ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন ।।
শায়খ ইউসুফ আল-কারজাভি ধর্ম, সমাজ, আইন ও রাজনীতির ক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্বের এক প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর। বিশ্বজুড়ে খুতবা দেয়ার ক্ষেত্রে কারজাভি আরবি ভাষাভিত্তিক একটি স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করতে সক্ষম হন। ইসলামের মৌলিক নীতি, আইন ও ধর্মতত্ত্ব থেকে শুরু করে আধুনিক মুসলিম সমাজের চাহিদা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে ১৭০টি গ্রন্থ এবং শতাধিক প্রবন্ধ তার বিশাল অবদানের অন্তর্ভুক্ত। ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের পাশাপাশি ২০১১ সালের আরব বিপ্লবের পক্ষে একজন প্রতিবাদী ব্যক্তি। ৯৬ বছর বয়সে তার ইন্তেকালের মধ্য দিয়ে একটি বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের অবসান ঘটল। তার উচ্চতর চিন্তা, প্রভাসদীপ্ত চেতনা ও মধ্যপন্থার দর্শন পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষকে প্রভাবিত করেছে।
মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন কিশোর বয়সে তিনি শায়খ হাসানুল বান্নার সমাজ ও রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তাধারায় প্রাণিত হয়ে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন। তিনি ১৯৪৯, ১৯৫৪ ও ১৯৬৩ সালে বারবার বন্দী হয়ে নির্যাতনের সম্মুখীন হন। স্বৈরশাসনবিরোধী অবস্থানের কারণে মাতৃভূমি মিসর ত্যাগে বাধ্য হন ১৯৬১ সালে।
২০১৫ সালে মিসরের একটি আদালত শায়খের অনুপস্থিতিতেই তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ জারি করে। তিনি কাতারে তিন দশকের নির্বাসিত জীবন অতিবাহিত করেন। ইসলামের পুনর্জাগরণে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমন্বিত আন্দোলনকামী ব্যক্তিত্ব হিসেবে শায়খ ইউসুফ আল-কারজাভি বর্তমানে সারা পৃথিবীতে অনন্য ব্যক্তি।
৯/১১-এর হামলা, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরাইলের দখলদারিত্ব প্রতিহত করার জন্য ‘আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ’, গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, স্বৈরশাসন, আফগান পরিস্থিতি, শিল্পকলা, আধুনিকতা, ২০১৩ সালে মিসরীয় অভ্যুত্থান-পরবর্তী গণহত্যা, সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্রের হামলা, জায়নবাদ, সমকামীদের মৃত্যুদণ্ড প্রভৃতি ইস্যু নিয়ে তিনি রাখঢাক ছাড়াই কথা বলেছেন। বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্কলারদের অন্যতম হিসেবে কারজাভির যেমন প্রচুর সমর্থক রয়েছে, তেমনি সমালোচকও রয়েছে অনেক। জন এসপোজিটো ও ক্যারেন আর্মস্ট্রংয়ের মতো সুপরিচিত কয়েকজন প্রাচ্যবিদ কারজাভিকে মধ্যপন্থা অনুসারী ও সংস্কারপন্থী মনে করলেও অন্যরা ঠিক এর বিপরীত ধারণাই পোষণ করেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০০৪ সালে তেইশটি দেশের প্রায় আড়াই হাজার মুসলিম বুদ্ধিজীবী একটি পিটিশনে স্বাক্ষর করেন। সেখানে ‘সন্ত্রাসবাদী ধর্মতাত্ত্বিক’দেরকে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য তারা জাতিসঙ্ঘের প্রতি আহ্বান জানায়। এই পিটিশনে ইউসুফ আল কারজাভির নাম রয়েছে (Karen Armstrong, Islam : A Short History (New York: Random House, 2002), pp. 185–6. and John L. Esposito, “Practice and Theory: A response to ‘Islam and the Challenge of Democracy’,” Boston Review, April–May 2003; “Stop Terror Sheikhs, Muslim Academics Demand,” Arab News (Saudi Arabia), 30 October, 2004)|
