আল কুরআনের প্রথম আহবান ইকর। ঈসায়ি ৬১০ সালের আগস্ট মাসে হেরা গুহায় সর্বপ্রথম কুরআননাযিল হয় মহান আল্লাহর রসুল মুহাম্মাদ স. এর ওপর। আল্লাহর নিকট থেকে জিবরাইল আ. পহেলা যে অহি নিয়ে আসেন তাহলো:
১. ইকর বিসমি রব্বি কাল্লাজি খলাক। ২. খলাকল ইনসানা মিন আলাক। ৩। ইকর ওয়া রব্বুকাল আকরম। ৪. আল্লাজি আল্লামা বিল কলাম। ৫. আল্লামাল ইনসানা মা লাম ইয়ালাম।
তরযমাঃ ১. পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। ২. সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘আলাক’ থেকে। ৩. পড়ো, আর তোমার প্রভু অতিশয় মহিমান্বিত। ৪. যিনি তালিম দিয়েছেন কলমের সাহায্যে। ৫. তালিম দিয়েছেন ইনসানকে যা সে জানতো না।’
অতএব মানুষের প্রথম কাজ হলো আল কুরআন অধ্যয়ন। যদি কেউ বলে ‘আমি পড়ি না’ ‘আমি পড়তে জানি না’ ‘আমার পড়া ভালো লাগে না’ ‘আমার পড়তে ইচ্ছা হয় না’ ‘আমি পড়ব না’ তাহলে তিনি আল্লাহর পহেলা নির্দেশনা পালনের অস্বীকৃতি জানালেন। আর আল্লাহর হুকুম লঙ্ঘন করলে তার আর মুসলিম থাকা বা ইমানদার হবার অবকাশ নেই। তিনি নিজেকে মুহাম্মাদ স. এর উম্মত দাবি করতে পারেন না। কুরআন চর্চা, কুরআন শিক্ষা, কুরআনের জ্ঞানার্জন, কুরআন বুঝা, কুরআন গবেষণা, কুরআনেরমর্মার্থ উপলব্ধি করাই মুমিনের প্রথম দায়িত্ব। কুরআন হৃদয়ঙ্গম করলেই তার পক্ষে আল্লাহর বিধান-হুকুম পালন করা সম্ভব। না বুঝলে, না জানলে, বিদ্যা না থাকলে আমল করা যায় না। নবি করিম স. ফরমান, যে ব্যক্তি তিন দিনের কমে কুরআন পড়েছে, সে কুরআন বুঝতে পারে নাই। (তিরমিযি, আবু দাউদ, বর্ণনায় অবদুল্লাহ বিন আমর রা.) এই হাদিসই প্রমাণ করে কুরআন পড়া মানে ইহা বুঝে পড়তে হবে। আর না বুঝে পড়াতে কোনো কল্যাণ নেই। সুতরাং মানবজাতির প্রথম ফরজ কাজ হলো আল কুরআন চর্চা।
আল কুরআন কী ?
আল কুরআন হলো মানবজাতির জন্য গ্রহণযোগ্য একমাত্র সংবিধান। মহান আল্লাহ কুরআনে ইরশাদ করেন, ‘হে মানব সমাজ! তোমাদের কাছে তোমাদের প্রভুর নিকট থেকে এসেছে একটি কল্যাণময় উপদেশ (কুরআন) এবং তোমাদের অন্তরে যা (যে অজ্ঞতা, অন্ধতা, সংশয়, কুটিলতা, দ্বৈততা) আছে তার নিরাময়। (সুরা ১০ ইউনুস : আয়াত ৫৭) ‘এটি মানবজাতির জন্যে এক সুস্পষ্ট বিবৃতি বা স্টেটমেন্ট।’ (সুরা ৩ আল ইমরান : আয়াত ১৩৮) ‘এটা হলো আল্লাহর বিধান বা সংবিধান, তিনি নাযিলকরেছেন তোমাদের প্রতি।’ (সুরা ৬৫ আত তালাক: আয়াত ৫) আল কুরআনকেমেনিফেস্টো, মেসেজ, প্রেসক্রিপশন, প্রজ্ঞাপন, কনস্টিটিউশন, শাসনতন্ত্র বা সংবিধান হিসেবে না মেনে ইনসান রচিত বা রাষ্ট্র মনোনীত কোনো সংবিধানকে গ্রহণ করলে তিনি কোনক্রমেই মুসলিম হিসেবে গণ্য হতে পারবেন না।
আল কুরআন কাদের জন্য নাযিল হয়েছে ?
পবিত্র কুরআনুল হাকিমে এরশাদ হয়েছে, ‘আল কুরআন তো দুনিয়ার সকল নাগরিকের জন্য নসিহত বৈ আর কিছু নয়।’ (সুরা কালাম: আয়াত ৫২, সুরা তাকবির: আয়াত ২৭) ইহা সমগ্র মানব কওমের জন্যে অবতীর্ণ (সুরা বাকারা ১৮৫, সুরা ইউসুফ ১০৪)। মুসলিম, খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, নাস্তিক, শিখ, জৈন, মুরতাদ, ধর্মনিরপেক্ষবাদী, মার্কসবাদী, কমিউনিস্ট, তাওবাদী, সাম্যবাদী, ধর্মহীন, ধর্মপ্রিয়, প্রকৃতি পূজারি, গান্ধিপুজারি, অগ্নি উপাসক, সেকুলার, কুনফুসিয়াসধর্মী, রবিন্দ্রপুজারি তথা সকল ইনসান কওমের জন্য আল কুরআন। তাই কুরআন শুধু ইমানদার বা অযুকারীদের জন্য নয়। বেইমান বা অযুহীনদের জন্যও কুরআন। তদ্রুপ ইসলাম কেবল মুসলিমদের দীন নয়। ইহা সকল বনি আদমের দীন।
আল কুরআন কেন নাযিল হয়েছে ?
আল কুরআন শুধু হরফ প্রতি ১০ নেকি অর্জনের জন্য আসেনি। শুধু তেলাওয়াত আর সওয়াবের জন্য এর বাণী নাযিল হয়নি। বরং চিন্তার ক্ষেত্রে রেনেসাঁ-বিপ্লব সৃষ্টির জন্য এর আগমন। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘তোমরা ইহা নিয়ে চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করবে এবং জ্ঞানীরা এ কুরআন থেকে নসিহত লাভ করবে।’ (আল কুরআন: সুরা ৩৮ ছোয়াদ: আয়াত ২৯) জীবনের প্রথম কাজ হতে হবে কুরআন অধ্যয়ন। আল্লাহর রসুল স. ইরশাদ করেন, ‘হে কুরআনের ধারকগণ! তোমরা কুরআনকে বালিশ বানাবে না, বরং তা তেলাওয়াত করার মতো করবে। রাতদিন তা প্রচার করবে এবং সুর দিয়ে পড়বে, তাতে যা কিছু আছে তা নিয়ে গবেষণা করবে, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো। তার নগদ সওয়াব চেয়োনা। কেননা তার সওয়াবের মতো সওয়াব রয়েছে। (মিশকাত, বায়হাকি, বর্ণনায় আবিদামুলাইক রা.)
