মো: মাকসুদুর রহমান ।।
দ্বীপ জেলা ভোলার ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান মির্জাকালু সিনিয়র ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ, মাওলানা আব্দুল খালেক ১৯৪৩ সালে ভোলা জেলার তজুমদ্দিন উপজেলাধীন চন্ডীপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জম্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬১ সালে ছারছিনা দারুস্সুন্নাত আলিয়া মাদরাসা থেকে কামিল (এমএ) ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়াও তিনি দাখিল, আলিম ও ফাজিল ( ডিগ্রি) পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ন হন । ১৯৬১ সালের ০১ ফেব্রুয়ারি তিনি মির্জাকালু সিনিয়র ফাজিল মাদরাসায় আরবি প্রভাষক পদে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে ১৯৯১ সালের ০১ জুন একই মাদরাসার উপাধ্যক্ষ পদে এবং ২০০০ সালের ০৮ এপ্রিল অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন।
তিনি ছিলেন সৎ, ধার্মিক এবং মানুষের প্রতি তাঁর ছিল অপরিসীম মমত্ববোধ। গরিব অসহায় ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি সবসময় সাধ্যমত বই-পুস্তক কেনা থেকে শুরু করে সকল ধরনের আর্থিক সহায়তা করতেন। তাঁর হাতে গড়া বহু গরিব ছাত্র যারা আজ স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। এদের মধ্যে অনেককে এরকম বলতে শুনেছি, ‘হুজুরের সাহায্য সহযোগিতা না পেলে আমরা এ পর্যায় কোনদিন আসতে পারতামনা’। তিনি ছিলেন সদা হাস্যোজ্জল, সদালাপী, পরোপোকারী, দ্বীনদার, খোদাভীরু, পরহেজগার এবং আমানতদার একজন আলোকিত মানুষ।
সেসময় ব্যাংক ব্যাবস্থা এতটা সচরাচর ছিলনা। তাঁর কাছে অনেকে টাকা-পয়সা গচ্ছিত রাখতেন। তিনি যথাসময়ে মানুষের কাছে সেসব আমানত ফিরিয়ে দিতেন। তিনি কোনদিন অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে তিনি সবসময়ই নির্দিষ্ট সময়ের আগে কর্মস্থলে পৌছতেন। ঝড়-বৃষ্টির সময়েও তিনি যথাসময়ে মাদরাসায় পৌঁছতেন। এককথায় বলতে গেলে ‘লেট’ বা দেরিতে আসা শব্দটি তাঁর অভিধানে ছিলো না। সময়ের ব্যাপারে তিনি ছিলেন সিরিয়াস এবং সিনসিয়ার।
অধ্যক্ষ থাকাকালিন তিনি তাঁর মাদরাসায় একাধিক শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন এবং যারাই ইন্টারভিউতে প্রথম হয়েছেন, তাদেরকেই তিনি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। তাঁর সময়ে মেধার ভিত্তিতেই তিনি শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা করতেন। যদিও এক্ষেত্রে তিনি মাদরাসা কমিটির পক্ষ থেকে বহু বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। তবুও নীতিতে তিনি ছিলেন সবসময় অটল।
তিনি বাড়ির পাশে একটি মসজিদে প্রায় ত্রিশ বছর জুমআর নামাজ পড়িয়েছেন। কিন্তু কোনদিন সেখান থেকে কোন ধরনের বেতন বা হাদিয়া নেননি। আমরা দেখেছি তিনি মাদরাসার চাকুরিকে ইবাদত হিসেবেই মনে করতেন। তাঁর মৃত্যুর আগের সপ্তাহের একটি ঘটনা যা আমার নিজের চোখে দেখা। ২০০২ সালে মে মাসে মাদরাসায় আলিম পরিক্ষা শুরু হবে, আব্বা খুবই অসুস্থ, মাদরাসার ছাত্র- ছাত্রীরা আব্বার কাছে দোয়া নেয়ার জন্য ফোন করেছে। আমার বড় ভাই আব্বাকে বললেন, মাদরাসায়তো আলিম পরিক্ষা শুরু হবে, আপনার কাছে দোয়া চেয়েছে। একথা শুনে আব্বা গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় পাঞ্জাবি হাতে নিয়ে বললেন, আমি মাদরাসায় যাবো। মাদরাসাই ছিল তাঁর ধ্যান, জ্ঞান ও নেশার মতই। মাদরাসার প্রতি তাঁর ছিল বিশেষ টান।
আমাদের পুরনো বাড়ি (সেই বাড়ি মেঘনা নদীর গর্ভে বিলীন হয়েছে প্রায় ২৫ বছর আগে) থেকে মাদরাসার দুরুত্ব ছিল প্রায় চার কিলোমিটার। তখন সচরাচর যানবাহন পাওয়া যেতনা। রাস্তা-ঘাটও তেমন ভাল ছিলনা। প্রায় সময় তিনি পায়ে হেটেই মাদরাসায় যেতেন। তারপরও সবার আগেই তিনি মাদরাসায় পৌঁছতেন।
ইসলামের মৌলিক বিষয়ে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। একদিন আমি তাঁর মুখে বলতে শুনেছি- জীবনে কোনদিন আমি নামাজ কাজা করিনি। আমরা দেখেছি মাদরাসা থেকে তাঁর আসতে আসতে আসরের আজান হয়ে যেত। অথচ তিনি তখনো দুপুরের খাবার খাননি। তারপরও তিনি জামায়াতে নামাজ আদায় না করে বাসায় যেতেন না।
এই গুণি, ধার্মিক ও পরোপকারি মানুষটি ১ বছর ৬ মাস অধ্যক্ষ থাকা অবস্থায়, ২০০২ সালের ১৭ মে মহান রবের ডাকে সারা দিয়ে পরপারে চলে যান। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী (আমাদের মা) ও ৪ ছেলে ও ৪ মেয়ে রেখে যান। এরমধ্যে আমাদের মেঝো ভাই মির্জাকালু বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারি ধর্মীয় শিক্ষক মাওলানা মো. নেছার উদ্দিন ২০১১ সালে এবং বড় বোন হাছিনা বেগম (জোসনা) ২০১৯ সালে ইন্তেকাল করেন। বর্তমানে আমরা ৩ ভাই ও ৩ বোন এবং আমাদের মা রয়েছেন। বোনরা সবাই বিবাহিত এবং দ্বীনদার হিসেবে জীবন যাপন করছেন। বড় ভাই মাওলানা মোহাম্মদ মহসিন ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার চাঁদপুর মহিলা আলিম মাদরাসার প্রভাষক, সেজো ভাই আযাদ আলাউদ্দীন দৈনিক নয়া দিগন্তের বরিশাল ব্যুরো চিফ হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের পিতা অধ্যক্ষ মাওলানা আবদুল খালেকের সকল ভাল কাজ গুলোকে কবুল করে, তাঁকে যেন জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন। মহান মাবুদের কাছে এটাই প্রার্থনা করছি। রব্বিরহামহুমা কামা রব্বা ইয়ানি ছগিরা। ##
মো: মাকসুদুর রহমান
অধ্যক্ষ মাওলানা আবদুল খালেকের ছোট ছেলে।
বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক ভোলা শাখায় কর্মরত।
আল্লাহ আপনার আব্বাকে জান্নাতের সু উচ্চ মাকাম দান করুন,আমিন।