আল হাফিজ ও আযাদ আলাউদ্দীন ।।
ইসরাত জাহানের প্রথম গদ্যগ্রন্থ ‘গল্প হলো শুরু’ প্রকাশিত হয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৩-এ। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে চয়ন প্রকাশন, ঢাকা। গ্রন্থটির সুন্দর প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়। এই বইয়ে ৪৫টি গল্প রয়েছে। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় লেখকের বিচরণ থাকলেও গল্পের আঙিনাই তার প্রিয়তর স্থান। এখানেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তার ভাষাশৈলীর সৌকর্য আর চিত্রশৈলীর নান্দনিক বুনন মানব সভ্যতার যাপিত জীবনের চিত্রমালা দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম। জীবনের নানামুখী ছবি নানামাত্রিক ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করে পাঠকের দরবারে পেশ করেন এই শিল্পী। পরিবেশ-প্রকৃতি, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহ, দু:খ-কষ্টকে তিনি তুলে ধরেন মায়াবী ছোঁয়ায়। একটি নিটোল সাংস্কৃতিক আবহে তার বেড়ে ওঠার ফলে তিনি পেয়েছেন এক অনন্য জীবনবোধ- যা তাকে শিল্প-সাহিত্য চর্চায় অনুপ্রাণিত করেছে।
‘গল্প হলো শুরু’ নামক এ গ্রন্থে ইসরাত জাহান যাপিত জীবনকে দেখেছেন খুব ভেতর থেকে দরদি মন নিয়ে। তার দেখার ভেতরে রয়েছে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ জীবনবোধ। জীবনদর্শনের এই বোধ পাঠক সমাজকে নিয়ে যায় এক অলৌকিক পরিভ্রমণে, যেখানে গিয়ে পাঠক খুঁজে পায় নিজের জীবনের ঘটনাবহুল ছায়াছবি। সাধারণকে অসাধারণভাবে উপস্থাপনের কারিশমা, দরদ জাগানিয়া মুনশিয়ানা এবং বর্ণনার নৈপুণ্যে চমৎকৃত হয়ে ওঠে পাঠক-হৃদয়। বলা যায় প্রথম গ্রন্থেই লেখক ইসরাত জাহান রসজ্ঞ পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছেন। আমরা লেখকের ‘খুনশুটি’ গল্প থেকে একটি অংশ তুলে ধরছি- ‘আমাদের স্বামী স্ত্রী দু‘জনের মধ্যকার সম্পর্কটা ঠিক যেন পেপসির মতন, যেমন ঝাঁঝালো তেমন স্বাদের।’ [ খুনশুটি, পৃষ্ঠা- ১৮ ]।
লেখকের বর্ণিত এই অনুভূতি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ঘটে চলা দাম্পত্য জীবনের প্রতিচ্ছবির কথা সহজেই মনে করিয়ে দেয়। যারা গল্প পড়তে ভালোবাসেন তারা ইসরাতের গল্প পড়ে নিজস্ব জীবনের ছবি দেখতে পাবেন। মূলত মানব জীবনের চলমান ঘটনাপ্রবাহ এবং তার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা আনন্দ-বেদনার কথা ফুটিয়ে তুলতে তিনি সাফল্যের ছাপ রেখেছেন এই গ্রন্থে। অনেক দিন থেকে তিনি সাহিত্যচর্চার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। পাশাপাশি তিনি ওয়েব ম্যাগাজিন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন সাহিত্য গ্রুপে লেখালেখি করছেন। ফলে তার লেখা সহজেই পাঠকের নজরে পড়ে এবং পাঠক তার প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন। এই গ্রন্থেও লেখক মানুষের মন ও প্রকৃতির যে ছবি তুলে ধরেছেন তা পাঠকের ঔৎসুক্য বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