উন্নয়ন অগ্রগতির সোপান কী?
দুনিয়াতে উন্নয়ন অগ্রগতির সোপান হলো আল কুরআন। নবি করিম স. এর বাণী, ‘আল্লাহ এই কুরআনের মাধ্যমে একদল লোককে উন্নত করবেন এবং অপর দলের পতন ঘটাবেন (মুসলিম; বর্ণনায় উমার রা.)। অর্থাৎ কুরআনের জ্ঞানই দুনিয়াকে পরিচালিত করবে। কুরআনসুন্নাহর জ্ঞান যারা অর্জন করবে তারাই দুনিয়ার নেতৃত্ব দিবে। সহস্র বছর মুসলমানদের কাছে কুরআনের জ্ঞান ছিলো। তখন পৃথিবীর শক্তিমান জাতিগুলো ও রাজা-বাদশাহরা মুসলমানদের পদপ্রান্তেলুটিয়ে পড়ত। আর বর্তমানে এই দুরাবস্থা কেন? কুরআনকেমলাটবন্দী, কাপড় মুড়িয়ে মাথার উপরে সেল্ফে সংরক্ষণ, এর ভেতরের মর্মার্থ, মর্মকথা, সারমর্ম, বিষয়বস্তু উদ্ধারে অনীহার কারণেই আমরা ছিটকে পড়েছি অগ্রযাত্রা থেকে। কিন্তু এটা তো হবার কথা ছিলো না।
আল কুরআন মহাবিশ্বের সেরা বিস্ময়
সম্পূর্ণ কুরআন বিস্ময়কর বর্ণনা ভঙ্গিতে বাঙময়। এ গ্রন্থ পাঠকের সংকীর্ণ হৃদয়ের দুয়ার খুলে তাকে প্রসারিত করে দেয় বিশ^ময়। অতি সাধারণ বিষয়ও অপরূপ হয়ে ফুটে উঠেছে এ মহাকিতাবে। অতিক্ষুদ্র বিষয়কে ঘিরে উঠেছে মহিমা মন্ডল। বিভিন্ন বিষয়ের পুনরুক্তি ও প্রতিধ্বনিতে এখানে পাঠক কখনো আড়ষ্ট হয়ে পড়ে না। কেবলই হয়ে উঠে জীবন্ত, উদ্দীপ্ত ও সতেজ। আল কুরআন অনুপম অনবদ্য মনোবল পয়দা করে, শ্রোতা ও পাঠকের চিন্তার রাজ্যে বিপ্লব সৃষ্টি করে, চরিত্র বিপ্লবে বিস্ময়কর এবং সমাজ জাতি রাষ্ট্র বদলে সর্বাধিক প্রভাবশালী। তাই মুমিনের চলনে, করণে, বলনে, মননে, শয়নে, স্বপনে যেন আল কুরআনচিরজাগরুক থাকুক এই হোক আমাদের প্রার্থনা।
শ্বাশ্বত জীবনের অকাট্য ধারণা উপস্থাপক
কুরআনমানবজীবন সম্পর্কে বস্তুবাদী ধারণা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। কুরআন মানব জীবনকে এক অটুট পূর্ণাঙ্গ ও শ্বাশ্বত জীবন হিসেবে পেশ করেছে। পার্থিব জীবনে মানুষের যে মৃত্যু হয় তা তার জীবনের মৃত্যু নয়, দৈহিক মৃত্যু। এই পার্থিব জীবনই তার পরকালীন জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতার ভিত্তি। কুরআন প্রদত্ত এ ধারণায় ইমানদাররা তাদের পার্থিব জীবনকে পরকালীন সাফল্যের জন্য নিয়োজিত করে। বিশ্বাসীরা বিস্ময়করভাবে পারলৌকিক সাফল্যের জন্য ইহলৌকিক স্বার্থকে ত্যাগ করতে সদা প্রস্তুত।
যাবতীয় ফিতনা ও বিপর্যয় থেকে বাঁচার উপায় কী?
আলি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আল্লাহর রসুল স. কে বলতে শুনেছি যে, সাবধান থাক! অচিরেই ফিতনা বা ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়বে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রসুল, তা থেকে বাঁচার উপায় কী? তিনি বললেন, আল্লাহর কিতাব, যাতে তোমাদের পূর্বপুরুষদের ঘটনা বিদ্যমান এবং ভবিষ্যতকালের খবরও বিদ্যমান। আর তাতে তোমাদের জন্য উপদেশাবলি ও আদেশ নিষেধ রয়েছে, তা সত্য ও অসত্যের মধ্যে ফয়সালা দানকারী এবং তা উপহাসের বস্তু নয়। যে কেউ তাকে অহংকারপূর্বক পরিত্যাগ করে, আল্লাহ তাকে ধ্বংস করেন। আর যে ব্যক্তি তার হিদায়াত ছাড়া অন্য হিদায়াতের সন্ধান করে আল্লাহ তাকে পথভ্রষ্ট করেন। ইহা আল্লাহর দৃঢ় রশি, মহাজ্ঞানীর বয়ান ধারণকারী গ্রন্থ এবং সহজ ও সরল পথের দিক নির্দেশনাকারী, যা দ্বারা মানুষের অন্ত:করণ কলুষিত হয় না, মানুষ সন্দেহে পতিত হয় না এবং ধোঁকা খায় না। তার দ্বারা আলেমগণ তৃপ্তি লাভ করে না। বার বার পাঠ করলেও পুরানো হয় না, তার অভিনবত্বের শেষ হয় না। যখনই জিন জাতি তা শুনলো, তখনই সাথে সাথে তারা বললো, নিশ্চয়ই আমরা আশ্চর্য কুরআন শুনেছি, যা সৎ পথের দিকে লোককে ধাবিত করে। সুতরাং আমরা এর প্রতি ইমান এনেছি। যে ব্যক্তি কুরআন মোতাবেক কথা বললো, সে সত্যই বললো, যে তাতে আমল করলো, সওয়াব প্রাপ্ত হলো, যে কুরআনমুতাবেক হুকুম করলো সে ন্যায় বিচার করলো, যে ব্যক্তি কুরআনের দিকে মানুষকে ডাকবে, সে সৎপথ প্রাপ্ত হবে। (তিরমিযি)
মিথ্যাকে ধ্বংস করে আল কুরআন
ইসলামের মূল উৎস আল কুরআনমানবতারমুক্তিবার্তা। এই বার্তা মুক্তির দুর্জয় আলোকচ্ছটাতীর্যক বেগে নিক্ষেপ করে মিথ্যা, বাতিল ও অন্যায় অসত্যের গাত্রদেহে। এই আঘাতের অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়ায় পরাভূত হয়ে চূর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে যায় মিথ্যা বাতিলের ঘন প্রাচীর। মহাকিতাবের বাণী, ‘বরং আমি সত্য (কুরআন) দিয়ে মিথ্যার উপর আঘাত হানি। ফলে তা মিথ্যাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেয় এবং তাতে তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। (সুরা আম্বিয়া ১৮) দুনিয়ার দুর্নিবার আকর্ষণে বিশ^ জনসমাজ বিভ্রান্ত। এই জড়পূজা, বস্তুবাদিতা, পথবিচ্যুতিরমোহমুক্তির শেষ ভরসাস্থলমহাগ্রন্থ আল কুরআন।
