আল হাফিজ ও আযাদ আলাউদ্দীন ।।
শিল্প সাহিত্য ও সমাজ সংস্কৃতির পত্রিকা ‘সৃজন’ সম্প্রতি আমাদের হাতে এসেছে। বহুরঙে রঞ্জিত এ পত্রিকার সূচি থেকে জানা যায় এতে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন- যতীন সরকার, মাহবুব কামাল, সুস্নাত চৌধুরী, শামসুদ্দিন তৌহিদ, রেজাউল করিম রনি, সালাহ উদ্দিন নাগরী এবং রাজীব সরকার। গল্প লিখেছেন- রফিকুর রশীদ, মোজাম্মেল হক নিয়োগী, মোকাম্মেল হোসেন, উপমা তালুকদার এবং মোহাম্মাদ জামিল আক্তারের একগুচ্ছ অণুগল্প অনুবাদ করেছেন হাইকেল হাশমী। ভ্রমণ বিষয়ক একটি গদ্য লিখেছেন মইনুল ইসলাম। তবে এ সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য সংযোজন হলো আন্তর্জাতিক তাত্ত্বিক, ভাষাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও মার্কিন ভিন্নমতাবলম্বী সমালোচক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব নোয়াম চমস্কির সাক্ষাৎকার।
নোয়াম চমস্কি এমন একজন মানুষ যার চিন্তা-ভাবনা মুক্তমনের পরিচায়ক। যিনি আন্তর্জাতিক মানবসম্প্রদায়ের কল্যাণ সাধনায় সদা সচেষ্ট থাকেন। সম্প্রীতি তিনি ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমন, যুদ্ধে মিডিয়া ও প্রচারের ভূমিকা এবং হত্যাযজ্ঞ ও রক্তপাত বন্ধ করার জন্য যা বিশ্বাস করেন তা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করার জন্য অনলাইন সংবাদ প্রকাশের প্রতিষ্ঠান দ্য ইন্টারসেপ্টের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক জেরেমি স্কাহিল-এর মুখোমুখী হন। বাংলাভাষী পাঠকদের জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন মেজবাহ উদ্দিন।
‘সৃজন’ চলতি সংখ্যায় ৪৮টি কবিতা ছাপা হয়েছে,যা লিখেছেন মঈনুস সুলতান, মাহমুদ কামাল, সোহরাব পাশা, মাহবুব বারী, সাযযাদ আনসারী, আশরাফ মীর, মেহেদী ইকবাল, এরশাদ জাহান, মনিরা মনি, তৌহিদ আহাম্মেদ লিখন, সাজু কবির, রেখা আক্তার, হিমাংশু পাল, রেণু আক্তার, ঝা-া চাকলাদার, তন্ময় হাসান, হাছিবুর রহমান, আরিফুল ইসলাম, জয়নাল আবেদীন খান, মাসুম খান, মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম, ইকবাল পারভেজ, সৈয়দ আহমাদ তারেক, আনোয়ারুল হক, নয়ন আহমেদ, খলিলুর রহমান শুভ্র, কুলসুম আক্তার সুমী, তছলিম হোসেন হাওলাদার, মুহাম্মদ ফরিদ হাসান, হালিম আবদুল্লাহ, দেওয়ান মাসুদ রহমান, কাদের পলাশ, রেহমান আনিস, জাহিদ নয়ন, শাহিদুর রহমান, মুস্তাফিজুর রহমান মুস্তাক, মামুন আজাদ, রাহমান ওয়াহিদ, কৃত্তিকা নাহার, দ্বীপ সরকার, জাহিদ আককাজ, শিবলী মোকতাদির, অমিত রেজা চৌধুরী, সৌপর্ণ মাছুম, রকিব অমি, এ টি এম নিজাম, আমিনুল ইসলাম সেলিম এবং মেরাজ রাহীম প্রমূখ কবিগণ।
