প্রফেসর মোঃ জাহিদুল ইসলাম ।।
দরিদ্র্য কাকে বলে?
সমাজে যে সকল মানুষ ন্যূনতম খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত থাকে, যারা মানুষ হয়ে ও মানবেতর জীবন যাপন করে তাদেরকে দরিদ্র বলে। অমর্ত্য সেনের মতে, ‘শারীরিক সক্ষমতা বজায় রাখার জন্য যারা খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ও সেবার ব্যয় মেটাতে পারেনা তারাই দরিদ্র।’ যে সকল মানুষ দৈনিক ১৮০৫ কিলোগ্রাম ক্যালোরির নিচে খাদ্য গ্রহণ করে তাদেরকে চরম দরিদ্র বলে।
যাকাত কিভাবে দারিদ্র্য বিমোচন করে?
যাকাত শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো পবিত্র হওয়া বা করা, পরিচ্ছন্নতা ও শুদ্ধতা লাভ করা এবং ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়া বা বেশি হওয়া। শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পদশালী ব্যক্তি আল্লাহ কর্তৃক সুনির্দিষ্ট পরিমাপ সম্পদের মালিক হলে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত পরিমান যোগ্য লোকদের নির্দিষ্ট অংশ মালামাল দেওয়াকে যাকাত বলে। প্রথমে ব্যাখ্যা করা যায় যাকাত কিভাবে পবিত্র করে? পবিত্রকরণ দু’ভাবে হতে পারে।
প্রথমতঃ যাকাত দাতার চিন্তার ও মনের পরিশুদ্ধতা ও পবিত্রকরণ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা সূরা জুমু’য়ার ২নং আয়াতে উল্লেখ করেন ‘তিনিই উম্মতিদের মাঝে একজন রসুল প্রেরন করেছেন যে, তাদের নিকট তার আয়াতসমূহ আবৃত্তি করে তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত।’ মানুষ সাধারণত সম্পদ নিজে ভোগ ও খরচ করার নিরংকুশ অধিকার চায়। মানুষের চরিত্রের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা এমন বৈশিষ্ট দিয়েছেন যে তার সম্পদের শরীক অন্য কাউকে করতে চান না। এ জন্য আল্লাহ তায়ালা সূরা তাকাসূরে বলেন ‘প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন রাখে, যতক্ষণ না তোমরা কবরে উপনিত হও।’
সূরা হুমাযায় আল্লাহ তায়ালা বলেন, দুর্ভোগ তাদের যারা অর্থ জমায় এবং উহা বারবার গননা করে এবং ধারনা করে যে তার অর্থ তাকে অমর করে রাখবে। আল্লাহ তায়ালা ৮২ জায়গায় নামাজের প্রসঙ্গ আলোচনা করেছেন, তন্মধ্যে ৩২ স্থানে নামাজের সাথে সাথে যাকাতের কথা বলেছেন। নামাজের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাকে প্রস্তুত করতে যাকাতের কথা বলেছেন। বান্দা যাতে মনে করে সালাত যেমন আল্লাহর জন্য আদায় করি, যাকাত ও তেমনই আল্লাহর জন্য। বান্দার চিন্তার জগতে একথা যদি প্রোথিত হয় তখন বান্দা বলবে আমার নামাজ আমার দান ও কোরবানি, আমার জীবন ও মরণ সব আল্লাহর জন্য। বান্দা তখন যাকাত প্রদান কে বোঝা মনে করবেনা।
দ্বিতীয়তঃ পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় মানুষ মনে করে আমি আমার বুদ্ধি মেধা শ্রম ও যোগ্যতা দিয়ে সম্পদ উৎপাদন করেছি বা সম্পদের মালিক হয়েছি। অতএব এ সম্পদ ভোগ ও খরচ করার অধিকার আমার। এজন্য যাকাতের মাহাত্ম বুঝতে হলে ইসলামের দর্শনের পাঠ বুঝতে হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে সমস্ত সম্পদের মালিক আল্লাহ তায়ালা। এমন কি বান্দার যে মেধা যোগ্যতা শারীরিক সক্ষমতা, উপায় ও উপকরণ আল্লাহর দেয়া। এজন্য বান্দা আল্লাহর দেয়া এ নেয়ামতকে কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করবে, আল্লাহর দেয়া বিধান মোতাবেক খরচ ও ব্যয় করবে এবং মানব কল্যানে ব্যবহার করবে। এখানে মালিকানা দর্শনের মূলকথা হল সম্পদ উপায় ও উপকরণের মালিক হলো আল্লাহ তায়ালা কিন্তু ব্যবহারিক মালিক হলো ব্যক্তি অথবা রাষ্ট্র। কোন ব্যক্তি যদি নিসাব পরিমান সম্পদের মালিক হলো অথচ সে যাকাত প্রদান করল না তখন তার সমস্ত সম্পদ অপবিত্র হলো। আর যদি হিসাব করে যাকাত প্রদান করে তার সম্পদ যাকাত প্রদানের মাধ্যমে পবিত্র হলো। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তাদের সম্পদ হতে সাদাকা গ্রহণ কর এর দ্বারা তুমি তাদেরকে পবিত্র করবে এবং পরিশোধিত করবে।’(তাওবা-১০৩)
দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষ্ঠু বন্টন ও যথাযথ ব্যবহারের উপর নির্ভর করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠি ও নিম্ন আয়ের মানুষের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইসলাম যে ব্যবস্থা গ্রহনণ করেছে তার অন্যতম হল যাকাত ব্যবস্থাপনা। অসহায় মানুষের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইসলামী অর্থনীতির প্রধান ব্যবস্থা যাকাত। ইসলামী শরীয়তের বিধান মতে প্রত্যেক সামর্থবান ব্যক্তি নির্ধারিত শর্ত সাপেক্ষে সম্পদের ৪০ ভাগের একভাগ অসহায় মানুষকে প্রদান করবে। আট শ্রেণির মানুষ এই অর্থ পেয়ে থাকে, ইশরাদ হচ্ছে ‘যাকাত কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, দাস মুক্তির জন্য, যাদের চিত্তাকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, ঋণে ভারাক্রান্তদের জন্য, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য।’ (তাওবা আয়াত-৬০)
যাকাত তিনভাবে সম্পদ বৃদ্ধি করে- ১। যাকাত গ্রহিতার ২। যাকাত আদায়কারীর ৩।জাতীয়ভাবে সম্পদ বৃদ্ধি ঘটে।
প্রথমতঃ যাকাত গ্রহিতার সম্পদ বৃদ্ধি পায়। নিঃস্ব অসহায় কর্মক্ষম মানুষের নিকট যখন অর্থ আসবে তখন সে তার প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে কিভাবে তার পরিবারের অর্থনৈতিক সংকট দূর করবে, তার যোগ্যতা, মেধা ও শারীরিক সামর্থ অনুযায়ী অর্থকে ব্যবহার করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটাবে। পুঁজি না থাকার কারণে অনেক সামর্থবান ও কর্মক্ষম মানুষ বেকার হয়ে অলস হয়ে বসে থাকে। এসকল কর্মক্ষম মানুষকে যদি অর্থ দিয়ে সহায়তা করা যায়, তাহলে তাদের যেমন পারিবারিক অভাব অনাটন দূর হবে, সাথে সাথে জাতীয় অর্থনীতিতে তার শ্রম ও মেধা কাজে লাগবে।
দ্বিতীয়তঃ যাকাত দাতার সম্পদ বৃদ্ধি পায়। একজন শিল্পপতির তার পন্যের ক্রেতার প্রয়োজন আর ক্রেতার প্রয়োজন আর্থিক সংগতির। যাকাতের মাধ্যমে অর্থ ধনীক শ্রেণির থেকে দরিদ্র শ্রেণির মানুষের হাতে আসবে, তখন তারা এ অর্থ বিভিন্নভাবে বিনিয়োগ ও ব্যবহার করে তাদের আর্থিক সংগতি বৃদ্ধি করবে। ক্রেতার যখন আর্থিক সংগতি বৃদ্ধি পাবে তখন যাকাতদাতা শিল্পপতির পন্য বিক্রির মাধ্যমে তার লাভ বেশি হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান কেবল তাদের মধ্যে সম্পদ আবর্তন না করে।’ (সূরা হাশর আয়াত-৭) তিনি আরো বলেন, ‘যারা তাদের সালাতে সদা প্রতিষ্ঠিত আর যাদের সম্পদে নির্ধারিত হক রয়েছে প্রার্থীতা ও বঞ্চিতের (সূরা মা’আরিজ-২৩, ২৪, ২৫)
তৃতীয়তঃ যাকাতের মাধ্যমে জাতীয় সম্পদের বৃদ্ধি হয়। ধনীক শ্রেণির মানুষেরা যদি যাকাত প্রদান করে তবে এ অর্থ সরাসরি দরিদ্র অসহায় মানুষের হাতে যায়, আর এ অর্থ যদি তাদের মাধ্যমে আবর্তিত হতে থাকে তবে দেশের ও সমাজের মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক আবর্তন প্রবাহের মাধ্যমে জাতীয় সম্পদের বৃদ্ধি ঘটে । অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ যাকাত প্রদানের সামর্থ রাখে এবং তাদের থেকে বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা যাকাত আদায় করা সম্ভব। কিন্তু ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে তার খুব সামান্য অংশই আদায় হয়। ৪ মে.২০১৯ খ্রিঃ ঢাকার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্ট আয়োজিত এক সেমিনারে দেশের বরেণ্য অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা এসব তথ্য তুলে ধরেন। তারা আরো বলেন, ‘ব্যক্তি ও কর্পোরেট অফিসগুলো নিজস্ব উদ্যোগে যাকাত আদায় করায় দরিদ্র ব্যক্তি সাময়িকভাবে উপকৃত হলেও যাকাতের দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাওয়া যাচ্ছেনা। দারিদ্র্য বিমোচনে যাকাতের কাঙ্ক্ষিত সুফল ও আসছেনা। সেমিনারে আলোচকবৃন্দ যাকাত ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়, প্রাতিষ্ঠানিক রুপদান ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ওপর গুরুত্ব দেন।
প্রফেসর মোঃ জাহিদুল ইসলাম শেখ ফজিলাতুন্নেছা সরকারি মহিলা কলেজ, গোপালগঞ্জ।
আলহামদুলিল্লাহ, প্রফেসর জাহিদুল ইসলাম স্যারকে “দারিদ্র্য বিমোচনে যাকাতের ভূমিকা” শীর্ষক নিবন্ধ রচনার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।