আল কুরআনে ইতিহাসের ঘটনা
আল কুরআন কেবল হেদায়েতের কিতাব নয়, ইহা পূর্ণ নির্ভরযোগ্য ইতিহাস বিজ্ঞানও বটে। অতীত বর্তমান ভবিষ্যতকালের একটি পরিষ্কার রেখাচিত্র আল কুরআনে বিদ্যমান। অজানা বিষয়ে অহি, অনাগতকালের বিবরণ বিরাজমান এই মহাগ্রন্থে। প্রাচীনকালের বড় বড় ঘটনার নিখুত বর্ণনায় সমৃদ্ধ আল কুরআন; যা সাম্প্রতিক গবেষক, বিশেষজ্ঞ ও পন্ডিতরা অবহিত হতে পেরেছেন অল্প কয়েকদিন আগে। হাজার হাজার বছর যাবত ইতিহাসের এসব বিষয়াবলি ছিলো মানব চক্ষুর অন্তরালে। ধারণাতীত ঐতিহাসিক উপাদান এবং ঘটনাবলি জানতে পেরে এ যুগের মনীষীরা বিস্ময়ে হতবাক। আদ জাতি, ইরাম নগর, ব্যাবিলন, হামান, ফিরাউন, সাবা নগরী, সামুদ বা সেমেটিক, নুহের প্লাবন প্রভৃতি ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনাসমূহ কুরআনে জীবন্ত।
আল কুরআনে বিজ্ঞান
বিগব্যাংগ বা মহাবিশ্বসৃষ্টি, ভূতত্ত্ব, ভ্রুণ বিজ্ঞান ও শরীরবিদ্যা, সমুদ্র বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, এ সংসারে বনি আদমের পদার্পণ, মানুষ সৃষ্টিকথা ও সৃষ্টির উপাদান, আঙ্গুলের ছাপ, মধু ও মামাছির রহস্য, মাতৃগর্ভে শিশুর জন্ম, অবস্থান ও পরিবৃদ্ধি, প্রাণের উৎস পানি, অঙ্গ ব্যবচ্ছেদ ও ভ্রুণতত্ত্ব, পৃথিবী গোলাকার, সাগরের প্রাণী ও পানি রহস্য, মেঘমালা, পাহাড়ের পেরেক, সমুদ্রতলের পরিবেশ, জ্যোতিষ্কম-লি প্রভৃতির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রহস্য আবিষ্কৃত হয়েছে সবেমাত্র। মানুষ এগুলো জানতে পেরেছে গত শতকে। অথচ আল কুরআনে এগুলোর ইঙ্গিত দিয়েছে দেড় হাজার বছর আগে।
সভ্যতার অগ্রযাত্রায় আল কুরআন
আল কুরআননাযিলের পূর্বে আরবকে শতাব্দির পর শতাব্দি যাবত অজ্ঞতা, মূর্খতার গ্লানি বহন করতে হয়। লেখাপড়া, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা ছিলো তাদের কাছে অজ্ঞাত। অথচ কুরআনমর্তের দুনিয়ায় আসার কয়েকশ বছরের ব্যবধানে আরব হয়ে ওঠে বিশ^ তাহযিব-তামাদ্দুন, জ্ঞান-প্রজ্ঞার কেন্দ্রভূমি। ইলম আহরণের ঠিকানা হয় মাক্কা, মাদিনা, বাগদাদ, দামেস্ক, কায়রো, মরক্কো, কর্ডোভা, কাবুল, বুখারা, সমরকন্দ। পাঁচ শতাব্দি যাবত দর্শন, সাহিত্য, রসায়ন, ভূগোল, শরীরবিদ্যা, গণিতশাস্ত্র, সমুদ্রবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞানের রাজধানী ছিলো বাগদাদ। ১২৫৮ সালে নিষ্ঠুর হালাকু খানের বর্বরতায় বাগদাদ ধ্বংস হয়। পুড়িয়ে ফেলে লাখ লাখ কিতাব। এভাবে বিলুপ্ত হয় সাড়ে ছয়শ বছরের আহরিত জ্ঞান সম্পদ। পোড়া বই পুস্তকের ছাইয়ে সেদিন ভরে গিয়েছিল দজলা-ফোরাত নদী। যদি সেদিন বাগদাদের গ্রন্থরাজি রক্ষা পেত তাহলে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান, তথ্য প্রযুক্তি তথা ইন্টারনেট, সোসালমিডিয়া, সাগর বিজয়, মহাকাশ বিজয়, রকেট, বিমান, চিকিৎসা বিজ্ঞানের লেটেস্টভার্সন আরও ৫০০ বছর আগে আবিষ্কৃত হতো। তারপরও বাগদাদের বাইরে স্পেনে টিকে যাওয়া জ্ঞানের আলোকরশ্মি থেকে জ্ঞান আহরণ করেই ইউরোপ আধুনিক সভ্যতার অধিনায়কের পদ লাভ করে। তাই আজও কুরআন বিশ্লেষণ ও চিন্তাগবেষণার মাধ্যমে জ্ঞানের সকল শাখায় আধিপত্য বিস্তার সময়ের ব্যাপার মাত্র।
দরকার শিক্ষা ব্যবস্থায় কুরআন-হাদিস
বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শত শত বিষয়ে পাঠদান করা হয়। কিন্তু কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিলে আর কোথাও আল কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কিত কোনো সাবজেক্ট নেই। তাই সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় অহির জ্ঞান শেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা। মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠান, বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষার সকল স্তরে আল কুরআন, আল হাদিস, তাফসির, কুরআন ও বিজ্ঞান, সিরাত, মহানবি স. এর জীবন, ইসলাম ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইসলামে মানবাধিকার, কুরআন ও জীববিজ্ঞান, কুরআন ও মহাকাশ বিজ্ঞান, কুরআন ও পদার্থবিদ্যার গতিপ্রকৃতি, সুন্নাহ ও বিজ্ঞান, ইসলাম ও আধুনিকতা, কুরআন ও তথ্যপ্রযুক্তি, কুরআন ও আর্কিওলজি ইত্যাদি সম্পর্কিত বিষয়াবলিপাঠদান করা হলে মানুষ সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারত।
জ্ঞানীরাই মুসলিম
