৩০ বছর যিনি জঙ্গলে একা কাটিয়েছেন

বিশ্বের অন্যতম আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন দেশগুলোর মধ্যে সিঙ্গাপুর অন্যতম। আকাশচুম্বী ভবন থেকে শুরু করে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে পুরো নগররাষ্ট্রেই রয়েছে চাকচিক্য। এমন একটি রাষ্ট্রে মানুষের চোখের আড়ালে কেউ যে ৩০ বছর অরণ্যে কাটিয়ে দিতে পারে, তা শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হবে।

কিন্তু ওহ গো সেং সেই অবিশ্বাস্য কাজটিই করেছেন। সেংয়ের জঙ্গলে থাকার গল্পটি ভাইরাল হয়। সেই গল্প শুনে সারাবিশ্বজুড়েই মানুষ বিস্ময় প্রকাশ করেছে। সিঙ্গাপুরের জঙ্গলগুলোই ছিল সেংয়ের অস্থায়ী বাসস্থান। ৭৯ বছর বয়সী ওহ গো সেংকে তার অর্ধেক বয়সীদের মতোই তরুণ মনে হবে। এই বয়সেও তিনি যথেষ্ট শক্ত-সামর্থ্য। দীর্ঘ ৩০ বছর একাকী জঙ্গলে কাটিয়ে দিয়ে কীভাবে তিনি কারও নজরে এলেন না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

বড়দিন থেকে ঘটনার শুরু

গল্পের শুরু গত বছরের বড়দিনে। লাইসেন্স ছাড়াই সেং রাস্তায় ব্যবসা করছিলেন বলে খোঁজ পায় কর্মকর্তারা। ওহ সেং নিজের চাষ করা শাকপাতা ও মরিচ বিক্রি করছিলেন। তার ধারণা ক্ষুদ্ধ এক ক্রেতাই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে। পণ্যের জন্য তিনি ক্রেতার কাছে সিঙ্গাপুরিয়ান এক ডলার চাইলেও তা নিয়ে দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।

তদারকের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা যখন তাকে জেরা করছিলেন, সেই সময় সমাজসেবা কর্মী ভিভিয়ান পান পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি দেখেন বড়দিনের দিন সেংয়ের শাকসবজিগুলো বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

দৃশ্যটি দেখে ভিভিয়ান হঠাৎ করেই রেগে যান। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমি চাইনি লোকটি এরকম একটি দিনে খালি হাতে ঘরে ফিরুক। তবে আইন অমান্য করে রাস্তার পাশে বিক্রি করা ঠিক না এটাও বুঝি।” ভিভিয়ান পুরো ঘটনা ভিডিও করে ফেসবুকে শেয়ার করেন। মুহূর্তেই ভাইরাল হয় সেই ভিডিও। পুরো বিষয়টি স্থানীয় এক সংসদ সদস্যেরও নজরে আসে। কিন্তু ওহ সেংয়ের আসল কাহিনী তখনো সবার অজানা। সবার চোখের আড়ালে গত ৩০ বছর ধরে জঙ্গলে বাস করছেন সেং।

জঙ্গলে বসবাস

সুনগেই তেনগাহ গ্রামে বড় হন সেং। ১৯৮০ সালে বেশকিছু গ্রাম উচ্ছেদ করে সড়ক ও বহুতল ভবন নির্মিত হয়। অধিকাংশ গ্রামবাসীকেই সরকার নতুন ঘর প্রদান করে। সেংয়ের ভাই সরকারের কাছ থেকে ফ্ল্যাট পেলেও সেং কোনো ঘর পাননি। ভাইয়ের সঙ্গে থাকার জন্য আমন্ত্রণ পেলেও সেং তাদের ওপর বাড়তি বোঝা হয়ে থাকতে চাননি।

আর তাই তিনি নিজের পুরোনো বাড়ির কাছাকাছি জঙ্গলে চলে যান। সেখানে কাঠ, বাঁশ আর তারপুলিন দিয়ে অস্থায়ী ঘর বানিয়ে বাস করতে শুরু করেন।

সেংয়ের জঙ্গলের ঘরে গিয়ে দেখা যায় দরজার কাছে মাটিতে ছাই পড়ে আছে। এখানেই খোলা চুলায় তিনি রান্না করতেন। তার জিনিসপত্র সব ঘরের মাঝখানে রাখা। তাঁবু আকারের ঘরটির পেছনের অংশে তিনি ঘুমাতেন।

ছবি: সংগৃহীত

ঘরের কাছেই একটি বাগান বানিয়ে নিজের জন্য চাষ করতেন সেং। সবজিগুলো অনুপ্রবেশকারীদের হাত থেকে নিরাপদে রাখতে গাছের ফাঁকে ফাঁকে দিয়েছিলেন বেড়া।

সেংয়ের ঘরের ওপর থাকা বৃহদাকার একটি কাঁঠাল গাছ থেকে পর্যাপ্ত ছায়া পাওয়া যেত। আর তাই সিঙ্গাপুরের স্যাঁতসেঁতে গরম আবহাওয়াতেও তিনি স্বচ্ছন্দে দিন কাটাচ্ছিলেন। একাকীত্বও কখনো তার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বাগান নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত থাকতেন। তবে চাষাবাদ ভালো হচ্ছিল বলেই এসব সম্ভব হয়েছিল বলেও উল্লেখ করেন তিনি। জঙ্গলে থাকার সবচেয়ে খারাপ দিক ইঁদুরের যন্ত্রণা বলে মনে করেন সেং। ইঁদুরগুলো কোনো না কোনোভাবে ঘরে ঢুকে কাপড় কাটত।