২০০৫ সালের দিকে তৎকালীন লন্ডন শহরের মেয়র কেন লিভিংস্টোন কারজাভিকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। এই ঘটনায় ব্রিটিশ মিডিয়া কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখায়। লিভিংস্টোন বলেন, কারজাভির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো কাটতি বাড়াতে মিডিয়ার অপপ্রচার ছাড়া কিছুই নয়। তিনি আরো বলেন, ‘তাকে সন্ত্রাসবাদের সমর্থক বলা হয়! অথচ বাস্তবতা হচ্ছে যেসব ইসলামী স্কলার আল-কায়েদার মতো সন্ত্রাসবাদী গ্রুপগুলোর নিন্দা করেন, তাদের মধ্যে কারজাভি সবচেয়ে স্পষ্টভাষী’ (Mayor Livingstone and Sheikh Qaradawi, Õ A Coalition of Many of London’s Diverse Communities, (9 November 2004), <http://www.londoncommunitycoalition.org/> (accessed 30 July 2007); “Why the Mayor of London will maintain dialogues will all of London’s Faiths and Communities, Õ pp. 1–2.)|
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে শায়খ বান্নার অনুসারীরা মিসরের সাবেক স্বৈরশাসক জামাল আবদুন নাসেরের রোষানলে পড়ে। ‘নাসেরী-তাণ্ডবে’ বন্ধ হয়ে যায় তাদের সব দাওয়াতি তৎপরতা ও সাংগঠনিক কার্যক্রম। ওলামা-মাশায়েখ ও দায়িদের দ্বীন-ধর্ম নিয়ে বেঁচে থাকাও তখন সীমাহীন কষ্টকর হয়ে পড়ে। এ কঠিন পরিস্থিতিতেও শায়খ কারজাভি ও তার সঙ্গী-সাথীরা ন্যায়নিষ্ঠ মুসলিমদের সাথে নিয়ে তাদের দাওয়াতি তৎপরতা চালিয়ে যান। এতে তারা ধৈর্য ও প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। দ্বীন ও উম্মাহর প্রতি তাদের দায়-দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন। এর মাধ্যমে তারা এমন এক অসাধারণ জাগরণ সৃষ্টি করেন, যাতে ধর্মানুরাগী যুবসমাজের ওপর প্রবল প্রভাব পড়ে। কণ্টকময় পরিবেশে তাঁদের এ কর্ম-পদ্ধতি অবলম্বনের কারণে দ্বীনি আমলেরও হেফাজত হয়। শায়খ কারজাভি ইসলামী বিশ্বের একজন প্রতীক ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তার সুদৃঢ় অভিজ্ঞতা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে তার দক্ষতা এবং সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন দাওয়াতি ও জাগরণমূলক কাজে তার তৎপরতা তাকে পূর্ণ প্রস্তুত করেছে। এছাড়াও তিনি একজন সৎ ও মুত্তাকি আলিম। তার সব দ্বীনি কাজের জন্য তিনি শুধু আল্লাহর কাছেই সওয়াব-প্রত্যাশী। ঐন্দ্রজালিক পৃথিবীর চাকচিক্য ও রূপ-রস-গন্ধ অবজ্ঞাভরে পাশ কাটিয়ে চলেন শায়খ কারজাভি। ইসলামী দাওয়াত, তারবিয়াত ও বিপ্লবের ক্ষেত্রে তিনি এক শক্তিশালী প্লাটফর্মে পরিণত হন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা তার চিন্তা-দর্শনের মাধ্যমে আলোকিত হয়। তিনি ইসলামের এক বড় সম্পদ (সাইয়েদ আবদুল মাজিদ আল-ঘুরি, মিন তুরাছিল আল্লামা নদভী মিন আ’লামিল মুসলিমিন ওয়া মাশাহিরিহিম, দামেস্ক, ২০০২, পৃ.৩৫৫-৩৫৮; অনুবাদ, সাঈদ হোসাইন, ইমাম মুহাম্মদ বিশ্ববিদ্যালয়, রিয়াদ)।
সমসাময়িক জটিল সমস্যার সুগভীর ইজতিহাদভিত্তিক সমাধানমূলক গবেষণা-গ্রন্থের রচনা করেন তিনি সাবলীল আরবি ভাষায়। এসব গ্রন্থ পৃথিবীর বিভিন্ন জনপ্রিয় ভাষায় অনূদিত হয়ে আলিম-ওলামা, গবেষক ও সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে।
