চিত্রশিল্পী, ভাস্কর ও মুক্তিযোদ্ধা চিত্ত হালদার স্মারকগ্রন্থ

বেগম ফয়জুন নাহার শেলী

ছোটবেলা। হ্যাঁ- ষাটের দশকের প্রথমার্ধে আমি ছিলাম বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের (সদর গার্লস্ স্কুল) ছাত্রী। মা ছিলেন ওই বিদ্যালয়েরই শিক্ষক। বাসা শহরের ব্রাউন কম্পাউন্ড। বর্তমান ব্রাউন কম্পাউন্ড মসজিদের সামনে দিয়ে খ্রীস্টান গোরস্থান (সাহেবের গোরস্থান) দিকে যাবার পথে যে ত্রিমুখী রাস্তাটা সেখানে একটা ব্রিজ ছিল। এখনও আছে কিন্তু বোঝা যায় না। সেখান থেকে রিক্সা ভাড়া করে ব্রাউন কম্পাউন্ডে নিজেদের বাসায় গিয়ে মাকে নিয়ে স্কুলে যেতাম।
এ ভূমিকার কারণ, ব্রিজটির আগে যেখানে দাঁড়িয়ে রিক্সা ভাড়া করতাম সেই রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট খালটির পাড়ে খ্রীস্টান গোরস্থান লাগোয়া দু’টি ঘর ছিল। আমার শিশু চোখ দু’টো আটকে যেত তার একটি ঘরের দেয়ালে যেখানে পাকিস্তানী নায়িকার (পরে জেনেছি ওই ছবিটি নিলুর) একটি সুন্দর তৈল চিত্র ছিল। আমরা অনেকেই জানতাম ওই ছবিটি যিনি এঁকেছেন তিনি চিত্ত দা, স্থানীয় জগদীশ (কাকলী) সিনেমা হলের দেয়ালে চলমান ছায়াছবির পোস্টার আঁকতেন। ব্যাস ঐটুকুই। এরপর তাঁকে জানার আর সুযোগ হয়নি। কারণ ১৯৬৫-তে আব্বা বরিশাল জিলা স্কুল থেকে ঝালকাঠী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে বদলী হলে ১৯৬৬ তে আমরা তার কাছে চলে যাই, আর ফিরে আসি ১৯৭০ এর প্রথম দিকে। কারণ একটাই, বরিশাল জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে আব্বার বদলী।
তারপর সুদীর্ঘ ৫৪ বছর পরে ‘চিত্রশিল্পী’ ভাস্কর ও মুক্তিযোদ্ধা চিত্ত হালদার স্মারক গ্রন্থটি হাতে পেয়ে ফিরে যাই সেই অতীতে আর গোগ্রাসে পড়ে ফেললাম বইটা। অবাক হয়ে ভাবলাম এতগুণি মানুষটি এত কাছে ছিল, অথচ আমরা চিনতাম না!