মহানবি স. বলেছেন, জ্ঞানীরাই নবিদের উত্তরাধিকারী। (সুনান আবু দাউদ) অতএব অজ্ঞ, মূর্খ, বকলমরা রসুলের উত্তরসূরি হতে পারে না। তাই জ্ঞানীরাই মুসলিম। বিদ্বানরাই ইমানদার ও পরহেযগার। তিনি আরও বলেন, শয়তানের কাছে হাজার সাধক অপেক্ষা একজন শিক্ষক, জ্ঞানী, আলেম অধিক আশঙ্কার কারণ। (তিরমিযি; বর্ণনায় আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.) আর করআনচর্চাকারীরাই জ্ঞানী বা আলিম। নবি করিম স. ফরমান, স্পষ্ট করে কুরআন বিন্যাস কর এবং তার অভিনব বিষয়ের অনুসরণ কর। অভিনব বিষয় হলো তার হালাল হারাম। (বায়হাকি, মিশকাত; বর্ণনায় আবু হুরয়রা রা.) তাই অশিক্ষিত বনি আদমের পক্ষে মুমিন হওয়া সম্ভব নয়।
জ্ঞানীরাই সৌভাগ্যবান
আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘একটি ভালো কথা একটি ভালো গাছের মতো, মাটিতে যার বদ্ধমূল শিকড়, আকাশে যার বিস্তৃত শাখা, সবসময় সে দিয়ে যায় ফল আর ফল। আর একটি মন্দ কথা একটি মন্দ গাছের মতোই, সে গাছের মতো যাকে ভূমি থেকে উপুড়ে ফেলা হয়, যার কোনো স্থায়িত্ব নেই।’ (আল কুরআন: সুরা ১৪ ইবরহিম: আয়াত ২৪-২৬) আল কুরআনই সকল ভালো কথার সমাহার। বাকিসব মন্দ-ভালো কথার সন্নিবেশস্থল। কুরআনুল হাকিমের বিকল্প কোনো পুস্তক এ দুনিয়ায় নেই। রসুল স. বলেন, তোমাদের কেউ মসজিদে গিয়ে আল্লাহর কিতাবের দুটি আয়াত শিক্ষা দেয় না বা শিক্ষা করে না। অথচ এটা তার জন্য দুটি উটনি অপেক্ষা উত্তম। তিন আয়াত তিনটি উট অপেক্ষা এবং চার আয়াত চারটি উট অপেক্ষা উত্তম। মোটকথা, কুরআনের যে কোনো সংখ্যক আয়াত সমসংখ্যক উটনি অপেক্ষা উত্তম। (মুসলিম, বর্ণনায় উকবা বিন আমের রা.) ইমাম মালেক র. বলেছেন, মুসলিম জাতি যে জিনিসের বদৌলতে একদিন কল্যাণ ও সাফল্য লাভ করেছিল, শেষযুগেওকুরআনের বিধান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কল্যাণ লাভ করবে।
কুরআন ত্যাগকারীর পরিণাম ভয়াবহ
নবিজি স. বলেছেন, যে অহংকারীকুরআন ত্যাগ করবে আল্লাহ তার অহংকার চূর্ণ করবেন। যে ইনসান কুরআনের বাইরে হেদায়াততালাশ করবে, আল্লাহ তাকে গোমরাহকরবেন। (তিরমিযি, বর্ণনায় আলি রা.) কুরআন ছেড়ে দিলে কোনো আমল গ্রহণযোগ্য হবে না পরকালে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কুরআনকেইসাথী করতে হবে। মহান প্রভুর ঘোষণা, ‘এই কুরআন সঠিক পথের দিশারি। যারা অস্বীকার, অমান্য ও প্রত্যাখ্যান করবে তাদের প্রভুর আয়াত, তাদের জন্যে রয়েছে চরম নিকৃষ্ট বেদনাদায়কআযাব। (সুরা ৪৫ জাসিয়া: আয়াত ১১)
কুরআন অমান্যকারীদের স্থান জাহান্নাম
(কিয়ামাত দিবসে) অমান্যকারীদের দলে দলেজাহান্নামের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। তারা সেখানে পৌঁছামাত্রজাহান্নামেরদুয়ারসমূহ খুলে যাবে। তখন জাহান্নামেররক্ষীবাহিনী তাদের জিজ্ঞেস করবে, কী ব্যাপার, তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের কাছে কি নবি রসুলগণ যাননি? তারা কি তোমাদের সামনে আল্লাহর আয়াত (আল কুরআন) পেশ করেননি, শুনাননি? অমান্যকারীরা বলবে, হ্যাঁ শুনিয়েছিলেন এবং সতর্কও করেছিলেন (কিন্তু আমরা মানি নাই)- এই স্বীকৃতি তাদের কোনো কাজে আসবে না, তখনতো আল্লাহর দ- তাদের ওপর নির্ধারিত হয়েই গেছে। তখন তাদের বলা হবে: প্রবেশ করো জাহান্নামের দরজাসমূহ দিয়ে। এখন থেকে চিরকাল এই শাস্তির মধ্যেই পড়ে থাকবে।’ দাম্ভিকদের আবাস কতোইনা নিকৃষ্ট! (আল কুরআন: সুরা ৩৯ যুমার: আয়াত ৭১-৭২)
কুরআন চর্চা না করলে রসুল স. তার বিরুদ্ধে মামলা করবেন আল্লাহর আদালতে
(বিচারের দিন) আল্লাহর রসুল (নালিশ জানিয়ে) বলবেন: হে প্রভু! আমার লোকেরাই এ কুরআনকে পরিত্যক্ত করে রেখেছিলো। (আল কুরআন: সুরা ২৫ ফুরকান : আয়াত ৩০) অন্যদিকে আল্লাহর কিতাবের হক আদায় না করলে তাকে গাধার সাথে তুলনা করা হয়েছে। ‘‘যাদেরকে তাওরাতের বাহক বানানো হয়েছিলো, কিন্তু তারা তা বহন করেনি, তাদের উপমা হচ্ছে গাধা, যারা বইয়ের বোঝা বহন করে। এর চাইতেও নিকৃষ্ট উপমা হচ্ছে সেই সব লোকদের যারা আল্লাহর আয়াতকে মিথ্যা বলে। আল্লাহ এ রকম যালিমদের সঠিক পথ দেখান না। (আল কুরআন: সুরা জুমআ ৬২: আয়াত ৫)
কুরআনের সাথে না থাকলে হাশরের মাঠে অন্ধ করে উঠানো হবে
আর কেউ আমার ‘যিকর’ (কুরআন) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার দুনিয়ার জীবন হবে সংকীর্ণ (অশান্তি ও অস্বস্তিকর), আর কিয়ামতের দিন আমরা তাকে অন্ধ করে উঠাবো। সে বলবে: হে আমার প্রভু! পৃথিবীতে তো আমি চক্ষুষ্মান ছিলাম, এখানে কেন আমাকে অন্ধ করে উঠালে!’ তিনি বলবেন: এভাবেই তোমার কাছে যখন আমার আয়াত এসেছিলো, তখন তুমি তা ভুলে থেকেছিলে; ঠিক সেরকমই আজ তোমার প্রতি তোয়াক্কা করা হয়নি। (আল কুরআন: সুরা ২০ তোয়াহ : আয়াত ১২৪-১২৬)
কারআন বাদ দিয়ে অলি আউলিয়াদের অনুসরণ করা যাবে না
আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেন,
তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি যা (কুরআন) অবতীর্ণ হয়েছে তার অনুসরণ করো এবং তাকে ছাড়া অন্য অলি আউলিয়াদের অনুসরণ করো না। (আল কুরআন: সুরা ৭ আরাফ: আয়াত ৩)
সুতরাং মডেল, তারকা, শিল্পপতি, নায়িকা, গায়িকা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, অভিভাবক, নেতা, রাজনীতিবিদ, সরকার, প্রশাসক, চেয়ারমান, মন্ত্রী, আমলা, এমপি, আমির, পির, মুরাব্বি, উস্তাদ, শিক্ষক, অধ্যাপক, ইমাম, মুয়াজ্জিন, খতিব, ওয়ায়েজ, বাগ্মী, মাওলানা, কুতুব, দরবেশ, পাদ্রি, পুরোহিত, স্কলার, মনীষী, ধর্মতত্ত্ববিদদের অনুসরণ করার কোনো সুযোগ নাই।
কুরআন বুঝা সহজ
মহান রব বলেন, ‘আমি আল কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্যে সহজ করে দিয়েছি। এ থেকে উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কী? (আল কুরআন ৫৪: সুরা আল কামার: আয়াত ১৭,২২,৩২,৪০)
অতএব কঠিন, জটিল, দুর্বোধ্য, অসাধ্য মনে করে কুরআন যারা চর্চা করে না তারা ইসলামের গন্ডিবহির্ভূত। ইনসান জাতির কল্যাণ, সফলতা, মর্যাদা, মুক্তি, সুখ-শান্তি কুরআনুলকারিমেই নিহিত। নবি করিম স. বলেন, যে ব্যক্তি কুরআন অধ্যয়ন করে তা আমল করেছে, তার আব্বা আম্মাকে কিয়ামতের দিন এমন এক মুকুট পরানো হবে, যা সূর্যের কিরণ থেকে হবে উজ্জ্বল। (আহমদ, আবু দাউদ; বর্ণনায় মুয়াযজুহানি রা.) তাই কুরআনের সাথে রিশতা পয়দা করাই হোক নাগরিক সমাজের অঙ্গীকার।
অনন্ত জ্ঞানের উৎস আল কুরআন
আল কুরআন জ্ঞানের এক ফল্গুধারা, যে জ্ঞান কখনো নি:শেষ হয় না। এর জ্ঞানভা-ার কখনো অতীতের গর্ভে বিলীন হয় না এবং ভবিষ্যতের আগমনে বিতর্কিত বা বাতিল হয় না। সূর্যালোকের মতো প্রতিদিনই ঘটে এর জ্ঞানের নবোদয়। ‘আমরা অচিরেই তাদের দেখাবো আমাদের নির্দেশনাবলি দুনিয়ায় এবং তাদের নিজেদের মধ্যে, তখন তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, এ কুরআন এক মহাসত্য। তোমার প্রভুর ব্যাপারে কী একথা যথেষ্ট নয় যে, তিনি প্রতিটি বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী? (সুরা ফুসসিলাত ৫৩)
কুরআনি দাওয়াতের বিশ্বজনীনতা
আল কুরআন নির্দিষ্ট কোনো গোত্র, সম্প্রদায়, বর্ণ বা নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চল, রাষ্ট্রীয় সীমারেখা বা দেশের জন্য আসেনি। বরং সব মানুষের ধর্মগ্রন্থ আল কুরআন। সব দেশের, সবসময়ের জন্য আল কুরআনের দাওয়াত প্রযোজ্য। চিলি থেকে জাপান পর্যন্ত, উত্তর গোলার্ধ, পশ্চিম গোলার্ধ, দক্ষিণ গোলার্ধ, উত্তর গোলার্ধ তথা ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা, ওশেনিয়ার সকল মানুষের জন্যই আল কুরআনের দাওয়াত।
জ্ঞান ও জ্ঞানীর মর্যাদা
মুয়ায বিন জাবাল রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রসুল স. ফরমানঃ
তোমরা জ্ঞান অর্জন কর, কারণ ঃ
১। জ্ঞান অর্জন দ্বারা অন্তরে আল্লাহভীতি সৃষ্টি হয়।
২। জ্ঞান অন্বেষণ একটি ইবাদত।
৩। জ্ঞান চর্চা একটি তসবিহ।
৪। জ্ঞান গবেষণা একটি জিহাদ।
৫। যার যে জ্ঞান নেই তাকে তা শিক্ষা দেয়া একটি দান।
৬। উপযুক্তকে জ্ঞান দান করা একটি আত্মীয়তা।
৭। জ্ঞান হালাল-হারামের নির্ণায়ক।
৮। জ্ঞান জান্নাত-প্রত্যাশীদের পথের প্রদীপ।
৯। জ্ঞান নির্জনে বন্ধু।
১০। জ্ঞান পথ চলার সাথী।
১১। জ্ঞান একাকিত্বে আলোচক।
১২। জ্ঞান সুসময় ও দুঃসময়ের পথপ্রদর্শক।
১৩। জ্ঞান শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র।
১৪। জ্ঞান বন্ধুমহলে অলংকার।
১৫। জ্ঞানীদের আল্লাহ মর্যাদা দান করেন।
১৬। জ্ঞানীরা কল্যাণের কাজে নেতৃত্ব দেয়।
১৭। জ্ঞানীদের কর্ম অনুসরণ করা হয়।
১৮। জ্ঞানীদের মতামত মেনে নেয়া হয়।
১৯। ফেরেশতারা জ্ঞানীদের বন্ধুতারপ্রত্যাশী হয়।
২০। ফেরেশতারা জ্ঞানীদের শরীরের ডানার পরশবুলিয়ে দেয়।
২১। জ্ঞানীদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে সকল তাজা এবং নিরস বস্তু, পানির মাছ, স্থলের হিংস্র জানোয়ার আর নিরীহ পশু-পাখি।
২২। জ্ঞান হৃদয়কে অজ্ঞতার মৃত্যু থেকে জীবন্ত করে তোলে।
২৩। জ্ঞান অন্ধকারে দৃষ্টির আলো।
২৪। জ্ঞান ব্যক্তিকে ইহকাল-পরকালে মহৎ ব্যক্তিদের মর্যাদায় সমাসীন করে।
২৫। জ্ঞান নিয়ে ভাবনা সাওমেরসমতুল্য।
২৬। জ্ঞান বিনিময় সালাতেরসমতুল্য।
২৭। জ্ঞান আত্মীয়তার রিশতা মজবুত করে।
২৮। জ্ঞান চিনিয়ে দেয় বৈধ আর অবৈধ।
২৯। জ্ঞান কর্মের পথ প্রদর্শক।
৩০। কর্ম জ্ঞানের অনুগামী।
৩১। সৌভাগ্যবানেরাই জ্ঞানার্জন করে।
৩২। জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হয় দুর্ভাগারাই।
[ইবনে আবদুল বার আন নামেরি। তিনি বলেছেন, এটি একটি হাসান হাদিস।]
আল কুরআনের মৌলিক বিষয়াবলি:
►আল কুরআন কী?