তিনি লিখেছেন, ‘ইসলাম বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও গবেষণাকে স্বাগত জানায়। ইসলামের ইতিহাসের কোথাও ইসলাম ও বিজ্ঞানের মাঝে বিরোধের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। প্রকৃতপক্ষে, ইসলামের দৃষ্টিতে, বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় উন্নতি অর্জন করা জাতির জন্যে ফরজে কেফায়া তবে এই অগ্রগতি অবশ্যই ধর্মবিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক হবে না। আধুনিক বিজ্ঞান নিয়ে তার এ অভিমত মূলত কুরআনের সূরা আন-নাহলের ৮নং আয়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সেখানে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের আরোহণের জন্য এবং শোভার জন্য তিনি ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা সৃষ্টি করেছেন। আর তিনি এমন জিনিস সৃষ্টি করেন যা তোমরা জান না।’ এ আয়াতে, ‘যা তোমরা জান না’ বাক্যাংশ দ্বারা আধুনিক সময়ের ‘গাড়ি, ট্রেন, বিমান ও মহাকাশযানের’ প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে বলে কারজাভি মনে করেন। একই সাথে ‘বিজ্ঞানের অগ্রগতি’কেও নির্দেশ করা হতে পারে।
অন্যদিকে, আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কিত আলোচনায় কারজাভি কুরআনের আক্ষরিক অর্থের চেয়ে মর্মার্থকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে সূরা আনফালের ৬০নং আয়াতের উল্লেখ করা যায়, যেখানে বলা হয়েছে, ‘তাদের (সাথে যুদ্ধের) জন্য তোমরা যথাসাধ্য সাজ-সরঞ্জাম, শক্তি ও ঘোড়া প্রস্তুত রাখবে এবং এ দিয়ে তোমরা আল্লাহর দুশমন ও তোমাদের দুশমনদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে দেবে।’ এ আয়াতে জিহাদের জন্য ঘোড়া পালনকে উৎসাহিত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কারজাভির ভাষ্য হচ্ছে, এটি এ কারণে যে, তখন ঘোড়া ছিল সামরিক যান। এখন আর এটি প্রাসঙ্গিক নয়। যুগের পরিবর্তনের ফলে নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চল ছাড়া আর কোথাও যুদ্ধক্ষেত্রে ঘোড়া কাজে আসে না। বরং এখনকার যুদ্ধে ট্যাংক, সামরিক যান এবং এ ধরনের উন্নত সব সমরাস্ত্র ব্যবহৃত হয়। আমরা বলতে পারি, এগুলোই বর্তমানকালের ঘোড়া। বর্তমানে যারা এসব যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারে, তারাই এ যুগের অশ্বারোহী (Yusuf al-Qaradawi, ÔCloning and its Dangerous Impacts,Õ Islam Online (29 December 2002); Al-Jazeera Television. Life and Religion : Islamic Cleric al-Qaradawi Says Internet Part of ‘Contemporary Jihad,’” (3 October 2004) BBC Monitor, (accessed 7 October 2004); Yusuf al-Qaradawi, ÔHas Western Civilization Brought any Comfort? Islam Online, (12 May 2003); Yusuf al-Qaradawi. Raising Horses and Today’s Modern Weapons, Islam Online, (7 March 2005); Yusuf al-Qaradawi, Deserting Worldly Sciences for Religious Studies. Islam Online (4 December 2006)|
গতানুগতিক ইসলামী জ্ঞান অর্জনের জন্য মুসলিম তরুণদের আধুনিক বিজ্ঞান অধ্যয়ন ছেড়ে দেয়া প্রসঙ্গে কারজাভি একটি ফতোয়া দেন। তিনি বলেন, ‘বিজ্ঞান অধ্যয়ন করা এমন একটা বিষয় যা এড়িয়ে যাবার কোনো সুযোগ নেই। এর মধ্যে রয়েছে গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিজ্ঞান, ভূতত্ত¡বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, সমুদ্রবিজ্ঞান, মরুবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা।’ তার বক্তব্য হচ্ছে, বর্তমানে বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। কোনো জাতি যদি এসব ব্যাপারে গবেষণা ও গভীর অনুসন্ধান না করত তাহলে আমরা আজ পরমাণুর বিভাজন, মহাশূন্য অভিযান, কম্পিউটারবিজ্ঞানের বিপ্লব, ইন্টারনেট, তথ্যপ্রযুক্তি, জীববিদ্যা, যোগাযোগব্যবস্থাসহ আরো অনেক ক্ষেত্রে এতসব অগ্রগতি দেখতে পেতাম না। এসব অর্জনই আধুনিক যুগকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে (অধ্যাপক স্যামুয়েল হেলফন্ট, ইউসুফ আল কারজাভি, ইসলাম অ্যান্ড মডার্নিটি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র। অনুবাদ, আইয়ুব আলী, সিএসসিএস বিডি ডটকম)।