ছোটখাটো চাকরি পেলে সেগুলোও করতেন। যে টাকা উপার্জন করতেন তা দিয়ে ফেরি করে যেতেন পার্শ্ববর্তী ইন্দোনেশিয়ার ছোট দ্বীপ বাতামে। সেখানেই সেংয়ের সঙ্গে মাদাম তাচিহের পরিচয় হয়। তাদের দুজনের একটি মেয়েও আছে।

বাতামে সপ্তাহান্তে গিয়ে থেকে এলেও সেং ঠিকই সিঙ্গাপুরে জঙ্গলে নিজের ঘরে ফিরতেন। সেংয়ের স্ত্রী এবং ১৭ বছর বয়সী মেয়েও জানায়, তিনি কোথায় থাকেন তা তারা জানেন না।

কোথায় থাকেন তা জিজ্ঞেস করলে সেং এক বাগানে থাকার কথা বলতেন বলে জানায় তাদের এক আত্মীয়।

কিন্তু মহামারি আঘাত হানার পরই সেংয়ের বাতামে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। সীমান্ত বন্ধ করে দিয়ে শুধুমাত্র কোয়ারেন্টাইন ও কোভিড টেস্টের জন্য যারা টাকা দিবে তাদের ভ্রমণের অনুমতি দেয় সিঙ্গাপুর সরকার। কিন্তু তা সত্ত্বেও পরিবারের কাছে মাসে ৫০০ থেকে ৬০০ সিঙ্গাপুরিয়ান ডলার পাঠাতেন তিনি।

সিঙ্গাপুরে গৃহহীন মানুষ প্রায় নেই বললেই চলে। পৃথিবীর অন্যতম ধনী জনগোষ্ঠীর বাস সিঙ্গাপুরে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী, নগর-রাষ্ট্রটির মাথাপিছু জিডিপি প্রায় ৬০ হাজার মার্কিন ডলার।

সিঙ্গাপুরে গণ আবাসন ব্যবস্থাও রয়েছে। হাউজিং ডেভলপমেন্ট বোর্ডের সহায়তায় ৮০ শতাংশ বাসিন্দার বাড়িঘর নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনায় সরকার ভর্তুকি দিয়ে থাকে। রাস্তাঘাটে সচরাচর কাউকে ঘুমাতে দেখা না গেলেও ধারণা করা সিঙ্গাপুরে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা প্রায় এক হাজার।

ফেব্রুয়ারিতে চন্দ্র নববর্ষের প্রথম দিন স্থানীয় সংসদের সহযোগিতায় ওহ সেং নতুন একটি ঘর পেয়েছেন।

তিনি বলেন, “আমি জীবনে প্রথমবারের মতো টিভি দেখার সুযোগ পেলাম।” সাংসদ লিয়াং জানান, তার একটি দল সেংয়ের দীর্ঘ্মেয়াদী সামাজিক পুনর্বাসনের দিকে লক্ষ্য রাখবে। একইসঙ্গে ইন্দোনেশিয়ায় থাকা তার স্ত্রী-কন্যার সঙ্গেও তাকে মিলিত করায় উদ্যোগ নিবে।

বর্তমানে আরেক ব্যক্তির সঙ্গে ভাগাভাগি করে এক বেডরুমের একটি ফ্ল্যাটে থাকছেন সেং। ছোট ঘরটিতে তেমন ফার্নিচারও রাখা হয়নি।

শুভাকাঙ্খীরা সেংকে টিভি, ফ্রিজ, কেটলি আর ওয়াটার হিটার উপহার দিয়েছেন।

সেংয়ের ওয়াটার হিটারটিই বেশি ভালো লেগেছে। কলের পানি সেংয়ের কাছে বেশি ঠাণ্ডা মনে হয়।  জঙ্গলে থাকতে তিনি ঘরের পাশের পুকুরের পানি ব্যবহার করতেন।

বর্তমানে ড্রাইভার হিসেবে কাজ করছেন সেং। বিদেশি কর্মীদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আনা-নেওয়া করেন। এর বাইরে বাগান পরিচর্যার কাজও করে থাকেন।

গত ৩০ বছর এবারই প্রথম কোনো চন্দ্র নববর্ষ পরিবারের সঙ্গে কাটালেন সেং।

“আমি অনেক খেয়েছি। কিন্তু এমন বহু খাবার আছে যেগুলো বহু বছর ধরে খাওয়া হয়নি,” হেসে বলেন তিনি।

“ভালোই চলছে। আমি ৩০ বছরের বেশি সময় পর প্রথমবারের মতো টিভি দেখলাম। আমার অনেক ভালো লেগেছে।

তবে জঙ্গলে থাকার যে স্বাধীনতা ছিল তার জন্য এখনও মন টানে বলে জানান তিনি। এখন তিনি ফ্ল্যাটেই থাকতে চান বলেও জানান।

চীনা হোক্কিয়েন ভাষায় তিনি বলেন, “আমি সেখানে অনেক বছর থেকেছি। আর তাই স্বাভাবিকভাবেই আমি সেটা মিস করি।”

“এমনকি এখনও আমি প্রতিদিন জঙ্গলে যাই। আমি ভোর ৩টায় উঠি, তৈরি হয়ে আমার সবজিগুলো দেখে আসি। তারপর শুরু হয় আমার সারাদিনের কাজ,” বলেন তিনি।


  • সূত্র: বিবিসি থেকে অনূদিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *