কামাল আহমেদ ।।
বরিশাল- শব্দটি শোনামাত্রই শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে মনে পড়ে, মনে পড়ে জীবনানন্দ দাসকে। যাইহোক, ঘটনা প্রসঙ্গে বরিশাল শহর থেকে ভিন্ন কিছু প্রতিশ্রুতি নিয়ে এক সংস্কৃতিবান তরুণ আযাদ আলাউদ্দীন প্রকাশিত ও সম্পাদিত ম্যাগাজিন ‘মুক্তবুলি’ আমার হাতে এসে পৌঁছে।
সঙ্গে সম্পাদকের ছোট্ট একটি অনুরোধ, আমার ফেসবুক টাইমলাইনে যেন একটি পাঠ-প্রতিক্রিয়া দিই। যদিও অসুস্থ হওয়ার (হার্টজটিলতা ও উচ্চ কলস্টোরেল) আগেই লিখেছিলাম, পোস্টকরা হয়নি। যে জটিলতায় ভুগছি, আল্লাহই ভালো জানেন, কখন কী হয়। যদি তেমন কিছু (অপ্রত্যাশিত) হয়ে যায়, তবেতো এক ভাই এর পবিত্র একটি অনুরোধ রেখে গেলাম। তাই এখন অসুস্থতা নিয়েই পোস্ট করছি।
বই, পত্রিকা কিনে বা সংগ্রহ করে পড়ার মতো জ্ঞানার্জনের সবচেয়ে উপযুক্ত চর্চাটি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। এ চর্চার খানিকটা এখন স্থান করে নিয়েছে সবজান্তা অনলাইন মাধ্যমগুলো। প্রকৃত অর্থে অনলাইনে সাহিত্যচর্চা কাগজের বই পড়ার মতো যুতসই হয়না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাহিত্যচর্চার বারোটাও বেজে যায়।
কিন্তু কাগজের বই বা পত্রিকা যেভাবে পাঠক হারিয়েছে, তাতেকরে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বর্তমান অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। এ পরিস্থিতিতেও রাজধানী কেন্দ্রিক কিছু সংগঠন, কিছু স্বনামে খ্যাত জাতীয় পত্রপত্রিকা বা ম্যাগাজিন এখনও আপন চেষ্টায় এই সুন্দর ধারাটি কষ্টে ধরে রেখেছে। তাও জাতীয় পত্রিকাগুলোর সাহিত্যপাতা দিনদিন ছোট হয়ে আসছে।
সাহিত্যচর্চার এই দুর্দিনে রাজধানীর বাইরে বরিশাল থেকে প্রকাশিত ‘মুক্তবুলি’- নামে একটি ম্যাগাজিন আমার হাতে এসেছে। ব্যতিক্রম একটি শ্লোগান নজরে এলো। ‘পাঠক যারা লেখক তারা’- স্লোগানটি নতুনতর। বুঝতে বাকি রইলনা- নতুন নতুন পাঠক, লেখক তৈরির এটি একটি কৌশল।
প্রকাশক ও সম্পাদক আযাদ আলাউদ্দীন দেশের এক প্রান্তিক শহরে থেকে সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্র তৈরির এই চেষ্টা অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। ম্যাগাজিনের পরবর্তী সংখ্যার লেখালেখির বিষয়বস্তু আগেই নির্ধারিত থাকে। এতে লেখক-স্বাধীনতা কিছুটা ক্ষুন্ন হলেও একটি বিশেষ বিষয়ে খুঁটিনাটি জানার সুযোগ তৈরি হয়। জুলাই-আগস্ট ২০২১ এর যে দ্বি-মাসিক সংখ্যাটি আমার হাতে এসেছে তার পূর্ব নির্ধারিত বিষয় ছিল ‘জেলে জীবন’। আলোচ্য সংখ্যার পূর্ববর্তী সংখ্যার বিষয়বস্তু ছিল ‘উদ্যোক্তা’ ও পরবর্তীটির ‘চিঠি’।
নাম দেখেই বুঝা যাচ্ছে ভেতরের কথা। মাহমুদ ইউসুফের লেখা নিবন্ধ ‘জেলে জীবনের সর্বনাশা ফারাক্কা-তিস্তা বাঁধ’। এতে জল আর জলার দেশীয় পুরনো চিত্র ও বর্তমান সর্বনাশা (ভারতের নদীশাসন নীতি ও ফলাফল স্বরূপ) অবস্থার সার্বিক বর্ণনা এসেছে। করুণ পরিণতি হিসেবে দূর্বিসহ জেলে জীবনের কথাও উঠে এসেছে।
