ড. মো. আহসান উল্যাহ ||
পাঠাভ্যাস হলো নিয়মিতভাবে পাঠসামগ্রী পাঠ করা। সাধারণতঃ জানার ইচ্ছা থেকেই পাঠাভ্যাসের আগ্রহ বাড়ে। পাঠ মানে পড়া। পাঠের সাথে আমাদের চক্ষু, কর্ণ, জিহ্বা পাঁচ ইন্দ্রিয়ের মধ্যে এ তিন ইন্দ্রিয়ই জড়িত। তার সাথে জড়িত মনও। আর অভ্যাস মানে বারবার করা। তাই পাঠ আমাদেরকে নিত্য করতে হবে এবং পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি করতে হবে। মানব কল্যাণের শ্রেষ্ঠ দিশারী আল কুরআনের সর্ব প্রথম শব্দটিই হলো ‘ইকরা’, অর্থাৎ পড়ো। এই ‘ইকরা’ বা পড়ো শব্দটি কেন সর্ব প্রথম উচ্চারিত হল তা নিয়ে একটু চিন্তা করলেই পাঠের গুরুত্ব সহজেই উপলব্ধি করা যায়। মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ-আশরাফুল মাখলুকাত। অন্য সব প্রাণী থেকে আমাদের মর্যাদা উচ্চ হওয়ার কারণে আল্লাহ আমাদেরকে বিবেক বা ভালো জ্ঞান দিয়েছেন। এই বিবেকই আমাদের প্রতীক। আর আত্মিক অস্তিত্বই মানুষের আসল অস্তিত্ব। বই পুস্তকের মধ্যে আছে আত্মার খোরাক। তাই বই পাঠের অভ্যাস আমাদের একান্ত প্রয়োজনীয়। জ্ঞান অর্জনের জন্য নানা উপায় বা পথ রয়েছে। এ পথ গুলির মধ্যে সহজ এবং নির্ভরযোগ্য পথটি হল বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। মনের মধ্যে এই অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারলে পাঠের অভ্যাস আপনা আপনিই গড়ে উঠবে।বই পাঠে যা অর্জন করা যায, তা অন্য কোন বিষয় থেকে পাওয়া যায়না। বিজ্ঞান-অর্থনীতি বা সামাজিক সূচকে যত উন্নতি করা হোক না কেন, বই পাঠে যা অর্জিত হয়, তার কোন তুলনা নেই। কোন জাতি সভ্যতার কোন সোপানে অবস্থান করছে তা পরিমাপ করা হয় সেই জাতির পাঠাভ্যাস এবং গ্রন্থগারের মাপকাঠি দিয়ে।বই পড়তে হলে বই পেতে হবে। অনেকে বই পড়তে চাইলেও বই পায় না বলে পড়তে পারে না। এজন্য যত বেশী লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা যায় তত মঙ্গল। হাতের কাছে লাইব্রেরি পেলে সমাজের শিক্ষিত লোকদের বই পাঠের অভ্যাস বৃদ্ধি পাবে।
আন্তর্জতিক মান আমাদের দেশে লাইব্রেরির সংখ্যা খুবই কম। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী প্রতি ১৭০০ জনের জন্য একটি লাইব্রেরি দরকার। তাহলে সে হিসেবে আমাদের দেশে কমপক্ষে এক লাখ লাইব্রেরির প্রয়োজন। বর্তমানে আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি গণগ্রন্থাগারের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। ইউনেস্কো ষ্টান্ডার্ড অনুযায়ি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশে কমপক্ষে ২০১০০টি পাবলিক লাইব্রেরি দরকার। ইফলা ষ্টান্ডার্ড অনুযায়ি ১ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে কমপক্ষে একটি পাবলিক লাইব্রেরি দরকার।
দেশ ও জাতিকে সমৃদ্ধশালী করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন সুপরিকল্পিতভাবে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা ও গ্রন্থপাঠের অভ্যাস গড়ে তোলা। বই হচ্ছে মানব জাতির ঐতিহ্যের দর্পণ। বই অতীতকে করে জাগ্রত, বর্তমানকে করে অর্থবহ, ভবিষ্যতকে যোগায় আদর্শ ও প্রেরণা। বিখ্যাত সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী বলেছেন “ যে জাতির যত বেশি লোক বই পড়ে, সে জাতি তত বেশি সভ্য”। গ্রন্থপাঠ ও গ্রন্থ ব্যবহার দুই-ই মানুষের মনন ও সুন্দর সমাজ গঠনের হাতিয়ার হয়ে কাল হতে কালান্তরে ধাবিত হচ্ছে। গ্রন্থপাঠ ও গ্রন্থাগার ব্যবহারের নেশা যদি মনের মধ্যে সৃষ্টি হয়, তাহলে পাঠাভ্যাস বৃদ্ধির এটিই হলো সহজতম পন্থা। ছোট বেলায় শিশুরা মায়ের মুখে গল্প-ছড়া শুনে শুনে তাদের মনে কবিতা, ছড়া ও গল্প বইয়ের প্রতি অনুসন্ধিৎসার জন্ম হয়ে থাকে। সর্বস্তরের মানুষের যথা- শিশু, কিশোর, যুবক, বৃদ্ধসহ সবার মনে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের অনুসন্ধিৎসা থেকে তাদের বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থ পাঠের ও ব্যবহারের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ থেকেই পাঠাভ্যাসের সৃষ্টি হয়। জ্ঞান বৃদ্ধি, আনন্দ উপভোগ এবং নিজেকে আলোকিত করতে পড়ার বিকল্প নেই। এটি আমাদের সাহায্য করে জ্ঞানী হতে এবং সফল বা কৃতকার্য হতে। যদিও বইপাঠ একটি কার্যকরী উপাদান কিন্তু বেশী সংখ্যক লোক এর সাথে যুক্ত নয়।বই পড়া সম্পর্কে বিল গেটস বলেছেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। আর এই স্বপ্ন পেয়েছিলাম বই থেকে। আপনারা যদি আমার ঘরে যান, দেখবেন বই; অফিসে যান, দেখবেন বই, যখন আমি গাড়িতে থাকি, আমার সঙ্গে থাকে বই।’
গবেষণায় দেখা যায়, যদি আপনি বৎসরে দশটি বই পড়েন, তাহলে পাঠকের দিক থেকে অল্প শতাংশ হলেও আপনার স্থান হবে উপরের সারিতে। বাংলাদেশে বই পড়ার অভ্যাস বা বই পাঠের সংখ্যা খুবই কম। প্রয়োজনের তাগিদে আমরা বই পড়ি। ভারতীয়রা বই পড়ার অভ্যাস ব্যাপকভাবে গড়ে তুলেছে এবং জরিপে উঠে এসেছে যে প্রতি সপ্তাহে একজন ভারতীয় কমপক্ষে ১১ ঘণ্টা বই পড়ে। এখানে বই বলতে বিভিন্ন ধরনের বইকে বুঝানো হচ্ছে। ভারত ছাড়াও চীন, থাইল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্রের লোকেরা ব্যাপকভাবে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলেছে। থাইল্যান্ডের জনগন প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১০ ঘণ্টা বই পড়ে। চীনারা প্রতি সপ্তাহে ৮ ঘণ্টা এবং মার্কিনীরা প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৬ ঘণ্টা বই পড়ে থাকে।
বই পাঠের প্রতি আগ্রহ বাড়ানো তথা বইয়ের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সব ধরণের গ্রন্থাগারেই কিছু সাধারণ সহায়ক কর্মসূচি বা কর্ম পদ্ধতি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। বিখ্যাত ইংরেজি সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বইপাঠ তথা পাঠাভ্যাস বৃদ্ধির লক্ষে বলেছেন- “পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি হলো নিজেকে গঠন করা, যা যে কোন সমস্যার সমাধান এবং সকল দুঃখ/যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র আশ্রয়স্থল”। স্বাস্থ্যহানী, দীর্ঘসূত্রিতা, ভালবাসায় ব্যর্থতা ও বিষন্নতা থেকে মুক্তি পেতে বহু লোক বইপাঠকে অন্যতম প্রধান আশ্রয় বা অবলম্বন বলে ধরে নেয়। এটা সত্যি যে, একটি ভাল বই আপনাকে নতুন জীবনের দিগন্ত উন্মোচন এবং জীবনকে আরও প্রাণবন্ত/ জীবন্ত করে তোলে। বিখ্যাত চিন দেশীয় দার্শনিক ফুয়ানসু বলেন “যদি সমগ্র জীবনের জন্য পরিকল্পনা মত ফল পেতে চাও তবে মানুষকে সুশিক্ষায় সুশিক্ষিত কর।”
বই-ই হচ্ছে মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ । যার সাথে পার্থিব কোনো সম্পদের তুলনা হতে পারে না। একদিন হয়তো পার্থিব সব সম্পদ বিনষ্ট হয়ে যাবে , কিন্তু একটি ভালো বই থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান কখনও নিঃশেষ হবে না , তা চিরকাল হৃদয়ে জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখবে । আজ যারা সফলতার চরম শীর্ষে পৌঁছেছে তাঁরা সকলেই কতটা বই পড়তে আগ্রহী । বই পড়ার মধ্য দিয়ে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করে তোলেন । Warren Buffett তাঁর পেশা জীবনের শুরুতেই প্রতিদিন ৬০০-১০০০ পৃষ্ঠা নিয়মিত পড়তেন । Bill Gates প্রতিবছর ৫০টি বই শেষ করেন । Mark Cuban প্রতিদিন ৩ ঘন্টার বেশি বই পড়েন। Elon musk রকেট সায়েন্সের বিদ্যা বই পড়ার মাধ্যমে অর্জন করেছেন । একটা বই শুধু তথ্য দেয় না , প্রশ্ন দেয় এবং নতুন করে চিন্তা করতে শেখায়। বই কেন পড়ব ? বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা কী ?