ইসরাত জাহান অনুভূতিপ্রবণ মন নিয়ে দেখেছেন মানব সমাজকে। ফলে সমাজের টুকরো টুকরো আনন্দ-বেদনার ছবি, প্রেম-বিরহের চিত্র উঠে এসেছে তার ঐন্দ্রজালিক মায়াবী ছোঁয়ায়। সাধারণ মানুষের আশা-নিরাশা, পাওয়া-নাপাওয়া, সুখ-দু:খ সবই ফুটে উঠেছে সহজ-সরল আবেগময় ভাষায়। মধ্যবিত্তের জীবনচিত্র অংকনে লেখকের সাবলীল উপস্থাপনাকৌশল পাঠক সমাজকে আকৃষ্ট করে। ‘ম্যারেজ ডে’ [পৃষ্ঠা- ০৯] গল্পে আমরা দেখি এক নব-বিবাহিত মধ্যবিত্ত পরিবারের আনন্দ-বেদনার কাব্য। আবার ‘মায়ের ডায়েরি’ [পৃষ্ঠা- ১৪ ] গল্পে দেখি এক অসহায় মায়ের করুণচিত্র। যার বর্ণনা এমন- ‘টেবিলের ওপর কিছু রং রয়েছে, ছড়িয়ে দিস তোর মায়ের মতো বিধবা মায়েদের সাদা থানে। যারা অন্যের জীবন রঙিন করতে গিয়ে নিজের জীবনের রঙ ভুলে গিয়েছে।’ -[মায়ের ডায়েরি, পৃষ্ঠা-১৬]।
ইসরাত জাহানের রয়েছে সমাজ জীবনের নানামুখী অভিজ্ঞতা। ফলে ক্ষয়িষ্ণু সমাজের মধ্যবিত্তের প্রাত্যহিক জীবনের লড়াই-সংগ্রাম, আশা-হতাশা, স্বপ্ন-সম্ভাবনার কথা দরদ দিয়ে তুলে আনতে পেরেছেন তিনি। সমাজের চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা রকম অসঙ্গতির চিত্র, ছোট ছোট আনন্দ-স্মৃতি তার কলমে ধরা পড়েছে সাবলীলভাবে। ‘তিন ঘরের নামতা’ [ পৃষ্ঠা- ১০৪ ] গল্পে আমরা দেখি সন্তানের গর্বে গর্বিত এক পিতার উৎফুল্ল মুখচ্ছবি। আবার ‘হুইল চেয়ার’ [ পৃষ্ঠা- ৭৫ ] গল্পে দেখা যায় প্রথম জীবনের ছাত্র শুভ’র আন্তরিক ব্যবহারে মুগ্ধ এক অসহায় পঙ্গু শিক্ষকের আনন্দিত মুখ। এমনিভাবে ‘উপহার’ [পৃষ্ঠা-৪৯ ] গল্পে দেখি কাজের বুয়াকে খুশি করার এক আনন্দ-কৌশল। এই সব ছোট ছোট কাহিনির মধ্য দিয়ে লেখক এমন এক ছবি পাঠকের সামনে তুলে ধরেন যা পাঠকচিত্তকে আলোড়িত করে এবং তাকে মানবিক হয়ে উঠতে শেখায়।
‘গল্প হলো শুরু’ নামের এ গ্রন্থে ইসরাত জাহান ঝরঝরে ভাষায় সূক্ষ্ম রসবোধের মাধ্যমে এমন কতিপয় কাহিনি বলেছেন যা সাধারণ পাঠকের মনোজগতে দাগ রেখে যায়। মনকে ছুঁয়ে যাওয়া এ সব গল্পে এমন কিছু চিরন্তন সত্য ফুটে উঠেছে, যে সত্যের মুখোমুখী হতে সত্যিকার অর্থেই সাহসের দরকার হয়। লেখক সেই সাহসের পরিচয় সাফল্যের সঙ্গেই দিতে পেরেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ‘বৃদ্ধাশ্রম’ [ পৃষ্ঠা- ১১১ ] গল্পটির কথা। ইউরোপীয় অপসংস্কৃতি থেকে এসে আমাদের সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়েছে বৃদ্ধাশ্রম সংস্কৃতি। যে সংস্কৃতি মানবসভ্যতাকে আজ প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। আরো কয়েকটি গল্পের কথা বলা যায় যেমন ‘টাকার বাক্স’ [পৃষ্ঠা- ১১৬ ], ‘রকিং চেয়ার’ [পৃষ্ঠা- ৫৬ ], ‘লজিং মাস্টার’ [পৃষ্ঠা- ১৫৩] ইত্যাদি। এসব গল্পে জীবনের করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে অত্যন্ত আবেগময় ভাষায় যা পাঠকমনকে আবেগাপ্লুত করে, চোখকে সজল করে তোলে।