তিনি শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ নতুন কাঠামোর আলোকে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। তার বক্তব্য হচ্ছে, জ্ঞান অবশ্যই ‘ধর্মবিশ্বাস দ্বারা লালিত এবং কিছু মূলনীতি ও পদ্ধতি দ্বারা পরিচালিত হতে হবে। পাশ্চাত্যে ধর্মীয় বিশ্বাস ও জ্ঞানের মধ্যে পৃথকীকরণের কারণে সামরিক ক্ষেত্রে গণবিধ্বংসী পারমাণবিক, রাসায়নিক ও জৈবিক অস্ত্রের উন্নয়নের ফলে সেই জ্ঞান পুরো বিশ্বের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠেছে। এছাড়া ধর্মবিশ্বাস বিচ্ছিন্ন জ্ঞান অনিরাপদ ও অবৈধ মাদকদ্রব্য উৎপাদনেও ভূমিকা রাখছে। আর এগুলো তারাই বাজারজাত করছে, সৃষ্টিকর্তার প্রতি যাদের কোনো ভয় নেই এবং সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির প্রতিও যাদের কোনো মমতা নেই।’ বিজ্ঞানসংক্রান্ত কারজাভির চিন্তায় একটা তাৎপর্যপূর্ণ ব্যতিক্রম আছে। বিজ্ঞান কুরআনের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক হতে পারে- কারজাভি এমনটা মনে করেন না। তিনি প্রায়ই বলে থাকেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে স্বাধীনতার সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতা ছাড়া একজন পরাধীন ব্যক্তি কোনো কিছুই করতে পারে না। যত দিন পর্যন্ত আমাদের দেশগুলোতে বলপূর্বক শাসন চলবে, স্বাধীন ব্যক্তিদের ডিটেনশন ক্যাম্প ও জেলখানায় নিক্ষেপ করা হবে, শাসকেরা লাঠি হাতে দেশ শাসন করবে, বিচারকদেরকে একের পর এক গ্রেফতার, কারারুদ্ধ ও অত্যাচার করা হবে এবং রাজনৈতিক দল গঠন ও সংবাদমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকবে; ততদিন পর্যন্ত আমাদের জাতি পশ্চাৎপদতার বেড়াজালে বন্দী থাকবে। স্বাধীন মানুষের নেতৃত্বেই একটি জাতির জন্ম হয়। তারাই জাতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। কিন্তু আমরা যদি দাসত্বের শেকলে আবদ্ধ থাকি, তাহলে এই জাতি প্রয়োজনীয় সময়ে কিছুই করতে পারবে না। জাতি সবসময়েই পেছনে পড়ে থাকবে।’ (Yusuf al-Qaradawi, Taysir al-Fiqh li-lMuslim al Mu’asir fi Daw’ al-Qur’an wal-Sunna (Making Fiqh Easy for Contemporary Muslims in the light of Quran and Sunna),Õ (Beirut : Muasasat al-Risala, 2000); Islamic Law and Society 1, No. 2 (1994), p. 180; Qatar TV, ÔLive Sermon from Umar Bin-al-Khattab Mosque in Doha, (18 April 2006), BBC Monitoring: Near/Middle East: Round-Up of Friday Sermons 18 Apr 06, (accessed 2 May 2006)|
কারজাভি আধুনিকায়ন ও পাশ্চাত্যকরণের মধ্যে স্পষ্টভাবে পার্থক্য করেছেন। ইসলামী বিশ্বে এক ধরনের ‘বিকল্প আধুনিকতা’ গড়ে তোলার জন্য কারজাভি প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। বিজ্ঞানের অগ্রগতির যে বিষয়গুলো ইতিবাচক ও কুরআনের মূলনীতি ও নৈতিকতার অনুক‚ল সেগুলোকে গ্রহণ এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার অনাকাক্সিক্ষত বিষয়গুলো বর্জন করে আধুনিকতার এই ধারা গড়ে উঠবে। কারজাভি বিশ্বাস করেন, এর ফলে এক সময় এমন একটি বিকল্প সভ্যতা গড়ে উঠবে যা মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবার কাছেই আকর্ষণীয় এবং গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। বাস্তবতার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে কারজাভি দেখতে পান, মুসলিম বিশ্বে আধুনিকতা একটি বাড়তি চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাজির হয়েছে। গণমাধ্যম ও আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা ইসলামী বিশ্বে এমনসব নতুন আইডিয়ার জন্ম দিচ্ছে, যা গতানুগতিক ইসলামী ধর্মতত্তে¡র জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে (অধ্যাপক স্যামুয়েল হেলফন্ট, অনুবাদ, আইয়ুব আলী, প্রাগুক্ত)।
