রিয়াজুল ইসলাম বাচ্চু ।।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ কৃষি নির্ভর। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা ঝালকাঠি ও পিরোজপুরের কৃষকদের একটি বড় অংশ পুষ্টিগুন সম্পন্ন আপেল খ্যাত পেয়ারা চাষের সাথে জড়িত। এই এলাকার চাষীরা বংশ পরম্পরায় প্রায় ২শ বছর যাবত পেয়ারা চাষ করছেন। পেয়ারা চাষ করে অনেকে বিত্তশালী ও অর্থের মালিকও হয়েছেন। জলের উপর ভাসমান বাজারে জমজমাট ব্যবসা এবং এর খ্যাতি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও সুনাম অর্জন করেছে।
ঝালকাঠি জেলার কীর্তিপাশা, ভীমরুলি, শতদশকাঠি, আটঘর, কুড়িয়ানা, বাউকাঠি, খাজুরিয়া, ডুমুরিয়া, কাপুরকাঠি, সাওরাকাঠি, পোষন্ডা, হিমানন্দকাঠি, রমজানকাঠি, জগদীশপুর, শিমুলেশ্বর, রামপুর, কাঁচাবালিয়াসহ ১৩টি গ্রাম ভাসমান পেয়ারা চাষের জন্য বিখ্যাত। এসব এলাকায় ৩৫০ হেক্টর জমিতে এবং পিরোজপুরের নেছারাবাদের আদমকাঠি, বংকুরা, মাহমুদকাঠি, আদা বাড়িসহ ২৬টি গ্রামে ৬৪৫ হেক্টর জমিতে বানারীপাড়া উপজেলার নরেরকাঠি, আলতা, গাভাসহ ১২ টি গ্রামে ৯৩৭ হেক্টর জমিতে পেয়ারা চাষ হয়, হেক্টর প্রতি প্রায় ১০ থেকে ১২ মেট্রিক টন পেয়ারা উৎপাদন হয়। তবে স্থানভেদে কমবেশি হতে পারে। এ এলাকার প্রায় ৫১ টি গ্রামে দেশীয় পেয়ারা চাষ করা হয় এবং সহস্রাধিক পরিবার পেয়ারা চাষের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু নানা কারণে পেয়ারা চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন এ অঞ্চলের চাষীরা। বদলাচ্ছে পেয়ারা চাষের পেশা। চাষীরা ঝুঁকছেন অন্য পেশায়।
বর্তমানে পেয়ারার বাজার মূল্য কম, শ্রমিকদের মজুরির মূল্য বেশি থাকায় লাভ কম হচ্ছে। এ এলাকায় সংক্ষণের জন্যে কোন হিমাগার ব্যবস্থা নাই। পেয়ারার আবরণ (পিল) খুব পাতলা, সীমিত ও কম স্থায়িত্ব বিধায় এটি দ্রুত পঁচনশীল। তাই আগের মত এখনকার প্রতিযোগিতার বাজারে লাভবান হচ্ছে না চাষীরা। দেশি পেয়ারা নানা রকম রোগ বিশেষভাবে এনথ্রাকনোজ জাতীয় ছত্রাকের আক্রমনে করে, খরা, অনাবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টিতে ফলন ভালো হয় না। এছাড়াও দেশী পেয়ারা অনেক পুরানো জাতের ক্রমবিকাশ হওয়ায় স্বাদের মানও দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ ফলটি নিয়ে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে তেমন কোন গবেষণা না করায় কোন উন্নত জাত বা নতুন কোন জাত তৈরি হচ্ছে না বা আধুনিকতার ছোঁয়া পাচ্ছে না।
অপরদিকে অধিক লাভের আশায় পেয়ারা বাদ দিয়ে- আমড়া, মাল্টা, লেবু ও থাই পেয়ারা চাষের দিকে ঝুঁকছেন এ অঞ্চলের চাষীরা। আমড়ার জীবনকাল দীর্ঘমেয়াদী ও পেয়ারার চেয়ে কম পঁচনশীল এবং বাজারে চাহিদাও বেশি, মাল্টা ও লেবু চাষ নতুন দিগন্ত উম্মোচন করছে। এতে ফলন যেমন ভালো হচ্ছে তেমন বাজারে বেশি চাহিদা থাকায় দামও পাওয়া যাচ্ছে। বছরের প্রায় ১২ মাস ই থাই পেয়ারা পাওয়া যায়। স্বাদ ও ফলন বেশি হওয়ায় বর্তমান বাজারে সারা বছরই চাহিদা থাকায় থাই পেয়ারা চাষের দিকে ঝুঁকছেন চাষীরা। কোন কোন চাষী পেয়ারা বাগান কেটে আম চাষের উদ্যোগী হচ্ছেন।