বই আমাদের
১) জ্ঞান বৃদ্ধি করে ২) মানসিক উদ্দীপনা তৈরি করে ৩) মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে ৪) অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা যায় ৫) কল্পনা শক্তি বৃদ্ধি করে
৬) স্মরণ শক্তির বৃদ্ধি ঘটে ৭) শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধি করে। ৮) লেখনী শক্তি বৃদ্ধি করে
৯) Critical thinking বৃদ্ধি করে ১০) একাগ্রতা বৃদ্ধি করে ও মানসিক প্রশান্তি দান করে
১১) সহানুভূতি বোধ তৈরি করে, ১২) আত্মসম্মান বোধ তৈরি করে,
১৩) সংলাপ দক্ষতা বৃদ্ধি করে ১৪) ভালো ঘুমাতে সাহায্য করে ।
যত বেশি বই পড়া যাবে, তত বেশি জ্ঞান বৃদ্ধি পাবে । একটি গবেষণায় দেখা গেছে বই পড়ার অভ্যাস মানুষকে ” Dementia এবং Alzheimer’s” নামে দুটি রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে । লেখক গুস্তাভ ফ্লবার্ট বলেছিলেন, “শিশুদের মত শুধু আনন্দের জন্য বই পড়বেন না অথবা উচ্চাকাঙ্খীদের মত নির্দেশ পাবার জন্য পড়বেন না, পড়ুন জীবনকে জানার জন্য।”
দেশ ও জাতির উন্নয়নের স্বার্থে বইপাঠে পাঠকদের উৎসাহ যোগাতে বিভিন্ন কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। গণসচেনতামূলক বইপাঠ প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। এতে করে যেমন নতুন নতুন পাঠক সৃষ্টি হবে, সাথে পাঠাভ্যাস কর্মসূচি তার লক্ষ্য অর্জন করতে সহায়ক হবে।
পাঠাভ্যাস বাড়ানোর জন্য আমরা কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি:-
এক, আমাদের প্রত্যেকের বাড়ীতে দেহের খাদ্য তৈরী করার জন্য রান্নাঘর থাকে। কিন্তু মনের খাদ্যের জন্য লাইব্রেরি থাকে না। তাই প্রত্যেকে যেন বাড়ী তৈরীর সময় রান্নাঘরের পাশাপাশি একটি লাইব্রেরি ঘরেরও ব্যবস্থা করেন। এটা করতে পারলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি পাবে।
দুই, বেশী বই পাঠের জন্য প্রত্যেক পরিবার, বিদ্যালয় ও সাংস্কৃতিক সংস্থা পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখতে পারেন। এতে শিশু, তরুণ-তরুণী সবাই বই পাঠে উৎসাহিত হবে। ফলে তাদের পাঠাভ্যাস বাড়বে।
তিন, বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠান, বিয়েতে বই পুস্তক উপহার দেয়ার রেওয়াজ অধিক মাত্রায় চালু করতে হবে। এতেও পাঠাভ্যাস বাড়বে।
চার, বি.সি.এস সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বই পাঠের অভ্যাস যাচাই এর জন্য প্রশ্ন রাখতে হবে|
পাঁচ,আমাদের নিজেদেরকে উত্তম বই’র পাঠক হতে হবে। তবেই ছোটদের মধ্যে বই পাঠের আগ্রহ সৃষ্টি হবে। এতে তাদের পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি পাবে। একটি জাতিকে সুশিক্ষিত করতে গেলে পাঠাভ্যাসের বিকল্প নেই। তাই মানুষকে সুশিক্ষায় সুশিক্ষিত ও আলোকিত মানুষ তৈরিতে গ্রন্থ ও পাঠাভ্যাস মূখ্য ভূমিকা পালন করে।