আযাদ আলাউদ্দীন
বর্ষাকাল যেন কদম কেয়ার গন্ধে মাতানো মুগ্ধ সময়, তাইতো বাংলা সাহিত্যে বর্ষা ঋতুর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। বর্ষার চরিত্র বা সৌন্দর্যের যে বহুগামী বৈচিত্র তা অন্য পাঁচটি ঋতু থেকে একবারেই স্বতন্ত্র। বাংলা ষড়ঋতুতে বর্ষার অপরূপ দৃশ্য যেমন আমাদের মনে কুহক জাগায়, ঠিক উল্টোদিকে বিষাদও এনে দেয়। বর্ষা যেমন নতুন শিহরণে জাগরিক করে, আবার ডুবাতেও পারে তার উদারতায়। বর্ষার এই চতুর্মূখীনতার কারণেই বোধহয় অন্যান্য ঋতুর চেয়ে এর গ্রহণযোগ্যতা আর গুরুত্ব বেশি। যার মায়াবী রূপ আমাদেরকে মোহিত করে, আন্দোলিত করে, শিহরিত করে। যার দর্শণে আমাদের হৃদয়-মন পুলকিত হয়। বিশেষকরে বর্ষার উথাল-পাথাল ঢেউ আমাদের হৃদয়-মনকে সিক্ত করে। কখনো আমরা হারিয়ে যাই স্বপ্নলোকে, আবার কখনো বা প্রিয় মানুষের দর্শন লাভের জন্য আমরা উদগ্রিব হয়ে উঠি। আবার কখনো বা প্রিয়তমার বিচ্ছেদ ব্যথায় বর্ষার বৃষ্টির মতো পানি ঝরতে থাকে আমাদের নয়ন বেয়ে। তখন যেন মনের অজান্তেই আমাদের অবুঝ মন গেয়ে উঠে-
এমন দিনে তারে বলা যায়/ এমন ঘনঘোর বরিষায়-
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে/ তপনহীন ঘন তমসায় -(রবীন্দ্রনাথ, বর্ষার দিনে)
বর্ষা নিয়ে কবি কালিদাস রচনা করেছেন বিখ্যাত মহাকাব্য ‘মেঘদূত’। কালিদাস বর্ষাকে অনুভব করেছেন অনুরাগের গভীরতায়। কালিদাসের দৃষ্টিতে বর্ষার সৌন্দর্য-সখা যে মেঘ, সেই মেঘকে কবি লোভনীয় সম্ভোগের আভাস দিয়ে যক্ষের সহচররূপে যক্ষ প্রেমিকার কাছে পাঠান। সেখানে মেঘ সঙ্গত কারণেই প্রেমের বার্তাবহ দূতরূপে চিহ্নিত হয়। মেঘের সঙ্গে প্রেম আর বিরহের একটা অনড় সম্বন্ধ পাতিয়ে কালিদাস তার কবিতায় এক অনবদ্য চিত্রকল্প তৈরি করেছেন। কালিদাসের কবিতার অনুবাদের কিছু অংশবিশেষ পড়লে আমরা তার বর্ষা নিয়ে মননের অভিব্যক্তি বুঝতে পারব।
‘কেমনে প্রিয়তমা রাখবে প্রাণ তার অদূরে উদ্যত শ্রাবণে/যদি- না জলধরে বাহন করে আমি পাঠাই মঙ্গলবার্তা?/যক্ষ অতএব কুড়চিফুল দিয়ে সাজিয়ে প্রণয়ের অর্ঘ্য/স্বাগত-স্বভাষ জানালে মেঘবরে মোহন, প্রীতিময় বচনে।’
পুরনো ভারতীয় সাহিত্যে কবিরা বর্ষাকালকে বিরতির কাল হিসেবেই বিবেচনা করতেন। কারণ, ভারতে বর্ষা নামার সঙ্গে সঙ্গে পথঘাট ও মাঠপ্রান্তর বর্ষার জলে ডুবে যেতো। চলাচলের জন্য সেরকম কোনো যানবাহন তখন ছিল না। প্রবাসী স্বামীরা বর্ষা নামার আগেই বাড়ি ফিরতেন, বণিকেরাও তাই করতেন। কিন্তু কেউ যদি বর্ষার আগে বাড়ি ফিরতে না পারতো তাহলে তাকে পুরো সাত-আট মাসই কাটাতে হতো নিঃসঙ্গতার মধ্যদিয়ে। বর্ষাকে নিয়ে লিখা হয়েছে প্রচুর প্রেম ও বিরহের কবিতা। এজন্যই বর্ষাকে বিরহের কাল বলা হয়।
বৈষ্ণব কবিদেরকেও বিরহের সঙ্গে বর্ষার একটি নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করতে দেখা যায়। পদাবলী সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মহাজন, বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস আর বিহারীলালের কবিতায় বর্ষা এসেছে একাধিকবার। বিদ্যাপতির বিরহের কবিতায় বর্ষা ও বিরহ একাকার হয়ে গেছে, যা নতুনত্ব পায় মধ্যযুগের বাংলা গীতিকবিতায়। সেখানে বর্ষা এসেছে রাধিকার প্রেমকে উসকে দেবার জন্য। বিশেষ করে অভিসার আর বিরহ পর্বে এ বর্ষা যেন প্রেমানলে ঘৃতের ছিটা। বৃষ্টির বর্ষনের সঙ্গে সঙ্গে রাধার কণ্ঠে বেজে উঠেছে-
এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা/ কেমনে আইলো বাটে।
আঙ্গিনার মাঝে বঁধূয়া ভিজিছে/দেখিয়া পরান ফাটে। (চন্ডীদাস)
অন্যখানে রাধা বলেছে-
এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর
এ ভরা বাদর মাহ বাদর/শূন্য মন্দির মোর। (বিদ্যাপতি)
এখানে বৃষ্টির জল যেন রাধার চোখের পানি হয়ে ঝরে পড়ছে। যা পৃথিবীর সকল প্রেমিকাকেই ব্যাকুল করে তোলে।
মধ্যযুগের আরেক কবিপ্রতিভা মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ‘কালকেতু উপাখ্যানে’ কালকেতুর স্ত্রী ফুল্লরার বারমাসের দুঃখ বর্ণনা করতে গিয়ে বর্ষাকাল সম্পর্কে বলেছেন:
শ্রাবণে বরিষে মেঘ দিবস রজনী/সিতাসিত দুই পক্ষ একই না জানি
বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতায় বর্ষাকে উপস্থাপন করেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। তার হাত ধরেই কবিতার মাধ্যমে বর্ষা যেন পূর্ণতা পেয়েছে। তার কবিতায় বর্ষার বিচিত্র রূপ প্রকাশ পায় বর্ষাবন্দনা রূপে। রবীন্দ্রনাথের গানের কথা বাদ দিলেও বহু জনপ্রিয় কবিতার মধ্যে আমরা বর্ষার অনুষঙ্গ খুঁজে পাই। তার ‘আষাঢ়’, সোনার তরী’, ‘বাঁশি’সহ বহু কবিতায় বর্ষা এসেছে বিভিন্ন আঙ্গিকে। এছাড়া রবীন্দ্রনাথের অন্যতম ছড়া কবিতা ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ আমাদের দুরন্ত শৈশবকে হাতছানী দিয়ে ডাকে।
প্রেমের কবি কাজী নজরুলের কবিতায় বর্ষা এসেছে প্রেমের জারক হিসাবে। প্রিয়া বিরহ আরো দ্বিগুণ করেছে বাদল দিনের মেঘ। বাদল ধারা প্রিয়ার আগমনী সুরকে বিদায়ী সুরে পরিণত করেছে। বাদল রাতের বর্ষণ সিক্ত রাতের পাখি হয়ে ওঠে কবির বেদনা বিজয়ী চিত্তলোকের চিত্রল প্রতীক। বিরহ কাতর পাখিকে কবি তাই বলছেন, তুমি যার জন্যে কাঁদছো সে তো তোমার জন্যে কাঁদে না। যেমনটি ‘চক্রবাক’ গ্রন্থের ‘বাদল রাতের পাখী’ কবিতায় কবির উপদেশ: ‘বাদল রাতের পাখী/উড়ে চল যেথা আজো ঝরে জল, নাহিক ফুলের ফাঁকি।’
কবি বর্ষার এই রাতে পাখিকে বন্ধু ভেবেছেন। পাখির বিরহের সাথে নিজের বিরহ একাকার করেছেন। আসলে সকল কোলাহল ছেড়ে কবি বর্ষার নির্জনতায় প্রেমের প্রকৃত মূর্তি গড়েন। অন্যদিকে নজরুল ইসলাম বর্ষার বিদায় মুহূর্তে ব্যথিত হয়েছেন। কবি বর্ষাকে বলেছেন, তোমার বিদায়ের কথা শুনে কেয়া রেণু পা-ুর হয়েছে, শিশিরভেজা শেফালি ঝরছে আজ। ঝরে কদমের কেশর।
পল্লী কবি জসিম উদদীন বর্ষায় দেখেছেন গাঁয়ের কৃষক-মুঠেরা কি করে তাদের এ আলস্য সময়ে। দাওয়ায় বসে গল্প, গান কিংবা গৃহস্থালী কিছু উপকরণ তৈরির দৃশ্য। যেমনটি পল্লী-বর্ষা কবিতায় গাঁয়ের চিত্র বর্ণনায় লিখেছেন:
‘গাঁয়ের চাষীরা মিলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায়/ গল্পের গানেকি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়!
