আল হাফিজ ।।
কবিরা সাধারণত জাদুকরী পদ্যের পেখম মেলে মনের কথা বলেন আবেগময় ভাষায়, আর কবিতা তো আবেগকে জাগ্রত করার এক সুন্দর শিল্পমাধ্যম। আবেগের সঙ্গে বেগের মিলন ঘটিয়ে কবিরা সৌন্দর্যের এমন এক জগৎ সৃষ্টি করেন যার স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে মানুষ। কেননা কবিতা মানুষের সরল স্বপ্নের নান্দনিক বয়ানে সতত সজাগ; হৃদয়ের ভাষা দিয়ে সহজিয়া কলাকৌশলে যা প্রকাশিত হয়। এই কলাকৌশল কতোটা মাঙ্গলিক তা বিবেচনা করবেন পাঠক সমাজ। তবে দেশ জাতি ও সমাজকে স্বপ্ন দেখিয়ে কল্যাণের পথে এগিয়ে নেয় কবিসমাজ।
কবিতা আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা বলে, ভালোবাসার কথা। আশা-আকাঙ্ক্ষা আর ভালোবাসার কথা বলতে আবেগের শিল্পিত প্রয়োগ জরুরি। এমনই শিল্পিত আবেগ নিয়ে ‘সবুজ পাতার কানের দুল’ শীর্ষক কিশোর কবিতার বই রচনা করেছেন কবি শাহরিয়ার মাসুম। সহজ-সরল ভাষায় জীবনের নানামুখী আনন্দ-বেদনার গাঁথা উপমা-রূপকের মাধ্যমে বলার চেষ্টা করেছেন তিনি। তার ভাষায় রয়েছে সহজ জীবনদর্শন ও রোমান্টিক পরিবেশ, রয়েছে জীবন যাপনের আদর্শিক ছায়াচিত্র। ফেলে আসা শৈশব-কৈশোরের এক অনন্য সাধারণ স্বপ্নের জগৎ। জৈবনিক চাওয়া-পাওয়া, স্বপ্ন-সম্ভাবনার কথা তিনি বলার চেষ্টা করেছেন সহজ-সরল প্রত্যয়ী ভাষায়। তার কবিতার একটি উজ্জ্বল দিক হলো তার স্মৃতিময় শব্দ প্রয়োগের নতুনত্ব, বাক্যশৈলীর অনন্য ব্যঞ্জনা ও চমৎকার উপমার ব্যবহার। যেমন-
ক. গাছের খোড়ল শূন্যকরে নিতাম সবুজ টিয়ে
রোদের সঙ্গে বৃষ্টি এলে খেকশিয়ালের বিয়ে।
– [ আবার যদি কিশোর হতাম, পৃষ্ঠা- ১২ ]
খ. কেমন আছো শেয়াল ডাকা গভীর বন?
আলোর দিকে তাকিয়ে থাকা চোখের পণ!
কেমন আছো নদীর বুকে হারানো সেই-
সবজেটে মাঠ, পেঁয়াজ কলি কোথাও নেই!
– [ কেমন আছো, পৃষ্ঠা- ১৭ ]
মার্জিত রুচিস্নিগ্ধ ঐতিহ্য সচেতন শিশুসাহিত্যিক শাহরিয়ার মাসুম মূলত একজন গল্পকথক। রসরচনা তথা রম্যগল্প লিখে তিনি ইতোমধ্যেই যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছেন। তবে তার কিশোর কবিতায় যাপিত জীবনের বৈচিত্র্যপূর্ণ ছবি আঁকার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। তার কবিতার কেন্দ্রে রয়েছে শৈশবের স্মৃতিস্নিগ্ধ মা-মাটি আর মানুষ। তার কাব্যচেতনায় রয়েছে আনন্দময় নৈতিক আকাক্সক্ষা, সত্য-ন্যায় এবং মানবিক সৌন্দর্যের জীবন্ত উপলব্ধি যা তাকে সত্য- প্রেম- পবিত্রতার স্মৃতি সন্ধানী করে তোলে। ফলে তার কবিতায় সামাজিক সৌন্দর্য্য, দৈনন্দিন আনন্দ-বেদনার কথা উঠে আসে সহজ ভাষায়। তার পদ্যময় কবিতার প্রাণজ ভাব, ছন্দের অনুরণন এবং চিত্রকল্পের বর্ণিল কিছু পঙক্তি নিম্নে তুলে ধরছি-
ক. রাত্রি নিঝুম গভীর হলে লক্ষ তারা আকাশে
ফিসফিসিয়ে গল্প করে চাঁদকে বলে বাঁকা সে।
– [ চাঁদ ও তারার কথোপকথন, পৃষ্ঠা- ০৯ ]
খ. হতেও পারিস স্নিগ্ধ সকাল শিউলিঝরা ভোর
আকাশভাঙা জোছনা রাতে হাসনাহেনার ঘোর।
– [ মেঘের ডানায় ঝলমলে রোদ, পৃষ্ঠা- ১১ ]
গ. প্রজাপতি প্রজাপতি বলতে আমায় যদি
তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে বয় কি রঙের নদী?