– সংবিধান। (আল কুরআন সুরা ৩ আল ইমরান : আয়াত ১৩৮; সুরা ৬৫ আত তালাক: আয়াত ৫, সুরা ইউসুফ ৪০)
►আল কুরআন বুঝা সহজ না কঠিন
-সহজ। ‘আমি আল কুরআনকে উপদেশ গ্রহণের জন্যে সহজ করে দিয়েছি। (সুরা আল কামার: আয়াত ১৭,২২,৩২,৪০)
►আল কুরআন জীবিত না মৃত্যু লোকদের জন্য বেশি জরুরি?
– আল কুরআন সকল জীবিত ইনসানের জন্য বেশি জরুরি। ‘ ইহা তো কেবল এক উপদেশ; যাতে রসুল সতর্ক করেন এমন ব্যক্তিকে যিনি জীবিত। (সুরা ইয়াসিন ৬৯-৭০)
►কোন কিতাবের ইত্তেবা করতে হবে?
-কেবল আল কুরআনের। ‘তোমাদের রবের তরফ থেকে যা কিছু উত্তম তোমাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে তা মেনে চল, তোমাদের ওপর অতর্কিতে ও অজ্ঞাতসারে আযাব আসার পূর্বে। (সুরা জুমার ৫৫)
►আল কুরআন বাদ দিয়ে ব্যক্তির অনুসরণ করা যাবে কী?
– না। ‘তোমরা অনুসরণ কর যা তোমাদের কাছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে নাযিল (আল কুরআন) করা হয়েছে এবং তাকে ছেড়ে তোমাদের অলিআউলিয়া বা অন্য মিত্রদের অনুসরণ কর না। তোমরা খুব সামান্যই উপদেশ গ্রহণ কর। (সুরা আরাফ ৩)
►আল কুরআন কোথায় সংরক্ষিত?
– লাওহেমাহফুজে-সুরক্ষিত ফলকে বা আল্লাহর কাছে উম্মুল কিতাবে (সুরা যখ্রুফ-৪)
►কীভাবে মানুষকে নসিহত করতে হবে?
– আল কুরআনের সাহায্যে উপদেশ দিতে থাকুন। (সুরা কাফ-৪৫)
►আল কুরআন অনুধাবন করা কী?
– ফরজ। ‘তবে কী তারা কুরআন সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা করে না?যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো তরফ থেকে এ কুরআন আসত তবে তারা এতে অনেক বৈপরীত্য পেত। (সুরা নিসা-৮২)
►আল কুরআনের বিশেষত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব কী?
– যদি সকল ইনসান ও জিন এ উদ্দেশ্যে সমবেত হয় যে তারা এ কুরআনের অনুরূপ কুরআন রচনা করে আনবে এবং তারা পরস্পরের সাহায্যকারী হয় তবুও তারা কখনও এর অনুরূপ আনতে পারবে না। (সুরা বনি ইসরইল: ৮৮)
►আল কুরআনের প্রতি প্রথম ইমান আনেন কেন?
– পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নারী খাদিজা রা.
►আল কুরআনের প্রথম বাহক কারা?
– সাহাবায়েকিরাম
►আল কুরআন শব্দের অর্থ কী?
– অধিক অধিক পাঠ্য।
►আল কুরআনের মর্যাদা কী?
– মহাবিশে^র মালিক মহান আল্লাহর বাণী।
►আল কুরআন কার প্রতি নাযিল হয়েছে?
– মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ স. এর প্রতি
►রসুল স. এর নিকট আল কুরআনের বাহক কে?
– জিবরিল আমিন
►আল কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে কাদের জন্য?
– সমগ্র মানবজাতি। মুসলিম, খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, নাস্তিক, শিখ, জৈন, মুরতাদ, ডানপন্থী, বামপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষবাদী, মার্কসবাদী, কমিউনিস্ট, ধর্মহীন, ধর্মপ্রিয়, প্রকৃতি পূজারি, অগ্নিউপাসক তথা সব ইনসানের কল্যাণ ও সফলতার জন্য।
►আল কুরআনের মূল বিষয়বস্তু কী?
– মানুষ
►আল কুরআননাযিলের উদ্দেশ্য কী?
– মানুষকে তার হেদায়েত, মুক্তি ও সাফল্যের পথ দেখানো।
►আল কুরআনের ভাষা কী?
– আরবি। পৃথিবীতে একমাত্র কুরআনই একটি আন্তর্জাতিক ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অন্যকোনো গ্রন্থ এ গৌরবের অধিকারী নয়।
►আল কুরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হলো কেন?
– আল্লাহর রসুল স. ও তাঁর প্রথম শ্রোতারা ছিলেন আরবি ভাষাভাষী।
►আল কুরআননাযিলের পদ্ধতির নাম কী?
– অহি
►আল কুরআন কোন ধরনের অহি?
– অহি মাতলু (তিলাওয়াতকৃত অহি)
►প্রথম অবতীর্ণ অহি কোন আয়াত?