নিভৃতচারী এই মানুষটিকে নিয়ে প্রকাশিত স্মারক-গ্রন্থটি আলোচনার বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে ১২টি অংশে ভাগ করা হয়েছে। যথা : সম্পাদকের ভূমিকা, জীবনীপঞ্জি, স্মৃতিচারণ, সাক্ষাৎকার, পরিবারের লেখা, প্রতিবেদন, গদ্য, পত্রিকার পাতা থেকে, খেরোখাতা ও চিঠিপত্র, বংশলতিকা, যাদের কাছে ঋণ ও চিত্রালি।
সম্পাদকীয় ও জীবনপঞ্জির পর স্মৃতিচারণ প্রসঙ্গ। এ পর্বে ১৩টি স্মৃতিচারণ স্থান পেয়েছে। প্রথমটি প্রখ্যাত চিত্র শিল্পী ও শিল্প সমালোচক ড. কাজী মোজাম্মোল হোসেনের। উনিও আমারই মতো পঞ্চাশ দশকে ছাত্র জীবনে স্কুলে যাবার পথে চিত্ত হালদারকে জগদীশ সিনেমার ব্যানার আঁকতে দেখেছেন। ১৯৬০ সালে ঢাকা চারুকলা ইনস্টিটিউটে ভর্তির পর তাঁর সাথে ওনার আর দেখা হয় নি। তবে উনি অকুন্ঠচিত্তে স্বীকার করেছেন ‘ছেলেবেলায় বরিশালে যাদের শিল্পকর্ম দেখে অনুপ্রণিত হয়েছিলাম তাদের মধ্যে একজন ছিলেন চিত্ত হালদার।’ ২১ পৃষ্ঠাব্যাপী এ লেখায় তিনি এই শিল্পীর রেখে যাওয়া কর্মদক্ষতা ও শিল্পী-পত্নীর কাছ থেকে জেনে নেয়া কিছু তথ্য উপাত্ত উত্থাপন করেছেন।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় লেখাটি শিল্পীর সহপাঠী, বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী রেভাঃ বীরবল হালদার ও নিকোলাস শৈলেন অধিকারীর। পাঠক এদের উভয়ের লেখায় চিত্ত হালদারের জীবন স্মৃতির পাশাপশি সে সময়কার স্কুল জীবন ও বরিশাল শহরের কিছু চিত্র বাড়তি পাওনা হিসাবে পেয়েছেন। যা এখন বিরল।
পরবর্তী লেখাটি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ঢাকার পরিচালক (১৯৭৩-১৯৮৩) এবং মহাপরিচালক (১৯৮৩-১৯৯২) ড. এনামুল হকের। এ লেখায় তিনি চিত্ত হালদারের সাথে পরিচয়, শিল্পীর ‘মা ও শিশু’ ভাস্কর্যের রেপ্লিকা এবং লেখকের সময়ের জাতীয় জাদুঘরের সামান্য পরিচয় তুলে ধরেছেন।
এরপরের লেখকরা হলেন ’৭১’এর মুক্তিযুদ্ধের সহযোদ্ধা হেলাল উদ্দিন ও কবি সৈয়দ ওয়াদুজ্জামান, গণসংগীত শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মুকুল দাস, চিত্রশিল্পী ও চিত্রপূরী বরিশালের প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ চন্দ্র দাস, ব্যবসায়ী মোঃ নাসির খান, আইনজীবী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এস, এম, ইকবাল (অনুলেখন : সুশান্ত ঘোষ), প্রতিবেশী মনিক চক্রবর্তী, বরিশাল প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি (প্রাক্তন) মাহমুদ হোসেন চৌধুরী এবং বাঁকাল আগৈলঝাড়া, বরিশালের ব্যবসায়ী, সমাজসেবক রোনাল্ড রমেশ মালাকার।
এরা প্রত্যেকেই যে যার পরিমন্ডলে শিল্পীকে যেভাবে দেখেছেন তার সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরেছেন। তবে রোনাল্ড রমেশ মালাকারের মিষ্টি মধুর স্মৃতি থেকে বেড়িয়ে এল যে তথ্য তা হল, ১৯৫০ সালে হিন্দীভাষার চলচ্চিত্র ‘রাজমুকুট’ এর মাধ্যমে জগদীশ থিয়েটারের ব্যানারে প্রথম ছবি আঁকা শুরু করেন চিত্ত হালদার।
