সোহাগ পাটোয়ারী ||
রকমারী.কম এ বেস্টসেলার বইয়ের তালিকায় প্রথম পাঁচটি বইয়ের মধ্যে তিনিটই হলো ইংরেজি শেখার বই। বইগুলো হলো:
১। ঘরে বসে Spoken English.
২। ম্যাসেজ
৩। সবার জন্য Vocabulary
৪। জীবন যেখানে যেমন
৫। স্মার্ট ইংলিশ স্মার্ট ওয়ে টু লার্ন ইংলিশ -১ম খণ্ড
দুটো বইয়ের লেখক মুনজেরিন শহীদ। যিনি হালের ক্রেইজ। তরুণদের ক্রাশ। একটা মিজানুর রহমান আজহারীর বই। একটা আরিফ আজাদের। অন্যটা ফরিদ আহমেদ নামে এক ব্যক্তির। তালিকার পনের পর্যন্ত আরো তিনটা ইংরেজি শেখার চটি বই আছে। আরিফ আজাদের আছে আরো চারটা বই। শায়খ আহমাদুল্লাহর আছে দুটো। গনিতের জেমসবন্ড নামে একটা বই আছে মোত্তাসীন পাহলভী নামের একজনের।
এই হলো মোটামোটি দেশের সবচেয়ে বড় অনলাইন বুক শপের বেস্টসেলার তালিকার পরিসংখ্যান।
এই পরিসংখ্যান তুলে ধরছে আমাদের পাঠাভ্যাসের চিত্রপট।
একটা বিদেশী ভাষা শেখার জন্য বাজারী চটি বই বাঙ্গালী পাঠকের ক্রয়ের তালিকায় শীর্ষে। এই বই একজন সুন্দরী নারী লেখকের। যিনি ফেসবুকে ইংরেজি শিখিয়ে ভাইরাল হয়ে তরুণদের মন কেড়ে বই বিক্রির বাজার তৈরি করেছেন। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা মিজানুর রহমান আজহারী আলোচিত ধর্মীয় বক্তা। ধর্মীয় বিষয় ও ব্যক্তিগত পরিচিতি বই বিক্রির প্রধান ফ্যাক্টর। আরিফ আজাদ সাম্প্রতিক সময়ে মাদ্রাসার ছাত্র বা মধ্যবিত্ত তরুণদের নিকট একটা ক্রেইজ। ইসলাম ধর্ম ওনার লেখার প্রধান বিষয়বস্তু, যাতে তিনি যুক্তি দিয়ে ধর্মের যথার্থতা প্রমাণ করেন। এতে মাদ্রাসার ছাত্র ও একশ্রেণির মধ্যবিত্ত তরুণরা এতবেশি আকৃষ্ট হয়েছে যে, তিনি এখন যা বলবেন বা যা লিখবেন তাই কিনবেন মলাটে লেখকের নাম দেখে। আরেকজন শায়েখ আহমাদুল্লাহ। তিনিও একজন ভাইরাল ধর্মীয় বক্তা। তাঁর বইয়েরও একটা নির্দিষ্ট পাঠক শ্রেণি রয়েছে। বর্তমান সময়ে সরকারকে গালি দিয়ে বা ধর্ম নিয়ে ভাইরাল কেউ কিছু লিখলে তা বাজারে চলে ভালো। এটাও সেরকম।
বর্ণিত লেখকদের মধ্যে কেউই প্রতিষ্ঠিত লেখক নয় একমাত্র আরিফ আজাদ ছাড়া। অথচ আমাদের পাঠকদের নিকট তারা বেস্টসেলার।
শীর্ষ পনেরটি বইয়ের মধ্যে একজনও মননশীল লেখক নেই, যিনি সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতিকে বিশ্লেষণ করে লিখে একটা জাতির মননশীলতা গঠনে ভূমিকা রাখেন। যদিও আমাদের এমন লেখক খুব কম; কিন্তু যে কয়জন আছে তাদের বই কয় কপি বিক্রি হচ্ছে?
এই বেস্টসেলার তালিকা আমাদের মনন, রুচিশীলতা ও জ্ঞানচর্চার একটা বিশাল ক্যানভাস বটে। একটা বিদেশী ভাষা শিক্ষার বাজারী চটি বই যদি বেস্টসেলার তালিকার শীর্ষে থাকে তাহলে সে জাতি নিয়ে হতাশ হওয়া ছাড়া আসলে কিছুই করার থাকে না। অথচ মুখে বুলি ফুটতে শুরু করলেই এই ইংরেজি শেখার দৌড় শুরু হয় আমাদের। সতের আঠার বছর পড়েও আমরা তা শিখতে না পেরে ধারস্থ হতে হচ্ছে ভাইরাল লেখকের চটি বইয়ের নিকট।
পাঠভ্যাস আমাদের খুব কম এটাই সবাই জানেন। কিন্তু তাই বলে বই কেনার এমন পরিসংখ্যান অশনি সংকেত বটে। পাঠের অভ্যাস না থাকলে একটা জাতিকে খুব বেশিদূর এগিয়ে নেয়া যায় না। কারণ কংক্রিটের ঢালাইয়ে যে উন্নয়ন তা অশিক্ষিত লোকেরাই করে; কিন্তু সামাজিক-সাংস্কৃতিক- মননশীলতার উন্নয়ন ঘটাতে হলে জ্ঞান চর্চাকারী শিক্ষিতদেরকেই দরকার।
আমার একজন পরিচিত উচ্চশিক্ষিত নারী, যিনি একজন মা, একটা চাকুরিও করেন, তাকে আলাপকালে জিজ্ঞেস করেছিলাম গত তিন মাসে কয়টা বই কিনেছেন এবং গত এক সপ্তাহে কয় পৃষ্ঠা পড়েছেন। বইকেনা ও বইপড়া দুটোতেই ওনার উত্তর শূণ্য। সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী এমন মা দিয়েই আমাদের ঘরগুলো সাজানো। যারা সংসারকে সাজিয়ে রাখেন পরমযত্নে; কিন্তু বইকেনার ও বইপড়ার অভ্যেস দিয়ে সন্তানের মননকে সাজাতে মোটেও আগ্রহী নয়। অথচ সন্তান মাকেই বেশি অনুকরণ করে। আর সন্তানেরাই বড় হয়ে ক্রাশের ভাইরাল হওয়া বই কিনে আবেগ দিয়ে, বিবেক দিয়ে নয়।
তথ্যসূত্রঃ পাঠশালা-CBS