– [ আমায় একটু রং দেবে, পৃষ্ঠা- ১৮ ]
এই পঙক্তিগুলো উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের মনের পর্দায় শৈশবের এমন কিছু চিত্র ভেসে ওঠে যা তাকে আবেগমথিত করে দেয়। তাকে জীবন ও প্রকৃতির মেলবন্ধনে ব্যাকুল করে তোলে। তার হৃদয় জুড়ে শৈশবে হতে না পারা জোছনা হতে সাহস যোগায় এবং নিঝুম রাতের গল্প শোনায়। এ রকম জীবনমুখী চিন্তা-চেতনার সহজ ভাষাচিত্র রয়েছে এই গ্রন্থের পাতায় পাতায়। এমন আবেগঘন অনেক বিষয়ে কবি উচ্চারণ করেছেন সাবলীল পঙক্তিমালায়। তার কবিতার ভাষা যেমন সহজ পদ্যগন্ধী তেমন তিনি ব্যবহার করেন সহজ উপমা-রূপক ও চিত্রকল্প। উদাহরণ হিসেবে তার উপমাশোভিত কয়েকটি পঙক্তি নিচে দেওয়া হলো-
ক. রুটির মতো ঠিক গোলাকার চাঁদের আলোয় রাত্রে
মাতাল হলো ইলিশ কাতল বোয়াল কুপোকাত রে!
– [ চাঁদের আলোয় বোয়াল কুপোকাত, পৃষ্ঠা- ১৯]
খ. বিগলিত সিজদায় ছুঁয়ে দাও মাটি
জোছনার মতো হও ধুয়ে পরিপাটি।
– [ আজান, পৃষ্ঠা- ০৭ ]
কবি শাহরিয়ার মাসুম চালতা ফুলের কারুকাজে মুগ্ধ, শিউলিফুলের ঘ্রাণে বিভোর এবং চাঁদ ও তারার গল্পের মধ্য দিয়ে যে ভাবনাচিত্র ফুটিয়ে তোলেন তা পাঠককে বিশেষ ভাবে ভাবায়। তাছাড়া মানুষের সুখ-দু:খ, আনন্দ-বেদনা, আশা-নিরাশা সবই তার কবিতায় ধরা দেয় নান্দনিক আন্তরিকতায়। নিছক শিল্পের জন্য শিল্প নয়। বরং সামাজিক অরাজকতা, জৈবনিক বাস্তবতা কোনো কিছুই বাদ যায় না তার কাব্যচিন্তা থেকে। ‘সবুজ পাতার কানের দুল’ নামক কাব্যগ্রন্থে যেমন ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার চিত্র ফুটে উঠেছে তেমনি উঠে এসেছে শৈশবের জন্য আকুলতার চিত্রও। প্রকৃতির নানান অনুষঙ্গ দিয়ে নানান ব্যঞ্জনায় সাজিয়ে তিনি মানুষের হারানো শৈশবকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন তার পদ্য পাতায়। তার কবিতা থেকে কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরছি-
ক. কোথায় গিয়ে মুখ লুকালো কোন নদীটার বাঁকে?
খুঁজলে আবার পাবো তাকে বুলবুলিদের ঝাঁকে!
– [ কোথায় গেলে পাবো তারে, পৃষ্ঠা- ০৮ ]
খ. আবার যদি কিশোর হতাম ভাবছি বসে বসে
তারার আলো চাঁদের গায়ে পড়তো খসে খসে।
– [ আবার যদি কিশোর হতাম, পৃষ্ঠা- ১২ ]
শিল্পসৌন্দর্য্যকে মান্য করে কবি অত্যন্ত দরদ দিয়ে আমাদের শৈশব-কৈশোরের মুগ্ধতাকে নান্দনিক উচ্চারণে ব্যক্ত করেছেন। ফলে তার পদ্যময় কাব্যভাষা ও ছন্দজ্ঞান, রূপবৈচিত্র্য ও আঙ্গিক, উপস্থাপনা কৌশল ও শব্দব্যবহারের স্টাইল এবং উৎকর্ষিত চিন্তার বহু বর্ণিল ব্যবহার পাঠকহৃদয় ছুঁয়ে যায়। তার কবিতায় কোনো দুর্বোধ্যতা নেই, নেই কোনো জড়তা, যা বলার তা সোজাসুজি বলার চেষ্টা করেছেন যা প্রকৃত শিশুসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য। মূলত এখানেই তার কবিতার পরিশীলিত নান্দনিকতার গূঢ় রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। ছন্দ-ভাব-চিন্তা-বিশ্বাস ও সৌন্দর্য্যে তার কবিতা অনন্য। তিনি তার শৈশবকে আজকের শিশু-কিশোরদের সামনে তুলে ধরেছেন খোলামেলা ভাবে। যেমন-
ক. হাতে নিয়ে গুলতি
ডালে ডালে ঝুলতি
মার্বেল কিছু নিয়ে
অকারণ ডানে-বামে
কী দোলা যে দুলতি!
– [ শৈশব, পৃষ্ঠা- ২৬ ]
খ. জোনাকপোকা দাঁড়াও খানিক
কোন বনেতে ছড়াও মানিক
একটু বলে যাও,
আমার ঘরে ।আঁধার নামে
নিক্তি মেপে সোনার খামে
একটু আলো দাও।
– [ জোনাক পোকা, পৃষ্ঠা- ২৯ ]
পদ্যশিল্পী শাহরিয়ার মাসুম এমনই বোধগম্য সুন্দর ভাষায় তার পঙক্তিমালা উপস্থাপন করেছেন ‘সবুজ পাতার কানের দুল’ নামক কিশোরকবিতাগ্রন্থে। প্রচ্ছদশিল্পী মোমিন উদ্দীন খালেদ কর্তৃক অলংকৃত ছোটদের সময় প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ২৫০ টাকা মূল্যের ক্রাউন সাইজ ৩২পৃষ্ঠার ঝকঝকে ছাপা ও সুন্দর প্রচ্ছদের এ গ্রন্থটি শিশু-কিশোর পাঠকসহ সমালোচকদের কাছে ভালো লাগবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। আমরা কবির সাফল্য কামনা করি। তার কাব্যজীবন সুষমামণ্ডিত হোক।