এরপরের পর্ব সাক্ষাৎকার। সহধর্মিণী ঝর্ণা হালদারের এ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন তুহিন দাস। দীর্ঘ ৮৮ পৃষ্ঠা জুড়ে দেয়া এ সাক্ষাৎকারে সহধর্মিণিী ঝর্ণা হালদার তার নিজের জীবন থেকে শুরু করে চিত্ত হালদারের সাথে বিবাহ, তার কর্মময় ও পারিবারিক জীবন সংগ্রাম এবং স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানদের নিয়ে তার কঠোর সংগ্রামী জীবনের চিত্র তুলে ধরে আক্ষেপ করে বলেছেন : ‘এখন আর কী চাইব? কী চাওয়ার আছে? আমার প্রয়াত স্বামী চিত্ত হালদারকে যোগ্য সম্মানটুকু দেওয়া হোক’। তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাহিত করা হয় নি। তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হোক, এ দাবী আমি রাষ্ট্রের কাছে জানাই, সব মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীরাও যাতে রাষ্ট্রীয় সম্মান পান সে ব্যবস্থা সরকারিভাবে গ্রহণ করা হোক। আমার মৃত্যুর পরে যেন আমাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।”
শিল্পী-পত্নীর এ আক্ষেপ শুনে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘নারী’ কবিতার ক’টি চরণ মনে পড়ে গেল:
জগতের যত বড় বড় জয়, বড় বড় অভিযান,
মাতা ভগ্নী ও বধুদের ত্যাগে হইয়াছে মহিয়ান।
কোন্ রণে কত খুন দিল নর লেখা আছে ইতিহাসে
কত নারী দিল সিথির সিঁদুর লেখা নাই তার পাশে।
সাক্ষাৎকারের এ পাতায় রয়েছে শিল্পীর ভালোবাসা ঝর্ণা হালদারের দু’টি তৈল চিত্র। তার মধ্যে একটি বধূবেশে ঝর্ণা হালদার, বাংলা ছায়াছবি ‘পীচ ঢালা পথ’ এর নায়ক-নায়িকা রাজ্জাক-ববিতার একটি পোস্টার এবং চিত্ত হালদারের ছাঁচে ঝর্ণা হালদারের প্রস্তুত করা একটি শিল্পকর্ম। এ ছবিটি গ্রন্থটিতে আরো দু’জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে ক্যাপসন ছাড়া একটি ভাস্কর্যের ছবি।
পরবর্তী পর্ব হচ্ছে পরিবারের সদস্যদের কথা। এ পর্বে লিখেছেন চারজন। শ্যালিকা ইন্দিরা হালদার আর তিন মেয়ে জুলিয়েট, ভায়লেট ও ব্রিজেট হালদার। বড় মেয়ে জুলিয়েটের নামকরণ করেছিলেন বরিশালের একজন প্রিয় মুখ যোসেফ সরকার। জুলিয়েট শব্দের অর্থ সম্পদ।
এর ১২ বছর পর বগুড়া রোডের অক্সফোর্ড মিশন হাসপাতাল (ডগলাস বের্ডিং)-এ দ্বিতীয় মেয়ে ভায়লেটের জন্ম। ভায়লেটের নামকরণ প্রসঙ্গে মা ঝর্ণা হালদার বলেছেন :’আমি ওখানকার নার্সদের সঙ্গে গল্পচ্ছলে মুখ ফসকে বলেছিলাম, ‘বার বছর পরে মেয়ে হল তাও আবার কালো।’ কথাটা ডাঃ লিউনা আমি যার তত্ত্বাবধানে ছিলাম তাঁর কানে পৌঁছালো। পরদিন সকালে তিনি আমাকে দেখতে এলেন, তাঁর হাতে গাঢ় বেগুনী রঙের একটি ছোট্ট ফুল। সে ফুল আমার হাতে দিয়ে শুভেচ্ছা জানালেন। আমি বললাম, ‘ছোট্ট ফুলের রং খুব গাঢ়।’ তখন ডাঃ লিউনা বললেন, ‘ডিয়ার, ফুলের রঙটা কেন দেখো ! এর সুবাস কত মিষ্টি! এ ফুলের নাম ভায়লেট।’ তখন এ ফুলের নামানুসারে ডাক্তার লিউনা আমার সন্তানের নাম ভায়লেট রাখলেন।
