া জরুরি হয়ে উঠে। আর সে মানিয়ে নেয়ার শক্তিটা আমরা প্রকৃতি থেকে পাই ! তাই সমস্ত ব্যস্ততাকে অল্প সময়ের জন্য দূরে সরিয়ে রেখে মহান রাজাধিরাজের সৃষ্টি লীলার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য সময় করে একদিন সমূদ্র দেখে আসুন! জোস্নার আলো মাখা আকাশের মায়াবী দৃশ্যে শান্তি খুঁজুন !
বন্ধুরা ! আমরা এমন এক ধর্মে বিশ্বাসী , যেখানে মুচকী হাসিতেও সাওয়াব ! শুধু নিয়ত সহীহ হতে হবে ! তাই সওয়াবের নিয়তে বিশাল পৃথিবীর দিক দিগন্তে সাধ্যমতো ঘুরে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে মনের সংকীর্ণতাগুলো কাটিয়ে আসুন ! ##
.
জিনাত তামান্না
মুলাদী, বরিশাল
অসাধারণ ????❤️