কেউ বসে বসে বাখারী চাঁচিছে, কেউ পাকাইছে রসি/কেউবা নতুন দোয়াড়ীর গায়ে চাঁকা বাঁধে কসি কসি।’
‘মুসলিম রেনেসাঁর কবি’ ফররুখ আহমদ অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের অনুপ্রেরণায় ইসলামি ভাবধারার বাহক হলেও তার কবিতায়ও বর্ষার দোল লেগেছে। বৃষ্টির ছন্দ তাকে নাচিয়েছে। মনে আনন্দের ঢেউ খেলিয়েছে। তিনি আনন্দে তবলার ছন্দের মতো শিশুতোষ কাব্য ‘বৃষ্টির গান’-এ গেঁথেছেন-
‘বৃষ্টি এলো কাশবনে/ জাগলো সাড়া ঘাসবনে
বকের সারি কোথায় রে/ লুকিয়ে গেলো বাঁশবনে।
নদীতে নাই খেয়া যে/ ডাকলো দূরে দেয়া যে
কোন সে বনের আড়ালে/ ফুটলো আবার কেয়া যে।’
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি কবি আল মাহমুদ বর্ষাকে দেখেছেন অন্য এক দৃষ্টিতে। তার কবিতায় বর্ষা-প্রকৃতি অন্যমাত্রার এক কথা বলে। ‘আষাঢ়ের রাত্রে’ তিনি ব্যক্ত করেছেন :
‘শুধু দিগন্ত বিস্তৃত বৃষ্টি ঝরে যায়, শেওলা পিছল/ আমাদের গরিয়ান গ্রহটির গায়।’
এ ছাড়াও প্রাচীনযুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের অনেক কবি বর্ষার বন্দনায় কাব্য স্তুতি করেছেন। যেমন সৈয়দ শামসুল হক, সুকান্ত ভট্টাচার্য, নির্মেলন্দু গুণ, হুমায়ূন আহমেদ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুকুমার রায়, কায়কোবাদ, ইসমাঈল হোসেন শিরাজী, আহসান হাবীব, শেখ ফজলল করীম প্রমুখের কাব্য মানসেও বর্ষার অপার সৌন্দর্য নিয়ে রয়েছে সরস বর্ণনা। বর্ষা আসে কবিগণের মানসকে উদ্বেলিত করে নস্টালজিয়ায়। অনেকেই কাছে পেতে চেয়ছেন তার আপনজনকে। কারো কাছে দাওয়ায় বসে গল্প করা। কিন্তু খেটে খাওয়া মজুর-মুঠেদের দূর্দশার বর্ননাও এসেছে অনেক মানবতাবাদী কবির কাব্যে। সবাই নিজেদের নস্টালজিয়ায় ভেসে বেড়ানো, প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার প্রত্যাশা ও একত্রে সবাই বসে গল্পে মশগুলের পাশাপাশি যেন দূর্দশাগ্রস্থদের পাশে দাঁড়াই। বর্ষা হোক সবার জন্য আনন্দের!
লেখক: সাংবাদিক