আর ছোট মেয়ের নাম রাখলেন স্বয়ং বাবা চিত্ত হালদার। আইরিশ লোককথায় ব্রিজেট নামে একজন সাধ্বী যাকে Saint Brigid of kildara বা  Brigid of Ireland. বলা হত তার নামানুসারে বাবা ছোট মেয়ের নাম রাখলেন ব্রিজেট অর্থ শক্তিশালী।
মা ঝর্ণা হালদারের দেয়া সাক্ষাৎকার থেকে নেয়া তার মেয়েদের নামকরণের উল্লেখ এ কারণেই করা হল, তার কন্যাসন্তানরা পুত্রসন্তানদের চেয়ে বড় দায়িত্ব পালন করেছেন। (যদিও তার কোন পুত্র ছিল না) বিস্মৃত প্রায় বাবার কর্ম, বাবার জীবন ইতিহাসকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে তারা তাঁকে অমর করার চেষ্টায় ব্রতী হয়েছেন। এদের লেখাগুলো যতটা প্রাঞ্জল, ততটা অনুপ্রেরণার উৎস। দেশের পাশাপাশি পারিবারিক জীবনে সন্তান-স্বামী-বাবা হিসাবে তাঁর দায়িত্ব পালন বর্তমান সমাজে বিরল।
পরিবারের লেখার পরের লেখাটি মুক্তিযুদ্ধ-গবেষক ও সাংবাদিক, ডেইলি স্টারের বরিশাল প্রতিনিধি সুশান্ত ঘোষের। তিনি তার প্রতিবেদনে বরিশালের দ্বিতীয় শহীদ মিনারটির নক্সাকার হিসেবে চিত্ত হালদারের নাম উল্লেখ করেছেন। এটি সরস্বতী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিপরীতে অবস্থিত। সাংবাদিক ও উদয়ন ক্লাবের তৎকালীন সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাতের উদ্যোগে রানী ভট্টাচার্য, বদিউর রহমান, মানবেন্দ্র বটব্যাল, কবি মাসুদ আহম্মেদ, নওশের প্রমুখের সহযোগিতায় গণ-চাঁদায় এই ব্যতিক্রমী শহীদ মিনারটি নির্মিত হয়। ব্যতিক্রম এ কারণে এ শহীদ মিনারটির নক্সা দেশের আর দশটা শহীদ মিনারের মত নয়।
এরপরে গদ্য অংশে যে ক’টি লেখা স্থান পেয়েছ সেগুলো হল, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক, একাত্তর টিভি’র বরিশাল প্রতিনিধি বিধান সরকারের লেখা ’বৈষম্য রোধে একদা সৃষ্টি ছেড়ে ধ্বংসে’। কবি ও চিত্রশিল্পী রিঙকু অনিমেখের ’ভাস্কর- চিত্ত হালদারের গুপ্তধন’। বরিশালের কবি ও সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক তুহিন দাসের ‘ট্রাংকের ঢাকনা খুলে জীবনানন্দের মতো’।
এরপরে যে বিষয়গুলো এ স্মারকগ্রন্থে স্থান পেয়েছে তা হল, মৃত্যুর পরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্রিকায় শিল্পীর উপর প্রকাশিত প্রতিবেদন। প্রথমেই দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত বরিশাল প্রেসক্লাবের সভাপতি মানবেন্দ্র্র বটব্যালের লেখা ‘খ্যাতিহীন-বিত্তহীন শিল্পী চিত্ত হালদার।’ এরপর বরিশালের দৈনিক বিপ্লবী বাংলাদেশে প্রকাশিত লেখক ও গবেষক, বরিশাল রিপোটার্স ইউনিটির প্রাক্তন সভাপতি আনিসুর রহমান স্বপনের লেখা ’তিনি ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা, তিনি ছিলেন একজন ভাস্কর্য শিল্পী’। পত্রিকাটিতে চিত্ত হালদার প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে লেখক আক্ষেপ করে লিখেছেন ’সুখপাখি ধরতে চাইলে তিনি ধরতে পারতেন, কিন্তু তিনি প্রতিষ্ঠা চাননি। তাই তার জীবনের সঞ্চয় শূণ্যতায় পর্যবসিত। নীরবে জীবনের জয়গান গেয়ে নীরবেই চলে গেছেন চিত্ত হালদার। সৃষ্টি ছাড়া কিছুই রেখে যান নি। তাই তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানটিও সম্পন্ন হয়েছে অন্যের সাহায্য আর সহানুভূতিতে। —- তবে হারিয়ে যায় নি তার কীর্তি। যে কীর্তি নিয়ে তার পরিবার পরিজনেরা আজ দিশেহারা। দিশেহারা মানুষগুলোর কে ধরবে হাল? ঢাকা জাদুঘর, শিল্পকলা একাডেমী, সরকার, শিল্পী সমাজ? দায়িত্বতো সবার। সে দায়িত্ব পালন করা আজকে প্রয়োজন। যে মানুষটি জীবনে স্বীকৃতি পান নি, তাঁর পরিবারকে অন্ততপক্ষে সে শান্তিটুকু দিতে যেন আমরা ব্যর্থ না হই।’ ১৯৭৮ এর ২৩ জুলাইতে লেখা সাংবাদিকের এ আক্ষেপ আজও আক্ষেপই রয়ে গেল।
একই ব্যর্থতার দায় নিয়ে ১৯৮১র ২৩ ডিসেম্বর বরিশালের সাংবাদিক ও সাহিত্যিক মিন্টু বসু (বর্তমানে প্রয়াত) বরিশালের দৈনিক বিপ্লবী বাংলাদেশ পত্রিকায় ‘ঝর্ণা হালদার শিল্পী নন, স্বামীর স্মৃতি রক্ষা করতে শিল্পী হয়েছেন’ শিরোনামে লেখা সংবাদে আক্ষেপ করে লিখেছেন ’স্থানীয় খ্রীষ্টান গোরস্থানের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে গোরস্থানের পাশে স্বল্প পরিসরে একটি খুপরীর মধ্যে আশ্রয় জুটেছে তার’।
এ ধরনের আক্ষেপ এসেছে বরিশালের দৈনিক আজকের বার্তায় ৫ এপ্রিল ১৯৯৭-এ সাংবাদিক ও গবেষক এস এম তুষারের “চিত্ত হালদারের সৃষ্টি কর্ম যোগ্য স্বীকৃতির অপেক্ষায়’ শিরোনামে লেখায়।
এরপরের প্রসঙ্গ খেরোখাতা ও চিঠিপত্র। এতে এসেছে বাংলাদেশের প্রখ্যাত পটুয়া কামরুল হাসানের খেরোখাতায় স্থান পাওয়া শিল্পী চিত্ত হালদার (যাকে তিনি পাগলা বলে সম্বোধন করতেন) প্রসঙ্গ, শিল্পী চিত্ত হালদারের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী ঝর্ণা হালদারকে লেখা পটুয়া কামরুল হাসানের দু’টি চিঠি এবং ১৪-০৪-১৯৭৮ তারিখে ঝর্ণা হালদারকে লেখা চিত্ত হালদারের চিঠি।
পরবর্তী প্রসঙ্গ চিত্ত হালদারের বংশলতিকা ও তার বিস্তারিত তথ্য। এরপর ঋণ স্বীকার প্রসঙ্গ। বিষয়টি সম্পাদকের ভূমিকায় এলে ভাল হত।
সবশেষে চিত্রালি। এখানে স্থান পেয়েছে সম্পাদকের নোটখাতা থেকে উদ্ধৃত করা চিত্ত হালদারের রেখে যাওয়া আর কিছু হারিয়ে যাওয়া শিল্পকর্মের পরিচয় এবং ৩৬টি ছবি। এরমধ্যে রয়েছে : তেল রং-এর আঁকা ৬টি ছবি, প্লাসটার অফ প্যারিসের ভাস্কর্য-২৫টি, শ্বেত পাথরের ভাস্কর্য ১টি, বাঁশের কাজে দু’মুখোশো পিছ ১টি ও তিনটি বাঁশের চুরির নক্সা করা ছবি, কাজী নজরুল ইসলামের উপর আঁকা পেন্সিল স্কেচ এবং অরূপ তালুকদারের উপন্যাস ’আশার নাম মৃগতৃষ্ণিকা’র প্রচ্ছদ। আরো রয়েছে চিত্ত হালদারের নির্মিত শহীদ মিনারসহ চিত্ত হালদারের উপর সাক্ষাৎকার, তাঁর পরিবার ও চিত্ত হালদার স্মৃতি পুরস্কারের ৭টি আলোকচিত্র। ছবিগুলো চিত্ত হালদারের জীবন, কর্ম এবং সৃষ্টিশীলতাকে পাঠকের কাছে আরো পরিস্ফুট করে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
