দেহের খাদ্য বনাম আত্মার খাদ্য

খলিলুর রহমান

দেহ আর আত্মার সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় মানুষ। আত্মা বা রূহ ছাড়া দেহের কোন মূল্য নেই। আত্মা ছাড়া দেহ বা শরীর সচল থাকে না। অচল হয়ে পড়ে। আবার দেহ ছাড়া আত্মার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। দেহের মধ্যে আত্মা বিরাজ করে। একটি অপরটির পরিপূরক। গাড়িতে ইঞ্জিন আর বডি থাকে। যাত্রী ও মালামাল পরিবহন গাড়ির কাজ। ইঞ্জিন ছাড়া কেবল বডি যাত্রী ও মালামাল বহন করে গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারে না। দু’য়ের সমন্বয়ে গাড়ি তৈরি হয়।

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। তাই মানুষের সম্মান ও মর্যাদা আল্লার কাছে খুব বেশি। মানুষ আল্লাহর প্রিয় মাখলুক। তাই মানুষকে আল্লাহতায়ালা এ সুন্দর পৃথিবীতে তার খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করেছেন। অন্য যে কোন প্রাণীর চেয়ে উত্তম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মহান মা’বুদ মানুষ সৃজন করেছেন।

বিজ্ঞানের চরম এই উৎকর্ষের যুগে বায়ুমন্ডল, ভূ-পৃষ্ঠ, ভূ-গর্ভ, সমুদ্র তলদেশ, মহাকাশ ইত্যাদি মানুষের নখদর্পনে। কোথায় কি রয়েছে মানুষ এর চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে। চন্দ্র পৃষ্ঠে মানুষ পদার্পণ করেছে। মঙ্গল গ্রহ জয়ের তৎপরতা চালাচ্ছে। একের পর এক অত্যাশ্চর্য বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি আবিস্কার করে পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু মানুষের সাড়ে তিন হাত দেহের মধ্যে বিরাজমান আত্মা বা রূহের কোন সংজ্ঞা দিতে মানুষ আজ পর্যন্ত পারেনি।

প্রাচীনকাল হতে আধুনিককাল পর্যন্ত মানুষ আত্মা নিয়ে গবেষণা করে আসছে। কিন্তু রূহকে সংজ্ঞায়িত করতে পারেনি। রূহ আল্লাহ পাকের এক হকুম বা আদেশ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, তারা তোমাকে রুহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বলে দাও, রুহ আমার রবের হুকুমঘটিত বিষয়। কিন্তু তোমরা সামান্য জ্ঞানই লাভ করেছ। [সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৮৫]

পবিত্র কুরআনে অন্তত ২৩ বার ‘রুহ’ শব্দ এসেছে। কোরআনে রুহ শব্দ প্রধানত তিনটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
এক. রুহ হলো সেই অলৌকিক বস্তু, যা মানুষের ভেতর ফুঁ দিয়ে প্রাণের সঞ্চার করা হয়। যেমন—আলোচ্য আয়াতে রুহ বা প্রাণের হকিকত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছে।

দুই. রুহ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে জিবরাইল (আ.)-এর জন্য। অর্থাৎ কোরআনের কোনো কোনো স্থানে রুহ মানে জিবরাইল (আ.)। ইরশাদ হয়েছে, ‘বলে দাও, তোমার রবের কাছ থেকে রুহুল কুদুস [জিবরাইল (আ.)] সত্যসহ কুরআন নাজিল করে…।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ১০২)

তিন. কখনো কখনো রুহ শব্দ এসেছে কোরআন ও ওহি বোঝানোর জন্য। ইরশাদ হয়েছে, ‘এভাবেই আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করেছি রুহ তথা আমার নির্দেশ। তুমি তো মানতে না কিতাব কী এবং ঈমান কী…!’ (সুরা : শুরা, আয়াত : ৫২)
দেখা যায়, যে তিনটি প্রসঙ্গে রুহ শব্দ এসেছে, প্রতিটি প্রসঙ্গই মানুষের জীবন ও মানবসমাজের প্রাণের উৎস।