সুনির্বাচিত সাতটি প্রবন্ধের প্রথমটি লিখেছেন বিশিষ্ট তাত্ত্বিক গবেষক যতীন সরকার। ‘সুশীল সমাজ মানে ব্রাক্ষ্মণ সমাজ’ শীর্ষক এ প্রবন্ধে তিনি সুশীল সমাজের খোলনলচে নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। এতে আমাদের সুশীল সমাজের ভেতরগত বৈশিষ্ট্য এবং তাদের উত্থান-পতনের রহস্য খোলাখুলিভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে। ‘সংকটটা রাজনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিক’ শীর্ষক প্রবন্ধে বাংলাদেশের মানুষের যাপিত জীবনের সংকটের মূল কারণ ব্যাখ্যা করেছেন বিশিষ্ট্য সাংবাদিক মাহবুব কামাল। সুস্নাত চৌধুরীর ‘সংরক্ষণ মানে অমরত্ব, কবে বুঝবে লিটল ম্যাগাজিন?’ শামসুদ্দিন তৌহিদের ‘একটি লিটল ম্যাগাজিনের জন্মকথা’ এবং রেজাউল করিম রনি’র ‘মতাদর্শিক সংগ্রাম হিসেবে সাহিত্য: হাতিয়ার ছোট কাগজ’ শীর্ষক তিনটি লেখায় বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে নানামুখী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ , সংকট ও দায়-দায়িত্ব নিয়ে আলোচনা রয়েছে।
সালাহ উদ্দিন নাগরী’র ‘গ্লাডস্টোন’স লাইব্রেরি: আন্তঃসম্প্রদায় সম্প্রীতি উন্নয়নে অনন্য এক প্রতিষ্ঠান’ শীর্ষক লেখায় উঠে এসেছে জ্ঞানচর্চার এক অনন্য ব্যক্তিত্বের সাধনার কথা। এছাড়া রাজীব সরকার ‘জ্ঞান ও কাণ্ডজ্ঞান’ বিষয়ে এমন এক মনোজ্ঞ আলোচনা পেশ করেছেন যা বিশেষ তাৎপর্যের দাবি রাখে।
‘সৃজন’ বর্তমান সংখ্যায় চমৎকার ৫টি ছোটগল্প ও ৯টি অণুগল্প রয়েছে। মোজাম্মেল হক নিয়োগী’র ‘মেহেদির নীল রং’ গল্পটি আগেও একবার পড়েছি অন্য একটি সাহিত্য পত্রিকায়। গল্পটিতে করোনাকালীন এক নব বিবাহিত দম্পতির করুণ কাহিনি বর্ণিত হয়েছে সহজ-সরল আবেগময় ভাষায়। সেই সঙ্গে উঠে এসেছে সামাজিক অবক্ষয়ের কথাও। ‘সমুখে শান্তি পারাবার’ গল্পে গল্পকার রফিকুর রশীদ কবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের জীবনকেন্দ্রিক টানাপোড়েনের বিশ্লেষণ করেছেন যা পাঠকমনে দুঃখ জাগানিয়া আবহ সৃষ্টি করে। মোকাম্মেল হোসেনের ‘বন্যা তোমায় আমি অত্যধিক ভালোবাসি…’ গল্পটি কিছুটা রম্য ঘরানার হলেও আমাদের সমাজচিত্রের স্খলনের কথা দারুণভাবেই উঠে এসেছে। সাধারণভাবে সরল একটি গল্প লিখেছেন উপমা তালুকদার। তার গল্পের নাম ‘মায়ের বাড়ি’। তবে গল্পকার গল্পটি শেষ করেছেন ঝটিকা চমক দিয়ে। এখানেই তার সাফল্য।
একগুচ্ছ অণুগল্প লিখেছেন মোহাম্মাদ জামিল আক্তার। ‘ভয় থেকে বেরিয়ে’, ‘অবয়বহীনতার দুঃখ’, ‘দৌড়’, ‘বিক্রির জন্য মানুষ’, ‘আঁধারে অভ্যস্ত’, ‘এখানে পাখির মৃত্যু কোনো দুর্ঘটনা নয়’, ‘বড়ো বাসা’, ‘সমুদ্রের তীরে একটি বাসা’ এবং ‘বিনিময়’ শিরোনামের ৯টি অণুগল্প অনুবাদ করেছেন হাইকেল হাশমী। নাকি হাইকেল হাশমীর গল্প অনুবাদ করেছেন মোহাম্মাদ জামিল আক্তার কিছুই স্পষ্ট নয় আমাদের কাছে। কোথাও কোনো তথ্য সূত্রও নেই। তবে গল্পগুলো পাঠকের বোধকে নাড়া দেয়। এ গল্পগুলোর ভাব ও ভাষা, বর্ণনাকৌশল ও উপস্থাপনার কারিশমা শিল্পসুষমায় ভরপুর এবং মনোজগতে আলোর পরশ বুলায়। এই গুচ্ছ অণুগল্পের জন্য গল্পকার ও অনুবাদকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
‘যে পাহাড়ে সিংহ ডেকেছিল’ শিরোনামে একটি ভ্রমণ কাহিনি লিখেছেন মইনুল ইসলাম। এটি ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনির একটি অংশ যা ফ্রিটাউন পর্ব হিসেবে এখানে ছাপা হয়েছে। লেখক এখানে আফ্রিকা মহাদেশের সিয়েরা লিওনের ফ্রিটাউন ভ্রমণের এক মনোজ্ঞ বর্ণনা তুলে ধরেছেন। তার বর্ণনায় উঠে এসেছে সেখানকার সামাজিকতা, পরিবেশ-প্রকৃতি এবং নগরজীবনের বৈচিত্র্যময় দৃশ্যাবলি। সিয়েরা লিওনের ইতিহাস ঐতিহ্য ও জনশ্রুতির বর্ণনার মধ্য দিয়ে লেখক আমাদেরকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসেন ফ্রিটাউন থেকে। ছোট অথচ আনন্দদায়ক এ লেখা পড়ে অনেক কিছু জানতে পারবে পাঠক সমাজ। লেখাটির জন্য লেখক মইনুল ইসলামকে ধন্যবাদ।
আজকাল বাংলা কবিতা কেউ পড়তে চায় না কিন্তু লেখা হয় অনেক কবিতা এবং তা ছাপাও হয় বিভিন্ন মাধ্যমে। ‘সৃজন’ চলতি সংখ্যায়ও বেশ কিছু কবিতা ছাপা হয়েছে। কিছু কবিতা পড়ে পাঠক আনন্দ পাবেন আবার কিছু কবিতা পড়ে পাঠকের মনে এক ধরণের ভাবের সৃষ্টি হবে বলে মনে করি। চেনা-অচেনা, খ্যাত-অখ্যাত এই কবিদের কবিতায় আমাদের পরিবেশ-প্রকৃতি, প্রেম-বিরহ, দুঃখ-কষ্ট ও স্বপ্ন-সম্ভাবনার কথা উঠে এসেছে। উঠে এসেছে সামাজিক অবক্ষয়, আত্মসংকট ও টানাপোড়েনের কথাও। যেমন-
‘আমি’কে খুঁজতে গিয়ে
কখনোবা দিনে কখনোবা রাতে
আমাকেই পথে ফেলে আসি।’
– [ মাহমুদ কামাল, আমি ]
কিংবা,
‘কেবল মানুষ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো প্রাণী
কাঁটাতার ব্যবহারে পারদর্শী নয়
এখানে প্রত্যহ গন্তব্যের স্বপ্ন কাঁদে মানুষের।’
– [ সোহরাব পাশা, কাঁটাতারে বৃষ্টির কোলাহল ]
কিংবা,
‘ভোর হওয়ার সাথে সাথে ভালোবাসা ঝরে গেল।’
– [ মাহবুব বারী, জলবিম্ব ]
কিংবা,
‘আজ বৃষ্টি নামল তোমার কামনার মতো।
না। তুমিই নেমে এলে এই আঙিনায়;
অনিবার্য বাংলাদেশ হয়ে।
– [ নয়ন আহমেদ, কবিতার মতো ]
চলতি সংখ্যা ‘সৃজন’ পত্রিকায় এরকম আরো কিছু ভালো লাগা আকর্ষক পঙক্তি রয়েছে যার বিশদ আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। আসলে কবিতা অনেক রকম, পাঠকও ভিন্ন ভিন্ন রুচির। ফলে নানান দিকে আলো ছড়িয়ে হেসে ওঠে কবিতাসুন্দরী। কবিতাসুন্দরীর এই হাসি কারো ভালো লাগে, কারো ভালো লাগে না। আর এভাবেই তৈরি হয় কবিতার শত্রু-মিত্র। এই নিয়েই কবিতার তাপিত সংসার। তবে অনেকগুলো ভালো লাগা কবিতা এক সঙ্গে পড়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য ‘সৃজন’ কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
সৃজন সাহিত্যগোষ্ঠী কর্তৃক প্রকাশিত এ পত্রিকার শিল্প সম্পাদক শিল্পী দেওয়ান আতিকুর রহমান এবং সম্পাদনা করেছেন শামসুদ্দিন তৌহিদ, আহমেদ বাসার ও জুননু রাইন। পত্রিকাটি কোথা থেকে কখন প্রকাশিত হয়েছে কিংবা এটি কততম সংখ্যা তা কোথাও উল্লেখ নেই। গুরুত্বপূর্ণ এই ত্রুটির বিষয়ে সম্পাদকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। উন্নত মানের কাগজে ঝকঝকে ছাপা ও বাঁধাই করা এ পত্রিকাটির মূল্য রাখা হয়েছে মাত্র ১০০ টাকা। পত্রিকাটি বোদ্ধা পাঠক- সমালোচকদের কাছে সমাদৃত হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।