‘গল্প হলো শুরু’ ইসরাত জাহানের প্রথম গল্পগ্রন্থ, এতে ৪৫টি গল্প সংকলিত হয়েছে। লেখক মানুষের জীবনকে নানাভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন এ গ্রন্থের মাধ্যমে। তার দেখার চোখ সমাজের গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছে নি:সন্দেহে। এ গ্রন্থে তিনি সাধারণ মানুষের হৃদয়কাড়া ছবি ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। তার বর্ণনায় রয়েছে হৃদয়ছুঁয়ে যাওয়ার মতো কলাকৌশল। অনেক পাঠকই তার গল্পের প্রেমে পড়বেন বলে আমরা মনে করি। তবে ছোটগল্প, কাহিনি এবং ব্যক্তিগত অনুভূতিকে আলাদাভাবে চিনতে হবে তাকে। ছোটগল্পের আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানা না থাকলে প্রকৃত ছোটগল্প লেখা সহজ নয় বলেই আমাদের বিশ্বাস। সংবেদনশীল তরুণ এই লেখকের কাছে বাংলা সাহিত্যের পাঠকের প্রত্যাশা অনেক। আমরা আশা করি, ভবিষ্যতে প্রকৃত ছোটগল্প সৃষ্টি হবে তার হাতে । তার সচেতনতাই তাকে একদিন যথার্থ পথের সন্ধান দেবে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত রোজনামচা কখনো কখনো ছুঁয়ে যায় পাঠকের মন। সঙ্গে সঙ্গে পাঠক তার প্রতিক্রিয়া জানায় আনন্দচিত্তে। ফলে লেখকের ভেতর জেগে ওঠে ‘লেখক’ হয়ে ওঠার স্বপ্ন। আর এভাবেই কারো কারো গল্প লেখা শুরু হয়ে যায়। এ জাতীয় লেখকগণ সাহিত্যিক ‘ছোটগল্প’ আর ‘কাহিনি’র মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তা বুঝতেই পারেন না। সাহিত্যের এক অসাধারণ আঙ্গিকের নাম ‘ছোটগল্প’ যা শুধু কাহিনির বর্ণনা দিয়ে সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। এ জন্য ছোটগল্প বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করা প্রয়োজন । স্মৃতি জাগানিয়া সরল অনুভূতির তরল বর্ণনাই ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য নয়। ছোটগল্প আরো গভীরের বিষয়, আরো তাৎপর্যের দাবি রাখে এই আঙ্গিকটি। ‘গল্প হলো শুরু’ গ্রন্থে ইসরাত জাহানের স্বার্থক ছোটগল্প লেখার প্রয়াস লক্ষণীয়। তার হাতে প্রকৃত ছোটগল্প সৃষ্টি হোক আমরা সেই প্রার্থনা করি।
ঝকঝকে ছাপা এবং সুন্দর বাঁধাই করা ১৭৬ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থটির মূল্য রাখা হয়েছে মাত্র ৩৫০ টাকা। অনবদ্য এ গ্রন্থটি বোদ্ধা পাঠক ও সমালোচকদের কাছে সমাদৃত হবে বলেই আমরা মনে করি।