শিয়াদের বিষয়ে ইউসুফ কারজাভি ‘যাহিরাতুল গুলোউ ফিত-তাকফীর’ গ্রন্থে মুসলমানকে কাফির সাব্যস্ত করার বাড়াবাড়ি, ফলাফল ও উত্তরণে করণীয় আলোচনা প্রসঙ্গে শিয়াদের ব্যাপারে তার স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়। ‘শিয়াদের বিষয়ে আমার বক্তব্য- তারা বিদআতি। কাফির নয়। এটা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের ঐকমত্য সিদ্ধান্ত। আলহামদুলিল্লাহ! মুসলিম উম্মাহর নয়-দশমাংশ আহলুস সুন্নাহর অনুসারী। শিয়া ইমামিয়াদের ব্যাপারে মধ্যপন্থী সব আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মতামত হলো তারা ভ্রান্ত। চরমপন্থী শিয়ারা কাফির। কুরআন, সুন্নাহ ও সাহাবাদের ব্যাপারে শিয়াদের দৃষ্টিভঙ্গি, ইমামদের নিষ্পাপ হওয়া এবং গায়েব বিষয়ে নবীদের থেকে তাদের ইমামদের বেশি জানার বিষয়ও চরম আপত্তিকর। বহু আগে থেকেই তাকফিরি তত্তে¡র প্রতিরোধ আমি করে আসছি। আমি এই বাড়াবাড়ির কঠোর বিরোধিতা করেছি। আমি বরং মনে করি, যে কালিমার সাক্ষ্য দেয় এবং তার অবশ্য দাবি পূরণ করে, সে নিশ্চিত ইসলামের অন্তর্ভুক্ত। আমার বক্তব্য খুবই স্পষ্ট, আয়াতুল্লাহ খামেনির সাথে সাক্ষাতেও আমি বলেছি, কিছু বিষয় আমাদের নিকট স্পর্শকাতর, এটা কোনোভাবে অতিক্রম করা যাবে না। সাহাবাদের গালি দেওয়া এবং সুন্নি দেশে শিয়াইজমের প্রচার অন্যতম। এ বিষয়ে প্রধান প্রধান শিয়া আলিমরা আমার সাথে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। শিয়াদের অনেক বড় আলেম পর্যন্ত সাহাবায়ে কেরাম বিষয়ে কুধারণা পোষণ করেন। যদিও প্রকাশ্যে তাকিয়া করে কিছু বলেন না। সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে কোনো কুৎসা রটনা করলে আমরা চুপ থাকব না। মিসর, সুদান, মরক্কো, আলজেরিয়া ও নাইজেরিয়াসহ আফ্রিকান দেশগুলোতে শিয়া মতবাদ প্রচারের চেষ্টা চলছে। সুন্নি অঞ্চলে শিয়াইজম প্রচার ভবিষ্যতে সশস্ত্র সংঘাত ডেকে আনতে পারে। খালেস ইসলামের দাওয়াত দিলে আমাদের কোনো অসুবিধা নেই, যেমন সুন্নিরা ইসলামের দাওয়াত দেন, বিতর্কিত বিষয়গুলোকে দাওয়াতের মাধ্যম বা বিষয়বস্তু বানান না।’ শায়েখ কারজাভি শিয়াদের দ্বারা সুন্নি মুসলিম-সমাজে হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করলেও পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনে তার অধিকারকে সমর্থন করেন। তাছাড়া ইরানের ওপর যেকোনো বহিঃশক্তির আগ্রাসনে তার পাশে দাঁড়াবার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি মনে করেন, ‘ইরান মুসলিম উম্মাহর অংশ। তার পাশে দাঁড়াতে ইসলামই আমাকে উদ্বুদ্ধ করে’ (মুজাহিদুল ইসলাম, ফাতেহ২৪ ডটকম, ১৪ জানুয়ারি, ২০২০)
শায়খ কারজাভি যুক্তি দেখিয়েছেন যে, শান্তিপূর্ণ বিপ্লব অত্যাচারী শাসনের অবসান ঘটাতে পারে এবং মুসলিম রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের সূচনা করতে সাহায্য করতে পারে। ফিলিস্তিনের মুক্তি এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামিকভাবে প্রভাবিত গণতান্ত্রিক সংস্কারের উদ্দেশ্যে আন্দোলন করার জন্য তিনি সবচেয়ে বেশি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তার বুদ্ধিবৃত্তিক সাধনা, মধ্যপন্থা অবলম্বন ও দাওয়াতি কর্মপ্রয়াস ইসলামী আন্দোলনের কর্মী এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
তথ্যসূত্র: দৈনিক নয়া দিগন্ত, ১৪ নভেম্বর ২০২২