এ বিষয়ে ঝালকাঠি সদর উপজেলার রমজানকাঠি কারিগরি ও কৃষি কলেজের কৃষি ডিপ্লোমা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান কৃষিবিদ ও ফল বিশেষজ্ঞ ড. চিত্ত রঞ্জন সরকার পেয়ারা চাষের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, ‘আমাদের অঞ্চলের পেয়ারা গয়া বা গইয়া নামে পরিচিত। পেয়ারার বৈজ্ঞানিক নাম সিডিয়াম গোয়েজাবা এবং এটি মাইরটেসি পরিবারভুক্ত । মূলত: গয়া বা গইয়া পেয়ারার একটি স্থানীয় জাতের নাম। প্রায় ২শত বছর আগে ভারতের বিহার প্রদেশের গয়া জেলার ফলগু নদীতে এই অঞ্চলের লোকেরা পাপ খন্ডনের জন্য তাদের পূর্ব পুরুষের নামে পিন্ডদান করে ফেরার সময় গয়া থেকে গয়া ফল নিয়ে এসে কান্দিতে চাষাবাদ শুরু করে। গয়া থেকে আনীত ফল এ অঞ্চলে আত্তীকরণের কারণে গয়া বা গইয়া ফল নাম পরিচিতি লাভ করে। পেয়ারা নামটি তখন তাদের হয়তো অবগত ছিল না। কারো কারো মতে আন্দাকুল গ্রামের নিবাসী পূর্ণচন্দ্র মন্ডল নামে এক ব্যক্তি এভাবে পিন্ডদান করে ফিরে এসে যখন ওই জাতের পেয়ারা চাষাবাদ করেন সেজন্য এ জাতকে পূর্ণমন্ডলী জাতও বলা হয়। তাই ঝালকাঠি অঞ্চলের পেয়ারা জাতকে স্বরুপকাঠি জাত না বলে পূর্ণমন্ডলী জাত বলাই সঠিক বলে মনে হয়।
তিনি আরো বলেন , যখন আমড়া, মাল্টা ও লেবুর ফলন বেশি, আয়ুষ্কাল দীর্ঘমেয়াদি, বাজারে চাহিদা বেশি থাকায় পেয়ারা চাষ কমিয়ে এ সকল ফলের চাষ বৃদ্ধি করছেন চাষীরা। এ অঞ্চলের দেশীয় পেয়ারা ২শ বছরের পূরানো জাত ক্রমবিকাশ হয়ে বর্তমানে স্বাদের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এটির ভালো জাত হলো আপেল পেয়ারা। এ জাতটিকে সংরক্ষণ করে নতুন চারা উৎপাদনের মাধ্যমে চাষ বাড়াতে হবে। কম স্বাদের পেয়ারার জাত ধ্বংস করে ফেলতে হবে। ফলে দেশীয় পেয়ারার প্রতি মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে সাথে সাথে সরকারি উদ্যোগে পেয়ারা সংরক্ষণের জন্যে হিমাগার, পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থা আধুনিক ও সময়োপযোগী করতে হবে। দেশীয় পেয়ারা গবেষণার মাধ্যমে নির্বাচন বা সিলেকশন পদ্ধতিতে দেশীয় জাত থেকে উচ্চ ফলনশীল ও সুস্বাদুজাত উদ্ভাবন করা সম্ভব। যথাযথ রিসার্চের মাধ্যমে উন্নত জাতের সুস্বাদু পেয়ারার আবির্ভাব ঘটাতে হবে। কৃষকদের সহজ শর্তে লোন ও প্রণোদনা দেয়ার ব্যবস্থা করলে অতি পুরানো ফলটির ঐতিহ্য ধরে রাখা সম্ভব হবে। অন্যথায় ফলটির চাষাবাদ আশংকাজনক হারে কমে যেতে পারে।”
এ বিষয়ে ঝালকাঠি সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সুলতানা আফরোজ বলেন, “পেয়ারার বাজার মূল্য কম, সংরক্ষণের অভাব, পঁচনশীল ও পেয়ারা শ্রমিকদের মজুরির বেশি থাকায় চাষীদের লাভ কম হচ্ছে। পেয়ারা বাগানের সঠিকভাবে যত্ন ও যথাসময়ে সার ঔষধ প্রয়োগ করা হয় না, ফলে কাঙ্খিত ফলন পাওয়া যায় না। তাছাড়া দেশি পেয়ারা থাই পেয়ারার চেয়ে আকারে ছোট হওয়ায় কৃষকরা থাই পেয়ারাসহ অন্যান্য ফল চাষে মনোযোগী হচ্ছেন। গবেষণা করে এ ফলটির ফলন বৃদ্ধি করা যেতে পারে। নতুনজাত সিলেকশন, ফলের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ ফলটি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।”
দেশীয় জাতের পেয়ারা চাষীদের এ পেশায় নিয়োজিত রাখতে হলে তাদেরকে সরকারীভাবে তত্ত্বাবধান করতে হবে। গবেষণার মাধ্যমে নতুন জাত সৃষ্টি করতে হবে। তাহলে চাষীরা অন্য ফল চাষে আগ্রহী কম হবেন এবং ঐতিহ্যবাহী আপেল খ্যাত পেয়ারা ফলটি আমাদের এলাকায় টিকিয়ে রাখা যাবে।
রিয়াজুল ইসলাম বাচ্চু
অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত)
ঝালকাঠি ইন্সটিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি,
ঝালকাঠি। মোবাইল ০১৭১৬৬০৯৩৯৮