মোঃ জসিম জনির লেখা চমৎকার একটি ফিচার ‘জালেই জীবন জালেই মরণ’। বর্ণিত ঘটনায় ভোলা জেলার লালমোহন উপজেলার লর্ড হার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের স্লুইজঘাট বাজারের জেলে রিয়াজের বালক জীবন থেকে চলমান জেলে হিসেবে জীবিকা-জীবনের সুখ-দুঃখ, সমসাময়িক সমস্যা বর্ণিত হয়েছে। প্রকাশ পেয়েছে, জীবন-সংলগ্ন দারিদ্রতা, মহাজনদের সৃষ্ট ঋণচক্র, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, জলদস্যু অত্যাচার ও জাল-কেন্দ্রিক জীবনবোধের কথা। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই দূর্ভেদ্য চক্র থেকে বাইরে নিয়ে আসার সীমিত সুযোগের কথাও এসেছে। তাদের এই ক্ষুদ্র জীবনের পুঞ্জিভূত দক্ষতায় জাতীয় জীবনের বা জিডিপিতে অবদান বাড়লেও বাড়ছেনা ঐ ব্যক্তিজীবনের কোনো সুবিধা।
প্রায় একই চিত্র আরো নিখুঁতভাবে উঠে এসেছে বিশেষ প্রতিবেদন- সাব্বির আলম বাবুর লেখা ‘নদীর ঢেউয়ে জীবন দোলে’তে। এতে দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাসমূহের বা উপকূলীয় অঞ্চলের জেলে জীবনের সমস্যাগুলো ও একই সাথে পরিস্থিতির উত্তরণে সচেতন সমাজের করণীয় সম্পর্কে ইঙ্গিত রয়েছে।
কয়েকটি গল্প আছে, যেমনঃ মোঃ জিল্লুর রহমানের ‘নোনাজলের আলো’, ইসরাত জাহানের ‘রকিং চেয়ার’, এরশাদ সোহেলের ‘উজান গাঙে ভাসে প্রেম’, নীলা আহমেদের ‘আড়শি’, সুয়েজ করিমের ‘মাছের মুখে জেলের কথা’, মোহাম্মদ নুরুল্লাহর ফিচার ‘ধীবরের দুঃখকথা’, ইএইচএস মুন্সী এনামের প্রবন্ধ ‘মধু’, আবু সালেহ মোঃ নাসিমের ভ্রমণলিপি- ‘উদ্যোক্তা হাব এর কুয়াকাটা ভ্রমণ’ ও শিমুল সুলতানার অনুভূতি- ‘প্রিয় বাবা’। গল্পগুলো খুবই আবেগময় ও মর্মস্পর্শী এবং নির্ধারিত বিষয়ে প্রাসঙ্গিক।
এছাড়াও বত্রিশজন কবির কাঁচাপাকা লেখা কবিতা ম্যাগাজিনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও বিষয়বৈচিত্রতা এনেছে। ম্যাগাজিনের সার্বিকমান সুপরিচিত ম্যাগাজিনগুলোর মতো না হলেও যথেষ্ট ভালো। কাগজের মান, গ্রাফিক্স, প্রচ্ছদ চমৎকার। আমি একজন নগণ্য সাহিত্যকর্মী হিসেবে এর কদরবৃদ্ধি ও অধিক পাঠকপ্রিয়তা প্রত্যাশা করি। এই ম্যাগাজিন অবশ্যই এর স্বকীয়তা ও ধারাবাহিকতা ধরে রাখবে বলে আমি বিশ্বাসকরি।
কামাল আহমেদ, শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, চুনারুঘাট, হবিগঞ্জ। ০১৭২০৫৮০৫৭১।
মুক্তবুলি- ধীরে ধীরে দেশময় সাহিত্য সংস্কৃতির মুখপত্র হয়ে উঠুক। সুস্থচর্চার বিকাশ হোক।
মুক্তবুলি জুলাই-আগষ্ট- ২০২১ সংখ্যাটি নিয়ে চমৎকার রিভিউ লিখেছেন সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাটের শিক্ষক এবং প্রাবন্ধিক প্রিয় ভাই কামাল আহমেদ। ধন্যবাদ কামাল ভাইকে।