– সুরা ৯৬ আল আলাক এর প্রথম ৫ আয়াত।
►শেষ অবতীর্ণ অহি কোন আয়াত?
– সুরা ০২ আল বাকারা: আয়াত ২৮১
►আল কুরআনের প্রথম সুরা
– সুরা ফাতিহা
►আল কুরআনের বড় সুরা
– আল বাকারা
►শব্দ সংখ্যায় সবচেয়ে ছোটো সুরা:
-সুরা ১০৮ কাওসার
►আল কুরআননাযিলের সূচনা কোন মাসে?
– রমযান মাসে
►আল কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার সূচনা সময়:
– ৬১০ ইসায়ি সালের আগস্ট মাস
►আল কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার সমাপ্ত সময়:
– ইসায়ি ৬৩২
►আল কুরআননাযিলের সূচনা কোথায়?
-জাবালুন নুরের হেরা গুহায়।
►আল কুরআননাযিলের সূচনা কোন শহরে?
– মাক্কায়
►আল কুরআননাযিলের রাতকে বলা হয়:
– লাইলাতুল কদর (মর্যাদাবান রাত)
►আল কুরআনের মূল উপাদান কয়টি?
-দুটি। ভাষা ও বক্তব্য (বিষয়)
►আল কুরআনে অবতীর্ণ প্রথম শব্দ কী?
– ইকর বা পড়ো
►ইসলাম কাদের ধর্ম?
– সমগ্র মানবজাতির
►মুহাম্মাদ স. কাদের নবি-রসুল?
– সমগ্র মানবজাতির
►কুরআন কেন অবতীর্ণ হয়েছে?
– মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসার জন্য। (আল কুরআন: সুরা ইবরহিম: আয়াত ১)
►আল কুরআন আল্লাহ কেন পাঠিয়েছেন?
-আল্লাহ কুরআন এজন্য অবতীর্ণ করেছেন যে, তোমরা ইহা নিয়ে চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করবে এবং জ্ঞানীরা এ কুরআন থেকে নসিহত লাভ করবে।’ (আল কুরআন: সুরা ৩৮ ছোয়াদ: আয়াত ২৯)
►আল কুরআনের প্রথম আহবান কী?
– ইকর। অর্থাৎ পড়, অধ্যয়ন কর, আবৃত্তি কর, বুঝ, চর্চা কর, প্রচার কর, গবেষণা কর, জানা, মানা, অনুসরণ করা।
►ইসলামের প্রথম কাজ কী?
-কুরআন চর্চা
►ইসলামের প্রধান প্রতিপক্ষ কারা?
-ইহুদি, মুশরিক, মূর্তিপূজক। ‘আপনি সকল মানুষের মধ্যে মুমিনদের প্রতি অধিক শত্রুতাপোষণকারী পাবেন ইহুদি ও মুশরিকদের। (সুরা মায়িদা ৮২)
►আল কুরআনের মূল তাফসির কী?
-স্বয়ং আল কুরআন
►আল কুরআনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাখ্যাতা কে?
-আল্লাহর রসুল মুহাম্মাদ স.
►আল কুরআনের হেফাজতের দায়িত্ব কে নিয়েছেন?
– নিখিল বিশে^র ¯্রষ্টা, পালনকর্তারব্বুলআলামিন আল্লাহ
►আল কুরআনের প্রতি মুসলমানের দায়িত্ব কী?
– জানা, মানা ও পৌঁছে দেয়া।
►আল কুরআন প্রথম গ্রন্থাকারে সংকলন করেন কে?
-প্রথম খলিফা আবু বকর রা.
►আল কুরআনের অহি নাযিলের পদ্ধতি কয়টি?
– তিনটি। ১। অন্তরে অনুভূতি সৃষ্টি (ইলহাম, ইলকা), ২। অন্তরাল থেকে আল্লাহর কথা বলা, ৩। বার্তাবাহকের মাধ্যমে (জিবরিল আমিন)
►আল কুরআনের ভিত্তিতে মানুষ কয় প্রকার?
– তিন প্রকার। ১.কুরআনের প্রতি বিশ্বাসী ২. কুরআনের প্রতি অবিশ্বাসী, ৩. কপট (মুনাফিক)
►আল কুরআনকে আল্লাহর বাণী বলে প্রথম শনাক্তকারী ব্যক্তি কে?
– আরাকা বিন নওফেল
►আল কুরআনেরতাফসিরের ভিত্তি কী?
– আল কুরআন ও সুন্নাহ
►আল কুরআনের প্রথম বাক্য কী?
– বিসমিল্লাহিররহমানির রহিম
►আল কুরআনের শেষ বাক্য কী?
– মিনাল জিন্নাতিওয়ান্নাস
►আল কুরআন যিনি মুখস্ত করেন তাকে কী বলে?
-হাফিজ
►আল কুরআনের যিনি তাফসির করেন:
– মুফাসসির
►আল কুরআন যারা সুন্দরভাবে পড়েন:
– কারি, কারিউলকুরআন
►বিসমিল্লাহ নেই কোন সুরায়?
– সুরা ৯ আততাওবা
►কোন সুরায় দুবার বিসমিল্লাহ রয়েছে?
– সুরা ২৭ আন নমল
►আল কুরআনে সাহাবির নাম এসেছে?
– এক জনের। যায়েদ বিন সাবিত রা.
►আল কুরআনে মহিলার নাম এসেছে:
– এক জনের। মারিয়াম
►আল কুরআনে ভালো মানুষের নাম এসেছে:
– ৭ জনের। লুকমান, উযায়ের, তালুত, ইমরান, মারিয়াম, যায়েদ, জুলকারনাইন।
►আল কুরআনে মন্দ মানুষের নাম এসেছে:
– ৭ জনের। আযর, ফিরাউন, হামান, কারুন, সামেরি, জালুত, আবু লাহাব।
►আল কুরআনে শহরের নাম এসেছে:
– ৭টি। মাক্কা, মাদিনা, মিশর, মাদায়েন, রোম, বেবিলন, সাবা।
►আল কুরআন আল্লাহর বাণী হবার প্রমাণ:
-স্বয়ং কুরআনই এর প্রমাণ।
►মিরাজের উপহার:
– সুরা ১৭ ইসরা
►আল কুরআনের প্রথম অবতীর্ণ পুর্ণ সুরা:
– সুরা ১ আল ফাতিহা
►বাংলাভাষায় আল কুরআনের প্রথম অনুবাদক কে?
-বাংলাভাষায় প্রথম আল কুরআনতরযমা করেন মুহাম্মাদনঈম উদ্দিন।
►আহলুলকুরআন কী?