রুহ এমন অশরীরী বস্তু, যা কারো দৃষ্টিগোচর হয় না। কিন্তু প্রত্যেক প্রাণীর শক্তি ও সামর্থ্য এই রুহের মধ্যেই লুকায়িত। এর প্রকৃত স্বরূপ কেউ জানে না। এর আকার, আকৃতি, ভর, ওজন, বর্ণ, গন্ধ আছে কি না মানুষ বলতে পারে না। আল্লাহর আদেশে রুহ মানবদেহে প্রবেশ করে। এক সময় মহান রবের আদেশে দেহ ত্যাগ করে। ইহা দেখা কিংবা স্পর্শ করা যায় না।

দেহের বৃদ্ধি ও রোগ প্রতিরোধের জন্য খাদ্য প্রয়োজন। শিশু জন্মের পর মায়ের বুকের শাল দুধ দিয়ে তার খাবার শুরু হয়। মানুষ আজীবন খাদ্য গ্রহণ করে। বেঁচে থাকার জন্য খাবার গ্রহণ করে। খাদ্যের উপাদান ৬টি যথা:- আমিষ, শর্করা, ভিটামিন, স্নেহ বা তেল, খনিজ লবণ ও পানি। সবকটি উপাদান সমৃদ্ধ খাবারকে সুষম খাদ্য বলে। সুষম খাদ্যের অভাবে মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে। দেহ দুর্বল হয়। রোগ-ব্যাধি বাসা বাঁধে। আবার অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণে দেহ মোটা তাজা হয়। দেহ সুস্থ ও সবল রাখতে নিয়মিত সুষম খাবার গ্রহণ করতে হয়। অমরা আমাদের বাহ্যিক শরীরকে সদা তরতাজা ও সুস্থ্য রাখতে কত ধরনের খাবার নিয়ে ব্যস্ত থাকি। শরীরকে স্লিম রাখতে ডক্টর পুষ্টিবিদদের পরামর্শ নেই।

তেমনি দেহের খাবারের মত আত্মারও খাদ্যের প্রয়োজন। এর খাদ্য তালিকা রয়েছে। আত্মা বা রূহের খাদ্য হলো আল্লাহর যিকির, কুরআন তেলাওয়াত, নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত ও অন্যান্য ইবাদত। আল্লাহর ইবাদতে রূহ পুষ্টি পায়। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সমস্ত নেক আমল রূহের জন্য সুষম খাবার। আল্লাহর যিকির করলে রূহ সুস্থ থাকে। সবল হয়। আল্লাহর যিকির, ইবাদত-বন্দেগি ছেড়ে দিলে রূহ দুর্বল হয়। রূহের খাদ্য ছেড়ে কেবল দেহের খাদ্য গ্রহণ করলে দেহ সবল হয়। কিন্ত রূহ অসুস্থ হয়ে পড়ে।

ইঞ্জিন দুর্বল হলে গাড়ি তার বডি টানতে পারে না। যাত্রী কিংবা মালামাল গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। ঠিক তেমনি রূহ দুর্বল হলে দেহটাকে টেনে জান্নাতে পৌঁছাতে পারে না। জান্নাতে যেতে না পারলে পরকালে যেতে হবে জাহান্নামে। সুতরাং রূহের খাবার নিয়মিত সরবরাহ করতে হবে। কেবল দেহের খাবার নিয়ে ব্যস্ত থাকলে চলবেনা।

দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, আল্লাহর যিকির, কুরআন তেলাওয়াত ও অন্যান্য নেক আমল নিয়মিত করলে রূহ বা আত্মা সুস্থ থাকে। সুস্থ্য আত্মা বা রূহ আমাদের দেহকে টেনে নিয়ে যেতে পারে অনন্তকালের শান্তির স্থান জান্নাতুল ফেরদাউসে। সুতরাং আসুন আমরা সবাই বাহ্যিক দেহের যত্নের মত নিয়মিত আত্মা বা রুহের খাবার যোগান দিয়ে রুহকে পরিশুদ্ধ রাখতে সর্বদা সচেষ্ট হই।

Image may contain: indoor

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *