আল হাফিজ।।
জাদুকরী পদ্যের পেখম মেলে কবিরা কথা বলেন আবেগময় ভাষায় আর আবেগের সঙ্গে বেগের মিলন ঘটিয়ে কবিরা এমন এক জগৎ সৃষ্টি করেন যার স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে মানুষ। কবিতা মানুষের স্বপ্নের সুন্দর বয়ানে সতত সজাগ; হৃদয়ের ভাষা দিয়ে সহজ রীতিতে যা প্রকাশিত হয়। এই রীতিকৌশল কতোটা কল্যাণকর তা বিবেচনা করবেন পাঠকসমাজ। তবে দেশ জাতি ও সমাজকে স্বপ্ন দেখিয়ে কল্যাণের পথে, সম্ভাবনার পথে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন কবিগণ। এখানেই প্রকৃত কবিতার সার্থকতা, এখানেই কবিতার সৌন্দর্য্য।
কবিতা আশা-আকাক্সক্ষার কথা বলে, ভালোবাসার কথা বলে। আশা আর ভালোবাসার কথা বলতে আবেগের শিল্পিত প্রয়োগ হয় সহজ-সাবলিলভাবে। এমনই নন্দিত আবেগ নিয়ে ‘অন্তিম অপেক্ষায়’ শীর্ষক কবিতার বই রচনা করেছেন কবি মিনহাজ সাদ্দাম। সহজ-সরল ভাষায় জীবনের নানামুখী আনন্দ-বেদনার গাঁথা উপমার মাধ্যমে বলার চেষ্টা করেছেন তিনি। তার ভাষায় রয়েছে সহজ জীবনদর্শন ও রোমান্টিক পরিবেশ, রয়েছে গ্রামীণ জীবন যাপনের আদর্শিক ছায়াচিত্র। ফেলে আসা শৈশব-কৈশোরের এক অনন্য সাধারণ স্বপ্নময় ভূবন। জৈবনিক চাওয়া-পাওয়া, প্রেম-বিরহ, স্বপ্ন-সম্ভাবনার কথা তিনি বলার চেষ্টা করেছেন সহজ-সরল আবেগী ভাষায়। যেমন-
ক. মাঝে মাঝে মন চায়- আমি তোমার হয়ে যাই
তোমার সাথে শিউলি বনে নিজেকে হারাই।
– ( তোমার হয়ে যাই, পৃষ্ঠা- ০৭)
ঐতিহ্য সচেতন কবি মিনহাজ সাদ্দাম সাহিত্য চর্চা করেন প্রাণের টানে। পদ্য-কবিতা লিখে তিনি ইতোমধ্যেই যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছেন নিজস্ব পরিমণ্ডলে। তার প্রকাশিত কবিতার বইয়ে তিনি যাপিত জীবনের বৈচিত্র্যপূর্ণ ছবি আঁকার চেষ্টা করেছেন আন্তরিকতার সঙ্গে। তার কবিতার কেন্দ্রে রয়েছে আমাদের ঐতিহ্যময় গ্রামীণ স্মৃতি স্নিগ্ধ মা-মাটি আর মানুষ। তার কাব্যচেতনায় রয়েছে আনন্দময় নৈতিক সত্য-ন্যায় এবং মানবিক সৌন্দর্যের জীবন্ত উপলব্ধি যা তাকে প্রেমময় মানবতার স্মৃতি সন্ধানী করে তোলে। ফলে তার কবিতায় সামাজিক মূল্যবোধ, দৈনন্দিন আনন্দ-বেদনার কথা উঠে আসে সহজ ভাষায়। তার কবিতার প্রাণজ ভাব, ছন্দের অনুরণন এবং বর্ণিল বর্ণনার কিছু পঙক্তি নিম্মে তুলে দিলাম-
ক. বুঝে নিও চোখের ভাষা, দিলাম উড়িয়ে এক বুক ভালোবাসা।
– ( কবে পারবো তোমায় ছুঁতে, পৃষ্ঠা-০৮)
খ. তোমার ডাগর কালো চোখের পাতায়
প্রতিদিনই হয় মরণ।
– ( শ্রেয়সী, পৃষ্ঠা- ২১)
এসব পঙক্তি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের মনের পর্দায় এমন কিছু চিত্র ভেসে ওঠে যা তাকে আবেগমথিত করে দেয়, ভাবায় এবং মোহিত করে। তাকে জীবনের বাস্তবতা ও প্রকৃতির মেলবন্ধনের পার্থক্যের বেদনায় ব্যাকুল করে তোলে। তার হৃদয় জুড়ে প্রেমিক হতে সাহস যোগায় । এ রকম জীবনমুখী চিন্তা-চেতনা এবং সামাজিক বাস্তবতার সহজ ভাষাচিত্র রয়েছে এই গ্রন্থের পাতায় পাতায়। এমন আবেগঘন অনেক বিষয়ে কবি উচ্চারণ করেছেন সাবলীল পঙক্তিমালায়। তার কবিতার ভাষা সহজ, তিনি ব্যবহার করেছেন সহজ উপমার কল্পচিত্র কিন্তু সমকালের জীবনবাস্তবতা তো এতো সহজ-সরল নয়। তার কবিতা থেকে জীবনমুখী কিছু পঙক্তি তুলে দিচ্ছি-
ক. চাইলেই হয়তো হবে না আর নিজেকে চেনা
দাসত্ব গ্রহণ করেছে স্বাধীনতাকামী এই জীবন।
– ( প্রাপ্তি, পৃষ্ঠা- ২৩)
খ. জীবন চলার এই নিয়মে চলছে সবই অবিরত
কিছু চাওয়া বুকের গভীরে বাড়ায় শুধু ব্যথার ক্ষত।
– ( হয়তোবা, পৃষ্ঠা-৪৬)
কবি মিনহাজ তার কাব্যগ্রন্থে শৈশবস্মৃতি, গ্রামীণ প্রকৃতি, বৈশাখপ্রীতি, মাতৃভাষাপ্রেম, স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু ইত্যাদি বিষয়ের মধ্য দিয়ে যে ভাবনাচিত্র ফুটিয়ে তোলেন তা পাঠককে বিশেষ ভাবে ভাবায়। তাছাড়া মানুষের সুখ-দু:খ, আনন্দ-বেদনা, আশা-নিরাশা, যুদ্ধ-বিদ্বেষসহ সবই তার কবিতায় ধরা দেয় আন্তরিকতায়। নিছক শিল্পের জন্য শিল্প নয়। বরং সামাজিক অরাজকতা, জৈবনিক বাস্তবতা কোনো কিছুই বাদ যায় না তার চিন্তার জগৎ থেকে। ‘অন্তিম অপেক্ষায়’ নামক কাব্যগ্রন্থে যেমন ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার চিত্র ফুটে উঠেছে তেমনি উঠে এসেছে শৈশবের জন্য আকুলতার চিত্রও। প্রকৃতির নানান অনুষঙ্গ দিয়ে নানান ব্যঞ্জনায় সাজিয়ে তিনি মানুষের হারানো ঐতিহ্যকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন তার কাব্যপাতায়। তার কবিতা থেকে কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরছি-
ক. আমার মায়ের মুখের ভাষা সোনার চেয়ে খাঁটি
বাংলাদেশের বুকে যেমন পবিত্র এই মাটি।
– ( বাংলা আমার হৃদয় জুড়ে, পৃষ্ঠা- ১৭)
খ. আজও মনে পড়ে মায়ের হাতের রান্না
কে আছে পৃথিবীতে তার মতো অন্নপূর্ণা।
– ( মধুমাখা শৈশব, পৃষ্ঠা- ৪৩)
ছন্দের খেলায় শিল্পবোধকে মান্য করে কবি অত্যন্ত দরদ দিয়ে আমাদের হারানো অতীতের মুগ্ধতাকে ব্যক্ত করেছেন। ফলে তার কাব্যভাষা ও ছন্দজ্ঞান, রূপবৈচিত্র্য ও শব্দব্যবহারের স্টাইল এবং চিন্তার বহু বর্ণিল ব্যবহার পাঠকহৃদয় ছুঁয়ে যায়। তার কবিতায় কোনো দুর্বোধ্যতা নেই, নেই কোনো জড়তা, যা বলার তা তিনি সোজাসুজি বলার চেষ্টা করেছেন। মূলত এখানেই তার কবিতার রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। ছন্দ-চিন্তা-বিশ্বাস ও সৌন্দর্য্যে তার কবিতা অনন্য।
তিনি তার শৈশবকে, হারানো ঐতিহ্যকে, গ্রামীণ বাস্তবতাকে আজকের মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন খোলামেলা ভাবে। কবি মিনহাজ সাদ্দাম বোধগম্য সুন্দর ভাষায় তার পঙক্তিমালা উপস্থাপন করেছেন ‘অন্তিম অপেক্ষায়’ নামক কবিতাগ্রন্থে। প্রচ্ছদশিল্পী মাসুদুর রহমান মাসুদ কর্তৃক অলংকৃত প্রচ্ছদে এএইচ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ২০০ টাকা মূল্যের ৪৮ পৃষ্ঠার ঝকঝকে ছাপা এ কাব্যগ্রন্থটি কবিতাপ্রেমিক পাঠকসহ সমালোচকদের কাছে ভালো লাগবে বলে আমরা মনে করি। বইটি সংগ্রহ করতে আগ্রহীগণ কল করুন- 01738634814
আল হাফিজ, নির্বাহী সম্পাদক, মুক্তবুলি
2 comments on “মিনহাজ সাদ্দামের কাব্যগ্রন্থ: অন্তিম অপেক্ষায়”
অভিনন্দন। শুভকামনা কামনা রইলো।
আন্তরিক কৃতজ্ঞতা এবং ভালবাসা অবিরাম শ্রদ্ধেয় 🌹