– যিনি কুরআনমানেন, চর্চা করেন এবং শিক্ষা দেন তাকে আহলুলকুরআন বলে।
আল কুরআনের একটি সংক্ষিপ্ত পরিসংখ্যান
►আল কুরআনের সুরা, আয়াত, শব্দ, হরফ, হরকত সংখ্যা কত?
-মোট সুরা ১১৪, আয়াত সংখ্যা ৬২৩৬ (মতান্তরে ৬৬৬৬), শব্দ সংখ্যা ৮৬৪৩০, হরফ সংখ্যা ২২১২৬৫
►আল কুরআনের পারা, রুকু ও সাজদা সংখ্যা কত?
– পারা ৩০, রুকু ৫৪০, সাজদা ১৫ (মতান্তরে ১৪টি)
►আল কুরআনের হরকত সংখ্যা কত?
যবর- ৫৩২৪২, জের-৩৯৫৮২, পেশ-৮৮০৪, নুকতা-১০৬,১৮৪, মাদ-১৭৭১, তাশদিদ-১২৫২
►আল কুরআনে বর্ণমালা অনুসারে হরফ সংখ্যা:
আলিফ- ৪৮৮৭২, বা- ১১২২৮, তা- ১১৯৯, ছা- ১২৭৬, জিম- ৩২৭৩, হা-৭৭৩, খা-২৪১৬, দাল- ৫৬৪২, জাল-৪৬৯৭, র- ১১৭৯৩, ঝা-১৫৯০, সিন-৫৮৯১, শিন-২২৫৩, ছদ-২০১৩, দদ- ১৬০৭, ত-১২৭৪, য-৮৪৬, আইন-৯২২০০, গইন-২২০৮, ফা-৮৪৯৯, কাফ-৬৮১৩, কাফ-৯৫২২, লাম-৩৪৩২, মিম-২৬,৫৩৫, নুন-২৬৫৬০, ওয়াও-২৫৫৩৬, হা-১৯০৭০, লাম আলিফ-৩৭২০, হামযা-৪১১৫, ইয়া-২৫৯১৯
►আল কুরআনের আয়াতের শ্রেণিবিভাগ-
ওয়াদা- ১০০০ আয়াত, অয়িদ বা ভীতি প্রদর্শন-১০০০, আদেশ-১০০০, নিষেধ-১০০০, হালাল বিষয়ক-২৫০, হারাম- ২৫০, দৃষ্টান্ত- ১০০০, কাহিনি-৫০০, আল্লাহপাকের তসবিহ-১০০, বিজ্ঞান বিষয়ক-১০০০, বিসমিল্লাহ-১১৪
►আল কুরআনে আল্লাহর নাম এসেছে
-২৬৯৮ বার।
►আল কুরআনে রহমান নাম এসেছে
– কুরআনে এসেছে ৫৭০০ বার।
►আল কুরআনে প্রতি আয়াতে আল্লাহর নাম এসেছে কোন সুরায়?
-সুরা ৫৮ মুজদালায়
►আল কুরআনে নবি রসুলের নাম এসেছে
– ২৫ জনের
►আল কুরআনেমুহাম্মাদের নাম এসেছে
– ৫ বার
►আল কুরআনের কয়টি নাম?
– ৯১টি
►সবচেয়ে ছোটো সুরার আয়াত সংখ্যা:
-তিন। সুরা ১০৩ আসর, সুরা ১০৮ কাওসার, সুরা ১১০ নাসর
হদিস :
১। আবদুস শহীদ নাসিম: আদর্শ নেতা মুহাম্মাদ রসুলুল্লাহ স., শতাব্দী প্রকাশনী ঢাকা, নতুন সংস্করণ ২০১১
২। আবদুল হালিম খাঁ: মুসলামানদের প্রথম ফরয কাজ কুরআন পাঠ, মমমা প্রকাশনী, বদলগাছী, নওগাঁ, প্রথম প্রকাশ, মার্চ ২০১৪
৩। মেশকাত শরিফ, (শেখ অলিউদ্দিন মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ আল খতীবআততাবরেযি র. ও বাগভী র.; তরযমা- মাওলানা কামালুদ্বীন খান) আয়শাপাবলিকেশন্স, বাংলাবাজার ঢাকা, প্রথম প্রকাশ আগস্ট ২০০৯
৪। আবদুস শহীদ নাসিম, জানার জন্যে কুরআন, মানার জন্যে কুরআন? শতাব্দী প্রকাশনী, ৪র্থ মুদ্রণ মে ২০১০
৫। আবদুস শহীদ নাসিম, আল কুরআন কী ও কেন? শতাব্দী প্রকাশনী, ২য় মুদ্রণ মে ২০১১
৬। হাদীস শরীফ, সংকলন ও সম্পাদনা: রফিক উল্লাহ, হরফ প্রকাশনী, এ-১২৬ কলেজ স্ট্রীট মার্কেট, কলকাতা-৭, ৩য় সংস্করণ জানু. ১৯৯০
৭। আন্নূর, কুরআন-হাদীস অধ্যয়ন ফোরাম, চতুর্থ বার্ষিক সম্মেলন ২০১৫, সম্পাদনা: প্রকাশনা উপ-পরিষদ
৮। গোপাল হালদার: সংস্কৃতির রূপান্তর, পুথিঘর, ২২ নং লর্ড কর্ণওয়ালিসষ্ট্রীট, কলিকাতা, পশ্চিমবঙ্গ
৯। মাওলানা আবদুস শহীদ নাসিম: আল কুরআন সহজ বাংলা অনুবাদ, বাংলাদেশ কুরআন শিক্ষা সোসাইটি, শতাব্দি প্রকাশনী ঢাকা, এপ্রিল ২০১৩ ইসায়ি
১০। আবুল আলা: আল কুরআনেরমর্মকথা, আধুনিক প্রকাশনী বাংলাবাজার ঢাকা।
১১। আবদুস শহীদ নাসিম: আল কুরআন বিশ্বের সেরা বিস্ময়, শতাব্দী প্রকাশনী ঢাকা, আগস্ট ২০১২
১২। ড. লরেন্স ব্রাউন: ¯স্রষ্টার সর্বশেষ প্রত্যাদেশ, (ভাষান্তর- উম্মেতাহযিন), তাওহিদপাবলিকেশন্স, বংশাল, ঢাকা-১১০০, নভেম্বর ২০১১
১৩। ডা. খন্দকার আব্দুল মান্নান: কম্পিউটার ও আল কুরআন, ইশায়াতে ইসলাম কুতুব খানা, মারকাযেইশায়াতে ইসলাম, দারুসসালাম, মিরপুর, ঢাকা-১২১৮, এপ্রিল ১৯৯৭ ইসায়ি।
সংকলক: মাহমুদ ইউসুফ