শফিকুল ইসলাম
বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে কিভাবে মেইনস্ট্রিমে নিয়ে আসা যায়, কিভাবে তাদের অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্র ভূমিকা পালন করতে পারে সেসব নিয়ে বিভিন্ন সময়ে গবেষণা হয়েছে। কিন্তু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রাখাইনরা যে রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার জন্য পিছিয়ে আছেন সেসব নিয়ে কোন গবেষণা হয়নি। দেশে এই কাজটিই প্রথম করেছেন তরুণ গবেষক ও লেখক বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মোঃ আল-আমিন।
তার ‘রাখাইন সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ’ বইটিতে উঠে এসেছে রাখাইনদের বাংলাদেশের রাজনীতি, সরকারব্যবস্থা, রাজনৈতিক অধিকার এবং সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে যে জ্ঞান, ধারনা রয়েছে তা বাঙালি সম্প্রদায়ের তুলনায় নিম্নমুখি । আবার রাজনৈতিক সামাজিকীকরণে যে মাধ্যমসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা বাঙালিদের মত নয়। ফলে অধিকার বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।
বইটি সম্পর্কে লেখক মোঃ আল-আমিন বলেন, পৃথিবীর সব সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক সামাজিকীকরণে পরিবার, সঙ্গী, ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যমসহ অন্যান্য মাধ্যমে কাজ করলেও রাখাইনদের ক্ষেত্রে ভিন্ন। বাঙালিদের বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে যেরকম ধারনা রয়েছে রাখাইনদের তা একেবারে নেই বললেই চলে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল তাদের রাজনৈতিক সামাজিকীকরণে সাব-কালচার ( উত্তরাধিকারসূত্রে ধ্যান ধারণা) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেটা বাঙালিদের ক্ষেত্রে কম। রাজনৈতিক সামাজিকীকরণে রাখাইনদের যে শূণ্যতা রয়েছে সে শূন্যতা পূরণ করতে পারে রাজনৈতিক দল।
আবার শুধু যে বিভিন্ন মাধ্যম এই রাজনৈতিক সামাজিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে তা নয়। রাখাইনদের মূখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদেরও অনেক দুর্বলতা রয়েছে। তারা নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে চায়। এটা করলে তারা রাজনৈতিকভাবে অ্যাফিলিয়েটেড হতে পারছে না। এই বিষয়টা যতদিন থাকবে ততদিন রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়বে। রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানেই হচ্ছে অধিকার থেকে পিছিয়ে পড়া। এটা তাদের একটি ক্ষয়িষ্ণু জাতিতে পরিণত করবে।
বইয়ের সারসংক্ষেপঃ
রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ এমন একটি শিক্ষণ প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংস্কৃতি ব্যক্তি স্তরে এবং সম্প্রদায় স্তরে আকৃতি লাভ করে। এর মাধ্যমেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে প্রেরণ করা হয়।
রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তি রাজনৈতিক ইতিহাস-ঐতিহ্য, সরকারব্যবস্থা, রাজনৈতিক অধিকার এবং চলমান রাজনৈতিক ধারা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে । রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া কতগুলাে মাধ্যমকে বিজড়িত করে যার মধ্যে পরিবার, সঙ্গী দল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল এবং গণমাধ্যম অন্যতম।
বর্তমান গ্রন্থে রাখাইন সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক সামাজিকীকরণে এসব মাধ্যমের ভূমিকা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। রাখাইন সম্প্রদায় সংখ্যালঘু এবং অগ্রসর। অনগ্রসর জাতি হিসেবে রাখাইন সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের মাধ্যমগুলাের ভূমিকা কিরূপ তা জানা আবশ্যক। আর এ লক্ষ্যে পটুয়াখালীর রাখাইন সম্প্রদায়ের উপর গবেষণা পরিচালিত করে বাংলাদেশের রাখাইন সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
গবেষণায় রাখাইন সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক বিষয়ে জ্ঞান এবং এই জ্ঞান অর্জনে মাধ্যমগুলো কতটুকু ভূমিকা পালন করছে তা জানার জন্য রাখাইন সম্প্রদায়ের কাছ থেকে সাক্ষাৎকার পদ্ধতির (Interview Method) মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে গবেষণার বিষয়বস্তু, উদ্দেশ্য, গবেষণা পদ্ধতি এবং রাখাইন সম্প্রদায়ের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের একটি তাত্ত্বিক আলােচনা করা হয়েছে।
পরবর্তী অধ্যায়গুলােতে প্রাপ্ত তথ্যের আলােকে রাখাইন সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক বিষয়ে জ্ঞান এবং এই জ্ঞান
অর্জনে মাধ্যমগুলাের ভূমিকা বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য বিচার- বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখা গেছে বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সরকারব্যবস্থা, রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে অধিকাংশরই জ্ঞান সীমিত। তবে স্থানীয় এবং জাতীয় নির্বাচন, বর্তমান ক্ষমতাসীন দল, রামুর বৌদ্ধ বিহারে হামলা সম্পর্কে অধিকাংশরই জ্ঞান রয়েছে। জ্ঞানের উৎস পর্যালােচনা করলে দেখা যায়, পরিবার রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের প্রাথমিক মাধ্যম হলেও বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক বিষয়ে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে না। আবার সঙ্গীদলের ক্ষেত্রেও একই চিত্র লক্ষ করা যায়। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক দলও তেমন কার্যকর ভূমিকা পালন করে না। তবে বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সরকারব্যবস্থা, রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যম তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সর্বশেষে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে সার্বিক বিবেচনায় বলা যায় যে, বাংলাদেশের অন্যান্য নৃগােষ্ঠীর মতাে রাখাইন সম্প্রদায়েরও রাজনৈতিক বিষয়ে জ্ঞানের মাত্রা স্বল্প। রাজনৈতিক বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে সবগুলাে মাধ্যমের ভূমিকা থাকলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং এক্ষেত্রে জনসংখ্যাতাত্ত্বিক (Demographic) চলকের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
‘রাখাইন সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ’ বইটি প্রকাশ করেছে মেরিট ফেয়ার প্রকাশন। প্রচ্ছদ করেছেন আককাস খান। বইটি পাওয়া যাচ্ছে মেরিট ফেয়ার প্রকাশন, ১২ বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০ এবং রকমারি অনলাইন শপে। বিনিময় মূল্য ধরা হয়েছে ৪০০ টাকা।
লেখক পরিচিতি
মােঃ আল-আমিন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগ থেকে কৃতিত্বের সাথে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ২০১৫ সালে প্রভাষক হিসেবে যােগদান করেন। বর্তমানে তিনি একই বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে কর্মরত রয়েছেন।
তাঁর গবেষণার বিষয় Political Violence, Religious Extremism and Political Conflict, Religion and Corruption, Race and Ethnic Politics, Religion and Politics, Political Sociology।
এ বিষয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক জার্নালে তাঁর প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধ রয়েছে। তার বর্তমান গবেষণা প্রকল্পগুলাের মধ্যে “Constructing the Others of Ethnic Communities by the Dominant Community in Bangladesh: How Do They Do It?,” “Examining Religious Extremism and Political Violence of Hefazat-e-Islam Bangladesh,” “Religious Extremism and Political Violence in Myanmar: An Understanding from Rohingya Crisis” অন্যতম।