চিত্রশিল্পী, ভাস্কর ও মুক্তিযোদ্ধা চিত্ত হালদার স্মারক গ্রন্থটির এই সামগ্রিক আলোচনা শেষে বলতে হয়- এটি একটি অনবদ্য গ্রন্থ যাতে সমালোচনার অবকাশ কম। বইটির প্রচ্ছদ বিষয়বস্তুর গাম্ভীর্য বহন করে। মুদ্রণ, অঙ্গসজ্জা এবং কাগজের মান প্রশংসার দাবী রাখে। বানান-বিভ্রাট নগণ্য হলেও ’স্বারস্বত’ (সরস্বতী) বানান বিভ্রাটটি চোখে খুব পীড়া দেয়।
গ্রন্থটি মূলতঃ স্মৃতিচারণ ভিত্তিক হওয়ায়, প্রায় অর্ধশতাব্দী আগের ঘটনা বর্ণনায় কিছুটা স্মৃতিবিভ্রাট, প্রক্ষেপন, অতিরঞ্জন এবং আত্মপ্রচারের প্রবণতা রয়েছে কারো কারো লেখায়।
পরিশেষে বলতে হয়, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ তূর্য’ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই চরণটির মূর্তরূপ চিত্ত হালদার। ভাস্কর্য গড়া, ছবি আঁকার পাশাপাশি এ যন্ত্রসংগীত শিল্পী দেশের প্রয়োজনে ঝাঁপিয়ে পরেছেন রণক্ষেত্রে, তৈরী করেছেন হাত বোমা, মলটোভ ককটেলসহ বিভিন্ন ধরণের বিষ্ফোরক।
১৯৩৬-১৯৭৮ মাত্র ৪২ বছরের জীবনে চিত্ত হালদার বাঙালিকে যা দিয়ে গেছেন তার বিনিময়ে আমরা কিছুই দেইনি। শত অভাব অনটনের মধ্যেও মাথা উঁচু করে চলা এ মানুষটিকে আজও আমরা যাথাযথ সম্মান দিতে পারি নি। তাই তাঁর সুযোগ্য কন্যাদের প্রচেষ্টায় বের হওয়া এ স্মারকগ্রন্থটিকে আমরা সশ্রদ্ধ স্বাগত জানাই। আর স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর আজও আমরা আশা রাখি এ নিভৃতচারী প্রচার বিমুখ মুক্তিযোদ্ধাকে সরকার যথাযথ সম্মান দেবেন।

চিত্রশিল্পী, ভাস্কর ও মুক্তিযোদ্ধা চিত্ত হালদার স্মারকগ্রন্থ
সম্পাদনা : ভায়লেট হালদার, প্রকাশক : মারমেইড প্রকাশনা-১৩, প্রথম প্রকাশ : বইমেলা, ফেব্রুয়ারি-২০২০
পৃষ্ঠা : ৩০৪, মূল্য : ৮০০ টাকা।

রিভিউ লেখক: বেগম ফয়জুন নাহার শেলী, প্রাক্তন বাংলা প্রভাষক, বরিশাল ইসলামিয়া কলেজ।

২ comments

  1. বইটি দেখিনি|পড়ারতো প্রশ্নই ওঠেনা|অধ্যাপিকা শেলীর লেখা স্মারকগ্রন্থটির রিভিও বহুলাংশেই তা মিটিয়েছে|মুক্তিযুদ্ধের একজন অকুতোভয় যোদ্ধার স্মৃতিচারণের এই স্মৃতি আমার দেখা, জানার সাথে মিলেমিশেএকাকার হয়েছে|আমি তৃপ্ত, প্রকৃতঅর্থেই আমি মুগ্ধ |এই বিশাল স্মৃতির ক্যানভাস গড়ার জন্যে যাদের প্রেম, শ্রম, নিষ্ঠা,অর্থ আর বিনম্র শ্রদ্ধা ব্যয়িত হয়েছে অপার, তাদের প্রতি ভক্তি,শ্রদ্ধা, শুভেচ্ছাঅশেষ|

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *